ঘুমেও আঁতকে উঠছেন সাদিয়া ও মঙ্গলী

0
99
চিকিৎসাধীন মঙ্গলী বাগচী। বুধবার বটিয়াঘাটা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে

অনুশীলনে কমে গেছে মেয়ের সংখ্যা

হামলাকারী একজন জেলে জামিনে তিনজন

‘ওরা আমাদের ওপর হামলা করেছে, চারজনকে মারধর করেছে। হামলাকারী সালাউদ্দিন আমাদের হত্যার হুমকি দিয়েছে। মামলা তুলে না নিলে এসিড মেরে মুখ ঝলসে দেওয়ারও ভয় দেখিয়েছে। এর পর থেকে রাতে ঘুমাতে পারছি না, আতঙ্ক লাগে। আগে কখনও এমন ভয়াবহ পরিস্থিতির মুখোমুখি হইনি।’

হাফ প্যান্ট ও জার্সি পরে ফুটবল খেলার কারণে মারধরের শিকার খুলনার বটিয়াঘাটা উপজেলার তেঁতুলতলা সুপার কুইন ফুটবল একাডেমির খেলোয়াড় সাদিয়া নাসরিন বুধবার দুপুরে এভাবেই তাঁর উদ্বেগের কথা তুলে ধরেন। তেঁতুলতলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে কথা হয় তাঁর সঙ্গে। এ সময় সেখানে ছিলেন মারধরের শিকার কিশোরী ফুটবলার হাজেরা খাতুন, জুঁই মণ্ডল ও রিতু বৈরাগী। তাদের চোখে-মুখে তখন আতঙ্কের ছাপ। তারা জানান, আগে প্রতিদিন প্রায় ৩০ জন অনুশীলনে মাঠে আসত, এখন আসে ১০-১৫ জন।

বটিয়াঘাটা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসাধীন হামলায় আহত কিশোরী ফুটবলার মঙ্গলী বাগচী। তিনতলায় একটি বেডে তখন পাশে বসা তাঁর মা সুচিত্রা বাগচী। মঙ্গলী বলেন, ‘নূপুর ও তার পরিবারের লোকজন আমাদের মারধর করেছে। রড দিয়ে পিটিয়ে আমার মাথা ফাটিয়ে দিয়েছে। তারা ওড়না দিয়ে প্রায় ২ ঘণ্টা আমাকে বেঁধে রাখে।’ তিনি আরও বলেন, ‘ওরা বলেছে, হাফ প্যান্ট-জার্সি পরে গ্রামের মাঠে ফুটবল খেলা যাবে না। শুধু তাই নয়, ওরা এসিড মেরে আমাদের মুখ ঝলসে দেওয়ার হুমকি দিয়েছে। ঘটনার পর থেকে রাতে ঘুম আসে না। শুধু মনে হয়, এই বোধ হয় আবার হামলা হলো, এসিড মারল।’ হামলাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেন মঙ্গলী।

মা সুচিত্রা বাগচী বলেন, ‘মেয়েটা অনেক ভয় পেয়েছে। রাতে আঁতকে উঠছে। ওর মাথায় এখনও ব্যথা।’ মঙ্গলী ফুটবল খেলা চালিয়ে যেতে চায় জানিয়ে মা সুচিত্রা বলেন, ‘আমি ওকে ফুটবল ছাড়তে বলিনি।’ বুধবার মঙ্গলীকে হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র দেওয়ার কথা থাকলেও বিকেলে চিকিৎসকরা তাকে ভর্তি থাকতে বলেন।

অনুশীলনে কমে গেছে সংখ্যা

তেঁতুলতলা সুপার কুইন ফুটবল একাডেমির সহসভাপতি দিলীপ বৈরাগী জানান, দেড় বছর আগে তারা এই একাডেমি গড়ে তোলেন। তেঁতুলতলা স্কুলের মেয়েদেরও একটা টিম আছে। দুই প্রতিষ্ঠানের প্রায় ৬০-৬৫ জন মেয়ে ফুটবলার আছে। আগে প্রতিদিন প্রায় ৩০ জন মেয়ে ফুটবল অনুশীলন করতে আসত। হামলার ঘটনার পর থেকে ১০-১৫ জনের বেশি আসছে না। সবার মধ্যে ভয় কাজ করছে।

তিনি বলেন, ‘আগে তিন মেয়ে ফুটবলার স্কুল মাঠের পাশে একটি মেসে থাকত। হামলার পর থেকে তারা আতঙ্কে। সে কারণে তাদের আমার বাড়িতে নিয়ে রেখেছি।’

একাডেমির সাধারণ সম্পাদক দেবাশীষ কুমার মণ্ডল জানান, তেঁতুলতলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ২০১২ সাল থেকে প্রতিবছর বঙ্গমাতা গোল্ডকাপ ফুটবল টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন হয়ে আসছে। স্কুলের মেয়েরা ফুটবল খেলে। স্কুল থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পরও অনেকে ফুটবল খেলে। কিন্তু আগে কখনও এমন ঘটনা ঘটেনি।

একাডেমির সভাপতি ইসলাম হাওলাদার বলেন, ‘হামলার ঘটনায় মেয়েদের মধ্যে আতঙ্কে বিরাজ করছে। অনুশীলনের জন্য ডেকে ডেকে আনতে হচ্ছে। আগে কোনো দিন গ্রামের কেউ ফুটবল খেলা নিয়ে মেয়েদের উত্ত্যক্ত বা কটূক্তি করেনি। কিন্তু নূর আলমের পরিবার এবার ঝামেলা বাধিয়েছে।’

