ফরাসিরা কেন বারবার প্রতিবাদ করে?

0
141
নহেল গুলিবিদ্ধ হওয়ার ঘটনায় বিক্ষোভে উত্তাল ফ্রান্স, ২৯ জুন ২০২৩

বিক্ষোভে এখন উত্তাল ফ্রান্স। সাম্প্রতিক বিক্ষোভ থেকে শুরু করে বারবার ফ্রান্সে এই যে আমজনতা ফুঁসে ওঠে, এর কারণ কী? কেন বারবার এ দেশে এমন ঘটে?

১৭ বছরের কিশোর নাহেল। মা মেনিয়ার সঙ্গে থাকে ফ্রান্সের প্যারিসের পশ্চিমে নঁতে শহরে। আলজেরীয় মা একাই তাকে বড় করেছেন। ডেলিভারি চালক হিসেবে কাজ করত সে। ছিল পেশাদার রাগবি খেলোয়াড়। ইলেকট্রিশিয়ান হওয়ার জন্য প্রশিক্ষণ নিতে কলেজেও ভর্তি হয়েছিল।

২৭ জুন সকালে বাড়ি থেকে বের হওয়ার আগে মাকে বলেছিল, ‘ভালোবাসি মা।’ সকাল নয়টার ঠিক পরপরই বুক বরাবর খুব কাছ থেকে গুলি করা হয় এই কিশোরকে। নাহেল তখন একটি মার্সিডিজ গাড়ির চালকের আসনে ছিল। পুলিশ তাকে থামতে বলেছিল, কিন্তু সে থামেনি। ফ্রান্সে ১৭ বছর বয়সে গাড়ি চালানোর লাইসেন্স পাওয়া যায় না। পরে পুলিশ অবশ্য বলেছে, নাহেল মাদকাসক্ত ছিল।

কিন্তু ফরাসি পুলিশের এই ভাষ্যের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। উপরন্তু এ ঘটনার জের হিসেবে এখন ফুঁসে উঠেছে ফ্রান্স, শুরু হয়েছে বিক্ষোভ এবং সেই বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ছে ক্রমাগত।

নাহেলের মা মেনিয়া বিশ্বাস করেন, যে পুলিশ কর্মকর্তা তাকে গুলি করেছেন, তিনি নাহেলের দিকে তাকিয়ে তার মধ্যে এক আরবকে দেখতে পেয়েছেন। তাই তাকে মেরে ফেলতে চেয়েছেন।

কেন এমন মনে হলো নাহেলের মায়ের?

নহেলের মা ২৯ জুন, বিক্ষোভ মিছিলে নেতৃত্ব দেন নাহেলের মা মোনিয়া
নহেলের মা ২৯ জুন, বিক্ষোভ মিছিলে নেতৃত্ব দেন নাহেলের মা মোনিয়া

এর পেছনে বর্তমান ফ্রান্সের একশ্রেণির মানুষের বর্ণবাদী কর্মকাণ্ড ও অশ্বেতাঙ্গ মনোভাবের দায় রয়েছে। কেননা, স্কুলও নাহেলের জন্য অত্যন্ত কঠিন ছিল। সে যে স্কুলে পড়ত, তা ছিল একটি সমন্বিতকরণ প্রকল্পের অংশ, যা প্যারিসের সুবিধাবঞ্চিত এলাকার শিশুদের সহায়তা করত। নাহেল গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর তাকে নিয়ে সরব হয়েছেন অনেকেই। এর মধ্যে রয়েছেন সেই প্রকল্পের প্রধানও। তাঁর মতে, সামাজিকভাবে ও পেশাদার হিসেবে নাহেলের জায়গা করে নেওয়ার ইচ্ছাশক্তি ছিল। মাদক আর অপরাধে বুঁদ হয়ে থাকার মতো ছেলে সে ছিল না।

তাহলে এ ছেলের বুক বরাবর গুলি করা হলো কেন?

এক বিক্ষোভকারী বিবিসিকে বলেন, ‘আরব বা কালো হলে আপনি পুলিশি নিষ্ঠুরতার মুখোমুখি হবেনই।’ অন্যদিকে নাহেলের পারিবারিক বন্ধু ও প্রতিবেশীর কথা হলো, ‘আপনি যদি একজন তরুণ কৃষ্ণাঙ্গ হন, তবে ফ্রান্সের শহরতলিতে আপনাকে প্রতিদিন বর্ণবাদ, সহিংসতা এবং বিদ্বেষমূলক আচরণের শিকার হতে হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘পুলিশ বিদ্রূপ করে, অপমান করে এবং ঠিকমতো কথা বলে না। আর এখন মেরেও ফেলছে। নাহেলের ঘটনা সামনে এসেছে, কিন্তু এ ঘটনা প্রথমবারের মতো ঘটেনি।

 ‘দ্য ব্যাটল অব আলজিয়ার্স’ সিনেমায় কর্নেল ম্যাথিউ চরিত্রের অভিনেতা
‘দ্য ব্যাটল অব আলজিয়ার্স’ সিনেমায় কর্নেল ম্যাথিউ চরিত্রের অভিনেতা

