‘৩০ মিনিট বাসের জানালা দিয়া গলা পর্যন্ত পানিতে মাথা ভাসাইয়া রাখছিলাম’

0
147
দুর্ঘটনায় আহত আবদুল জলিল আকন ঝালকাঠি সদর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। রোববার সকালে

‘৩০ মিনিট বাসের জানালা দিয়া গলা পর্যন্ত পুকুরের পানিতে মাথা ভাসাইয়া রাখছিলাম, হেয়ার কিছুক্ষণ পর নাকেমুখে পানি ঢুইকা দম বন্ধ হওয়ার উপক্রম, ঠিক হেই সময় ক্যাডা জানি আমার পা ধাইরা টাইন্না ওপরে তুইল্লা আনছে। আল্লাহ আমার জানডারে ভিক্ষা দিছে।’ এসব কথা বলেন ঝালকাঠিতে যাত্রীবাহী বাস পুকুরে পড়ে ভয়াবহ দুর্ঘটনা থেকে প্রাণে বেঁচে যাওয়া ব্যক্তি আবদুল জলিল আকন (৬০)।

আবদুল জলিল আকন বর্তমানে ঝালকাঠি সদর হাসপাতালের দ্বিতীয় তলায় চিকিৎসাধীন। তিনি দুর্ঘটনায় বুকে প্রচণ্ড আঘাত পেয়েছেন। শরীরে প্রচণ্ড ব্যথাও অনুভব করছেন। তাঁর চোখেমুখে অজানা আতঙ্ক। দুর্ঘটনার ভয়াবহ স্মৃতি তাঁকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। তিনি ৩০ বছর ধরে বরিশালের ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান অপসোনিনের মেশিন অপারেটরের কাজ করেন। প্রতিদিন রাজাপুরের বাড়ি থেকে বরিশালে যাওয়া-আসা করেন। তিনি উপজেলার পটুয়াখালী গ্রামের মৃত মোমেন উদ্দিনের ছেলে। এ ঘটনায় তাঁর সঙ্গে থাকা স্ত্রী মিনারা বেগমও (৫০) আহত হয়ে একই হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।

আজ রোববার সকালে হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, আবদুল জলিল ও তাঁর স্ত্রীর সেবায় ব্যস্ত তাঁদের দুই ছেলে, দুই ছেলের স্ত্রী ও নাতিরা। তাঁদের ভাষ্য, আল্লাহ তাঁদের প্রাণ ভিক্ষা দিয়েছে। তাঁদের আর কিছু চাওয়ার নেই।

হাসপাতালে আলাপকালে আবদুল জলিল বলেন, তিনি স্ত্রীসহ সকাল ৯টার দিকে রাজাপুরের বাইপাস এলাকা থেকে ‘বাশার স্মৃতি’ নামের বাসে ওঠেন। কর্মস্থলে যাওয়ার পাশাপাশি বরিশালে স্ত্রীকে নিয়ে চিকিৎসকের কাছে যাওয়ার কথা ছিল। তিনি চালকের এক আসন পেছনে বসেন। আর স্ত্রী মিনারা বেগম ইঞ্জিনের ওপরের আসনে বসেন। সে সময় বাসে প্রচণ্ড ভিড় থাকা সত্ত্বেও চালক আরও যাত্রীর অপেক্ষায় বাসটি দাঁড় করিয়ে রাখেন। চালক সাড়ে ৯টার দিকে কানায় কানায় পূর্ণ অবস্থায় বাসটি ছাড়ার পর কিছু দূর যেতেই এক নারী বাচ্চাসহ বাসে ওঠেন। তিনি (জলিল) তাঁকে আসন ছেড়ে দেন। দুর্ঘটনার আগপর্যন্ত বাসে ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে ছিলেন তিনি। কিন্তু আফসোস, সেই নারী তাঁর বাচ্চাসহ দুর্ঘটনায় মারা যান।

চালক যাত্রার শুরু থেকেই গাড়িতে যাত্রী ওঠানোর জন্য বারবার সুপারভাইজারের সঙ্গে কথা বলছিলেন বলে জানান আবদুল জলিল। তিনি বলেন, গাড়ি চালনায় চালকের মনোযোগ ছিল না। সেই সঙ্গে চালক বেপরোয়া গতিতে গাড়িটি চলাচ্ছিলেন। হঠাৎ কোনো কারণ ছাড়াই ছত্রকান্দা এলাকার ধানসিঁড়ি ইউনিয়ন পরিষদের কাছে এসে চালক গাড়িটি পুকুরের মধ্যে নামিয়ে দেন।

আবদুল জলিল বলেন, ‘আমি মৃত্যুর দুয়ার দিয়া ফিইররা আইছি। মনে অয়, মোরে ফায়ার সার্ভিসের কেউ টাইন্না তোলছে। হেয়ার পর হাসপাতালে আইয়া মোর হুঁশ অইছে। মোর স্ত্রীকে ঘটনার সাড়ে তিন ঘণ্টা পরে হাসপাতালে খুঁইজ্যা পাইছি। যারা মইরা গ্যাছে, হেগো পক্ষে মুই এই ঘটনার বিচার চাই।’

ঝালকাঠি সদর হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, এ দুর্ঘটনায় আহত হয়ে ঝালকাঠি সদর হাসপাতালে ৩৪ জন ভর্তি ছিলেন। এঁদের মধ্যে গতকাল রাতেই আংশিক সুস্থ হয়ে ২৫ জন বাড়িতে চলে গেছেন। দুজনকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বরিশালের শের-ই–বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। বর্তমানে ভর্তি আছেন সাতজন।

হাসপাতালের জরুরি বিভাগের চিকিৎসা কর্মকর্তা দ্বীন মোহম্মদ বলেন, গতকাল রাতে অনেকটা সুস্থ বোধ করায় ২৫ জন বাড়িতে চলে গেছেন। বর্তমানে সাতজন ভর্তি আছেন। তাঁদের সুচিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। তবে অনেকের মধ্যে ঘটনার দুঃসহ স্মৃতির কারণে মানসিক আতঙ্ক কাজ করছে।

গতকাল শনিবার সকালে ঝালকাঠিতে ৪০ আসনের যাত্রীবাহী বাস ‘বাশার স্মৃতি’ ৬৫ জন যাত্রী নিয়ে পিরোজপুরের ভান্ডারিয়া থেকে বরিশালের দিকে যাচ্ছিল। বাসটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ঝালকাঠি সদর উপজেলার ছত্রকান্দা নামে এলাকার ধানসিঁড়ি ইউনিয়ন পরিষদ-সংলগ্ন একটি পুকুরে পড়ে যায়। এতে ১৭ জন নিহত হন, আর আহত হন ৩৪ জন। গতকাল বিকেলের মধ্যে নিহত ১৭ জনের স্বজনেরা ময়নাতদন্ত ছাড়াই লাশ বাড়িতে নিয়ে দাফন করেন।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.