‘দাঙ্গা-হাঙ্গামা’ মোকাবিলায় পুলিশের মহড়া

0
121
বিএনপির ২৮ অক্টোবরের মহাসমাবেশ সামনে রেখে ‘দাঙ্গা-হাঙ্গামা’ নিয়ন্ত্রণে নিজেদের ঝালিয়ে নিয়েছেন পুলিশ সদস্যরা

বিএনপির ২৮ অক্টোবরের মহাসমাবেশ সামনে রেখে ‘দাঙ্গা-হাঙ্গামা’ নিয়ন্ত্রণে নিজেদের ঝালিয়ে নিয়েছেন পুলিশ সদস্যরা। বাহিনীর সদস্যদের দক্ষতা বাড়াতে গতকাল বুধবার সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত ৩০০ ফুট এলাকায় বিশেষ মহড়ার আয়োজন করে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)। রাজধানীর ৫০ থানার ওসি ছাড়াও বিভিন্ন পদমর্যাদার পুলিশ সদস্যরা এতে অংশ নেন।

মহাসমাবেশ ঘিরে যে কোনো ধরনের বিশৃঙ্খলা দেখা দিলে তা প্রতিহত করার কৌশল মহড়ায় শেখানো হয়েছে। ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান ছাড়াও পুলিশের শীর্ষ কর্মকর্তারা সেখানে উপস্থিত ছিলেন। আইনশৃঙ্খলা, মানুষের জীবন ও সম্পত্তি রক্ষা করতে কম ক্ষয়ক্ষতির মাধ্যমে কীভাবে ‘বেআইনি’ সমাবেশ ছত্রভঙ্গ করা যায়; নানামাত্রিক সেই কলাকৌশল উপস্থাপন করা হয়েছে। পুলিশের মতিঝিল বিভাগ আলাদাভাবে তাদের অনুশীলন কার্যক্রমে অংশ নেয়। সব মিলিয়ে পাঁচ শতাধিক পুলিশ সদস্য অনুশীলনে ছিলেন। সেখানে সাউন্ড গ্রেনেডসহ বিভিন্ন সরঞ্জামের ব্যবহারও শেখানো হয়। একাধিক দায়িত্বশীল কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।

পুলিশের এক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা বলেন, যে কোনো পরিস্থিতিতে কীভাবে দায়িত্ব পালন করতে হবে, সে বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। সহিংস পরিস্থিতি মোকাবিলায় পুলিশ সদস্যদের পারদর্শিতায় কোনো ঘাটতি রয়েছে কিনা, মাঠ পর্যায়ে অনুশীলনের মাধ্যমে যাচাই-বাছাই করে দেখা হয়েছে। বুধবারের মহড়ায় রাজধানীর বিভিন্ন থানার পুলিশ সদস্য ছাড়াও পাবলিক অর্ডার ম্যানেজমেন্ট (দাঙ্গা ইউনিট), ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ, কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটসহ বিভিন্ন বিভাগের সদস্যরা অংশ নিয়েছেন।

সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ২৮ অক্টোবর আওয়ামী লীগ, বিএনপিসহ চারটি সংগঠন ঢাকায় সমাবেশ করতে চায়। তারা এরই মধ্যে পুলিশকে চিঠি দিয়েছে। সরকারের পদত্যাগের এক দফা আন্দোলনে থাকা বিএনপি ঢাকার নয়াপল্টনে দলীয় কার্যালয়ের সামনে মহাসমাবেশের ডাক দিয়েছে। এ জন্য গত শনিবার দলটি ঢাকা মহানগর পুলিশের কাছে আবেদনও করেছে। একই দিনে বায়তুল মোকাররম মসজিদের দক্ষিণ গেটে শান্তি সমাবেশের ডাক দিয়েছে আওয়ামী লীগ। সেদিন রাজধানী দখলে রাখার ঘোষণা দিয়েছে ক্ষমতাসীন দলটি। বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে না থাকলেও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে একই দিন মতিঝিলের শাপলা চত্বরে মহাসমাবেশের কর্মসূচি ঘোষণা করেছে জামায়াতে ইসলামী। তবে দলটির পক্ষ থেকে অনুমতি চেয়ে পুলিশকে গতকাল পর্যন্ত কোনো চিঠি দেওয়া হয়নি। দশম সংসদ নির্বাচনের আগে ২০১৩ সালের আগস্টে আদালতের রায়ে জামায়াতের নিবন্ধন অবৈধ ঘোষণা করা হয়। ফলে দলীয়ভাবে জামায়াত নেতাদের নির্বাচন করার সুযোগ বন্ধ হয়ে যায়।