নাহেলের মৃত্যুতে বর্তমানে ফ্রান্সজুড়ে যে বিক্ষোভ চলছে, তা সামলাতে রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছেন ফরাসি প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁ।

বিবিসির তথ্য অনুযায়ী, ২ জুলাই প্রায় অর্ধ লাখ পুলিশ মাঠে ছিল বিক্ষোভ দমনে। ফ্রান্সের সাম্প্রতিক এই বিক্ষোভ অনেককেই মনে করিয়ে দিয়েছে ১৯৬৪ সালের মে মাসের শিক্ষার্থী আন্দোলনের কথা, যার জেরে সে সময়ের ফরাসি রাষ্ট্রপতি শার্ল দ্যু গলকে দেশ ছেড়ে পালাতে হয়েছিল।

তখন পুঁজিবাদ, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ আর প্রথাগত প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে প্রথমে অবস্থান ধর্মঘট করেন শিক্ষার্থীরা। পরে দেশজুড়ে শ্রমিকেরা এতে অংশ নেন। বিক্ষোভটি এভাবেই সামাজিক আন্দোলনে রূপ নেয়।

সাম্প্রতিক বিক্ষোভ থেকে শুরু করে বারবার ফ্রান্সে এই যে আমজনতা ফুঁসে ওঠে, এর কারণ কী? কেন বারবার এ দেশে এমন ঘটে?

এই বিদ্বেষের উৎস কি তাহলে ঔপনিবেশিক ঘৃণা? ফরাসি রাষ্ট্রকাঠামো কি এখনো আরব, এশীয়, আফ্রিকান বংশোদ্ভূতদের ‘পতিত’ হিসেবেই দেখছে, যারা এখনো ‘উন্নত’ ফরাসি সংস্কৃতি ও জীবনাচারকে ধারণ করতে পারেনি বা করেনি? প্রাতিষ্ঠানিক সেই বিদ্বেষের বিরুদ্ধেই কি পথে নেমেছেন হাজার হাজার বিক্ষুব্ধ তরুণ?

এই বিদ্বেষের উৎস কি তাহলে ঔপনিবেশিক ঘৃণা? ফরাসি রাষ্ট্রকাঠামো কি এখনো আরব, এশীয়, আফ্রিকান বংশোদ্ভূতদের ‘পতিত’ হিসেবেই দেখছে, যারা এখনো ‘উন্নত’ ফরাসি সংস্কৃতি ও জীবনাচারকে ধারণ করতে পারেনি বা করেনি? প্রাতিষ্ঠানিক সেই বিদ্বেষের বিরুদ্ধেই কি পথে নেমেছেন হাজার হাজার বিক্ষুব্ধ তরুণ?

উত্তর খুঁজতে আমাদের একটু পেছনে যেতে হবে। ‘তাঁদের চিনে ফেলা মানে তাঁদের নিশ্চিহ্ন করা’—সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে বলেন কর্নেল ম্যাথিউ নামের লোকটি। ঔপনিবেশিকে শাসক ফ্রান্সের বিরুদ্ধে আলজেরিয়ার প্রতিরোধ গুঁড়িয়ে দিতে যেকোনো পদ্ধতি অবলম্বন করতে তিনি বদ্ধপরিকর। আলজেরিয়ার গেরিলা যোদ্ধাদের তিনি ‘চেহারাবিহীন শত্রু’ হিসেবে চিহ্নিত করেন। অন্তত এমনটাই আমরা দেখি ‘দ্য ব্যাটল অব আলজিয়ার্স’ সিনেমায়।

ফরাসি ঔপনিবেশিক প্রকল্পের মূল ভিত্তি ছিল ‘সভ্যতার প্রসার ঘটানো’। ১৮৮৪ সালে উপনিবেশবাদের এক অন্যতম প্রবক্তা জুলস ফেরি ঘোষণা দেন, ‘উৎকৃষ্ট জাতির নিকৃষ্ট জাতির ওপর অধিকার থাকে, নিকৃষ্ট জাতিগুলোকে সভ্য করে তোলা তাদের দায়িত্ব।’ আর তাই ফরাসিরা যেখানেই উপনিবেশ স্থাপন করেছে ‘উন্নত’ ফরাসি ভাষা ও ক্যাথলিক ধর্মের প্রতিষ্ঠা ঘটিয়েছে। স্থানীয় ভাষা, সংস্কৃতি ও লোকাচারকে এ সময় যথাসম্ভব মুছে ফেলা হয়েছে। বাস্তবতা যখন এমন, তখন ‘অ্যাসিমিলেশন’ বা ‘সমন্বিতকরণ’ চুক্তির আওতায় উপনিবেশিতরা ফরাসি নাগরিক হওয়ার সুযোগ পেয়েছেন। যার অর্থ হলো নিজের আদি বা লোকজ সত্তাকে পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন করে ‘ফরাসি’ হওয়ার সব লক্ষণকে ধারণ করা।