হামলায় আহত ফুটবলার হাজেরা খাতুনের বাড়ি রূপসা উপজেলার আলাইপুর গ্রামে। দ্বাদশ শ্রেণিতে পড়েন তিনি। দেড় বছর ধরে এই গ্রামের মেসে থেকে ফুটবল খেলছেন। হাজেরা বলেন, ‘আগে কখনও এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হইনি।’ আহত আরেক ফুটবলার জুঁই মণ্ডলের বাড়ি দাকোপ উপজেলার চালনা। এ গ্রামে মেসে থেকে এক বছর ধরে ফুটবল খেলছেন তিনি। জুঁই বলেন, ‘আমাদের সঙ্গে এমন ঘটনা ঘটবে কোনোদিন ভাবিনি।’

ফুটবলার রিতু বৈরাগী দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্রী। তিনি বলেন, ‘প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়া অবস্থা থেকে ফুটবল খেলি। আগে কোনোদিন বাধা আসেনি। আমরা ভীতির মধ্যে আছি।’ রিতু বৈরাগীর বড় বোন জয়া বৈরাগী বলেন, ‘রিতু ও আমার মেয়ে বৈশাখী আগে নিজেরাই বাড়ি থেকে মাঠে আসত। এখন তাদের সঙ্গে আমি মাঠে আসি।’

আসামি ১ জন জেলে, ৩ জন জামিনে

হত্যার উদ্দেশ্যে হামলা ও মারধরের অভিযোগে গত ৩০ জুলাই রোববার সাদিয়া নাসরিন বাদী হয়ে নূপুর, তাঁর বাবা নূর আলম খাঁ, ভাই সালাউদ্দিন ও নূপুরের মা রঞ্জি বেগমকে আসামি করে বটিয়াঘাটা থানায় মামলা করেন। মামলার পর পরই পুলিশ নূর আলমকে গ্রেপ্তার করে।

বটিয়াঘাটা থানার ওসি মো. শওকত কবির জানান, নূর আলম বর্তমানে কারাগারে। তবে অন্য তিন আসামি মঙ্গলবার আদালত থেকে জামিন পেয়েছে। তিনি জানান, এসিড নিক্ষেপের হুমকির অভিযোগে সাদিয়া গত ৩১ জুলাই একটি জিডি করেন। মামলা ও জিডির তদন্ত চলছে বলে জানান ওসি মো. শওকত। মেয়েদের নিরাপত্তাহীনতা সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘প্রতিদিন পুলিশ ওই গ্রামে টহল দিচ্ছে। মেয়ে ও তাদের অভিভাবকদের বলেছি, কোনো সমস্যা মনে করলে সঙ্গে সঙ্গে জানাতে, আমরা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেব।’

নূর আলমের বাড়ি তালাবদ্ধ

স্কুল মাঠ থেকে প্রায় এক কিলোমিটার দূরে হামলাকারী নূর আলমের বাড়ি। কর্দমাক্ত ইটের সোলিং রাস্তা দিয়ে দুপুরে ওই বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, বাড়ির বেড়ার গেটে তালা ঝুলছে। ডাকাডাকি করলেও ভেতর থেকে কেউ সাড়া দেননি। লোকজনের কথা শুনে এগিয়ে আসেন প্রতিবেশী আশরাফ ও হাসান মোল্লা নামের দু’জন। তারা জানান, হামলার ঘটনার পর থেকে বাড়িতে কেউ নেই।

যেভাবে ঘটনার শুরু

স্থানীয় লোকজন জানান, বটিয়াঘাটার তেঁতুলতলা গ্রামের সাদিয়া নাসরিন জেলা অনূর্ধ্ব-১৭ দলের ফুটবল খেলোয়াড়। বটিয়াঘাটা কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্রী সাদিয়া ও অন্য কিশোরীরা স্থানীয় ‘তেুঁতলতলা সুপার কুইন ফুটবল একাডেমি’তে অনুশীলন করে।

সাদিয়া নাসরিনের অভিযোগ, গত ২৭ জুলাই বৃহস্পতিবার একাডেমিতে অনুশীলন করার সময় নূপুর খাতুন নামে প্রতিবেশী এক মেয়ে তার ছবি তোলেন। পরে বাড়িতে গিয়ে তাঁর বাবা-মাকে সেই ছবি দেখিয়ে  আজেবাজে মন্তব্য করে আসেন। সাদিয়া ২৯ জুলাই শনিবার বিষয়টি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে নূপুর অকথ্য ভাষায় তাঁকে গালাগাল করেন। প্রতিবাদ করলে তাঁকে এলোপাতাড়িভাবে কিল, চড়, ঘুসি মেরে মুখ ও বুকের বিভিন্ন স্থানে জখম করা হয়।

সাদিয়া বলেন, ‘বাড়িতে গিয়ে আমি বাবা-মা, কোচ ও অন্য খেলোয়াড়দের ঘটনাটি জানাই। তারা আমাকে নিয়ে সন্ধ্যার দিকে নূপুর খাতুনের বাড়িতে যান। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে নূপুর, তাঁর বাবা নূর আলম খাঁ, ভাই সালাউদ্দিন ও নূপুরের মা রঞ্জি বেগম আমাদের ওপর হামলা করে। এতে মঙ্গলী, হাজেরা ও জুঁই আহত হন। তারা লোহার রড দিয়ে আমাদের ওপর হামলা চালায়, চায়নিজ কুড়াল নিয়ে এসে হত্যার হুমকি দেয়।’

 

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.