তবে এখনও কোনো দলকে ডিএমপির তরফ থেকে অনুমতি দেওয়া হয়নি। এমনকি কে কোন ভেন্যুতে সমাবেশ করতে পারবে, এটাও পুলিশ জানায়নি। এদিকে বিএনপির পক্ষ থেকে গতকাল বলা হয়, ‘পুলিশের অনুমতি নিয়ে সমাবেশ করতে হবে– সেটা সংবিধানের কোথায় বলা আছে।’ পাল্টাপাল্টি একাধিক দলের একই দিন সমাবেশ ঘিরে ব্যাপক নিরাপত্তা প্রস্তুতি নিয়েছেন পুলিশ-র‍্যাবসহ অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। ঢাকা ও আশপাশের জেলায় বাড়তি নজরদারি থাকছে।

বিএনপি-জামায়াত দাবি করেছে, সমাবেশ ঘিরে তাদের অনেক নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। ১৭ থেকে ২৪ অক্টোবর পর্যন্ত বিএনপির এক হাজার ২৬৫ নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তবে পুলিশের ভাষ্য, যাদের বিরুদ্ধে মামলা ও গ্রেপ্তারি পরোয়ানা আছে, তাদেরই ধরা হচ্ছে।

একাধিক সূত্র জানায়, বিএনপি-জামায়াতের নেতাকর্মীর ওপর নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। তবে সমাবেশের আগে বিভিন্ন জেলা থেকে নানা কৌশলে বিএনপি নেতাকর্মী ঢাকায় ঢুকছে। নজরদারি এড়াতে তারা হোয়াটসঅ্যাপসহ বিভিন্ন ‘সিক্রেট’ গ্রুপে যোগাযোগ রাখছে। বিএনপির অনেক নেতাকর্মী বিশেষ কৌশলে ‘বিদেশি’ মোবাইল নম্বরও ব্যবহার করছে।

গতকাল আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা শেষে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান সাংবাদিকদের বলেন, ২৮ অক্টোবর বিএনপি রাজধানীর নির্দিষ্ট স্থানে শান্তিপূর্ণ অবস্থান করে চলে গেলে সরকার বাধা দেবে না। বিএনপি সমাবেশের যে অনুরোধ করেছে, কীভাবে করেছে সেটা পুলিশ কমিশনার জানেন। ঢাকার কোন জায়গায় করলে এত লোক আনবে বলে তারা ঘোষণা দিয়েছে। তারা নাকি সারাদেশ থেকে যারাই বিএনপি করে, তাদের নিয়ে আসবে। কোনো সদস্যই নাকি বাদ থাকবে না। এমনই আমরা শুনছি। তেমনই যদি হয়, এত লোক ঢাকায় এলে অন্য ধরনের একটা পরিস্থিতি হতে পারে। সে জন্যই আমাদের কমিশনার তাদের কোথায় সমাবেশ করতে দেবেন, সেটি তিনি বুঝবেন। সেভাবেই তিনি সিদ্ধান্ত নেবেন।

এক প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ২৮ অক্টোবর সরকার ঢাকার প্রবেশপথ কেন বন্ধ করবে? ঢাকায় মানুষ আসবে ব্যবসায়িক কাজে, চাকরির কাজে। অনেকে ঢাকার বাইরে থেকে এসে অফিস করেন। কাজেই ঢাকার পথ আমরা কেন বন্ধ করব?

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘জামায়াতে ইসলামী নিবন্ধিত দল নয়। কাজেই তারা জামায়াতের ব্যানারে যদি আসে, তাহলে তাদের সমাবেশের পারমিশন দেওয়ার প্রশ্নই আসে না।’

পাল্টাপাল্টি সমাবেশ ঘিরে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতির শঙ্কা আছে কিনা, এ প্রশ্নে আসাদুজ্জামান খান বলেন, সরকার তো এমন কিছু নয় যে তারা ধাক্কা দিল, পড়ে গেল। গণতান্ত্রিক সরকার ভোটের মাধ্যমে এখানে এসেছে, তার যে মেয়াদ সেই মেয়াদের পরে নির্বাচন হবে, তারপরই সরকার পরিবর্তন হবে।

ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশন) ড. খ. মহিদ উদ্দিন বলেন, বিএনপিকে যেখানে সমাবেশের অনুমতি দেওয়া হবে, সেখানেই করতে হবে। আশা করি, সেই দায়িত্বশীলতার জায়গায় তারা থাকবেন।