কিন্তু এসব প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েও এই উপনিবেশিত মানুষজন সহি ‘ফরাসি’ হতে পারেননি। আদতে তাঁরা উপনিবেশিত এবং ক্ষমতাকাঠামোর নিচে অবস্থান করেন, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে সব সময় ‘প্রজা’ই রয়ে গেছেন। শুধু তা–ই নয়, উপনিবেশগুলোয় ফরাসি বসতি স্থাপনকারীরাই ক্ষমতাকাঠামোর অধিপতি হয়ে বসেছেন এবং শাসন করে গেছেন।

ষোড়শ শতকে ফ্রান্সের ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্য বিস্তার লাভ শুরু করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর উপনিবেশবাদবিরোধী আন্দোলনের মুখে তার প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো ক্ষয় হতে শুরু করে বটে, কিন্তু তখনো যা ছিল, তা–ও কম নয়। এর মধ্যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জেনারেল শার্ল দ্যু গল ও ফ্রি ফ্রেঞ্চ একে একে সব কটি উপনিবেশের দখল নিতে শুরু করলেন। সেগুলোকে ঘাঁটি বানিয়ে ফ্রান্সকে মুক্ত করার যুদ্ধে নামলেন তাঁরা। এরপরই শুরু হলো ফরাসি উপনিবেশের বিরুদ্ধে কঠিন ও রক্তক্ষয়ী লড়াই। এ সময় কোনো কোনো দেশ স্বাধীন হওয়ার সৌভাগ্যও অর্জন করে। যেমন আলজেরিয়া ও ভিয়েতনাম। কিন্তু ‘ডিকলোনাইজেশন’ বা ঔপনিবেশকতামোচনের পথ যে সদাই বিভ্রান্তি ও দ্বন্দ্বে পরিপূর্ণ!

বিক্ষোভে উত্তাল ফ্রান্সে জিনিসপত্রে আগুন ধরিয়ে দিচ্ছে জনতা
বিক্ষোভে উত্তাল ফ্রান্সে জিনিসপত্রে আগুন ধরিয়ে দিচ্ছে জনতা

কেনিয়ার উত্তর–উপনিবেশবাদবিষয়ক তাত্ত্বিক নগুগি ওয়া থিয়ঙ্গে তুলে ধরেন ভাষা ও সংস্কৃতির রাজনীতির কথা। তিনি বলেন, উপনিবেশিতদের মননের ঔপনিবেশিকতামোচনের প্রয়োজন সবচেয়ে বেশি। ‘ডিকলোনাইজিং দ্য মাইন্ড: দ্য পলিটিকস অব ল্যাঙ্গুয়েজ ইন আফ্রিকান লিটারেচার’ বইয়ে নগুগি লিখেছেন, ‘ভাষা যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে এবং সংস্কৃতি হিসেবে একে অন্যের পণ্য। যোগাযোগ সংস্কৃতি তৈরি করে, সংস্কৃতি যোগাযোগের একটি উপায়। ভাষা সংস্কৃতিকে ধারণ করে এবং সংস্কৃতি মুখে মুখে বলা গল্প আর সাহিত্যের মাধ্যমে ধারণ করে, আমাদের মূল্যবোধের সম্পূর্ণ কাঠামো, যার মাধ্যমে আমরা নিজেদের দেখি এবং এই বিশ্বে নিজেদের অবস্থান নির্ধারণ করি…কাজেই ভাষা আমাদের থেকে অবিচ্ছিন্ন; মনুষ্য গোষ্ঠী হিসেবে, যাদের সুনির্দিষ্ট কাঠামো ও চরিত্র, সুনির্দিষ্ট ইতিহাস, বিশ্বের সঙ্গে সুনির্দিষ্ট সম্পর্ক রয়েছে।’

 ‘দ্য ব্যাটল অব আলজিয়ার্স’ সিনেমার দৃশ্য
‘দ্য ব্যাটল অব আলজিয়ার্স’ সিনেমার দৃশ্য

ফরাসি ঔপনিবেশিক শাসন উপনিবেশিতের মূল্যবোধের কাঠামোকেই ছিনতাই করেছে। তার নিজেকে দেখার পথটাই সে উল্টে দিয়েছে। সে লড়ছে শাসকের দৃষ্টিভঙ্গি ও নিজের দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে। তার সামষ্টিক অবচেতনে প্রোথিত ইতিহাস ও ঐতিহ্যের যে শিকড়ে ক্রমাগত আঘাত করে ঔপনিবেশিক শক্তি তাঁকে প্রজা বানিয়ে তুলেছে, তার প্রতিরোধ শুধু এই আগ্রাসনের বিরুদ্ধে নয়। তাকে আবার শিখতে হচ্ছে নিজেকে নতুন করে দেখতে, নতুন করে খুঁজতে। নব্য উপনিবেশবাদের পিচ্ছিল পথে হেঁটে নিজের কাছে পৌঁছানোর যাত্রায় হয়তো প্রতিবাদই হয়ে উঠছে তার একমাত্র হাতিয়ার।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.