পুলিশ অনুমতি দিলেও বিএনপি নয়াপল্টনে সমাবেশ করবে বলে ঘোষণা দিয়েছে– এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, আমাকে আইনি কাঠামোর মধ্য থেকে কথা বলতে হবে। কারও বক্তব্যের ব্যাপারে আমার কোনো মন্তব্য নেই। সব রাজনৈতিক দলের প্রতি আহ্বান জানাই– আইনি কাঠামোতে দেওয়া শর্তগুলো যেন তারা অনুসরণ করে। ঢাকা শহরে যে কোনো রাজনৈতিক দলের সমাবেশ মাঠে করাই শ্রেয়। বিভিন্ন সময় রাজনৈতিক দলগুলোকে সেটিই আমার বলেছি।

কোনো রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীর রাজধানীতে বসে পড়ার গোয়েন্দা তথ্য আছে কিনা জানতে অতিরিক্ত কমিশনার ড. খ. মহিদ উদ্দিন বলেন, ‘সুনির্দিষ্ট এমন কোনো তথ্য এখনও নেই। অনেক সময় রাজনীতিবিদরা এ ধরনের ঘটনা ঘটার পরে তাদের দায়িত্ব নিতে চায় না। তারা বলেন, কে করেছে, তারা জানেন না। এমন অভিজ্ঞতাও আমাদের আছে। কাজেই নাশকতা যে করবে না– এমন কথা এখনই বলা যাচ্ছে না। নগরবাসীকে নিরাপদ রাখতে আমাদের সব ধরনের প্রস্তুতি রয়েছে।’

ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (অপারেশন) বিপ্লব কুমার সরকার বলেন, ডিএমপি অর্ডিন্যান্স অনুযায়ী কমিশনারের অনুমতি ছাড়া ঢাকায় কোনো সংগঠন সমাবেশ করতে পারে না। বিএনপিকে পুলিশের অনুমতি সাপেক্ষে সমাবেশ করতে হবে। আইনের ব্যত্যয় কেউ ঘটালে আমরা কঠোর ব্যবস্থা নেব।

সব প্রবেশমুখে থাকবে র‍্যাব 

২৮ অক্টোবর রাজনৈতিক সমাবেশ ঘিরে ঢাকা শহরের প্রবেশমুখগুলোতে চেকপোস্ট বসানোর কথা জানিয়েছে র‍্যাব। তারা বলছেন, যাতে কেউ আগ্নেয়াস্ত্র ও বিস্ফোরক দ্রব্য নিয়ে সমাবেশে আসতে না পারে, সে জন্য তল্লাশি করা হবে।

গতকাল কারওয়ান বাজার র‍্যাব মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলনে এক প্রশ্নের জবাবে র‍্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, সমাবেশ ঘিরে সম্প্রতি রাজধানীসহ মহাসড়কে প্যাট্রলিং জোরদার করা হয়েছে; যাতে সাধারণ জনগণ নিশ্চিতে চলাফেরা করতে পারেন। কারও যদি নাশতার পরিকল্পনা থাকে, তাদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনতে কাজ করছেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। এ ছাড়া রাজনৈতিক কর্মসূচি ঘিরে কোনো স্বার্থান্বেষী মহল যাতে নাশকতা ও সহিংসতা করতে না পারে, এ জন্য গোয়েন্দারাও তৎপর আছে। গুজব ঠেকাতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও নজর রাখছে র‍্যাব।

আবাসিক হোটেল অনেকটাই ফাঁকা

গতকাল মতিঝিল ও রমনা এলাকার বন্ধু আবাসিক হোটেল, আজিজ হোটেল, রহমানিয়া হোটেল, বকসী হোটেলে গিয়ে দেখা যায় ‘অতিথি’ অনেক কম। হোটেল মালিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ২৮ অক্টোবর ঘিরে রাজনৈতিক উত্তাপের কারণে আগের থেকে অনেক কম বুকিং পাচ্ছেন তারা।

ডিএমপির মতিঝিল বিভাগের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, মতিঝিল এলাকায় ১০১টি আবাসিক হোটেল ও দেড় শতাধিক মেস রয়েছে। সব তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। সব জায়গায় গোয়েন্দারা কাজ করছে।  বিএনপির নেতাকর্মী এবার হোটেলের চেয়ে আত্মীয় ও বন্ধুর বাসায় বেশি অবস্থান করছেন।

সাহাদাত হোসেন পরশ ও আব্দুল হামিদ

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.