সরছে ধ্বংসস্তূপ, এ সপ্তাহেই বসার স্বপ্ন ব্যবসায়ীদের

বঙ্গবাজারে আগুন

0
100
বঙ্গবাজারে আগুন

ট্রাকে করে সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে পোড়া টিন, রডসহ জিনিসপত্র। ধ্বংসস্তূপ সরিয়ে বঙ্গবাজারে শিগগির নতুন করে ব্যবসা শুরু করতে চান ক্ষতিগ্রস্তরা। তাঁদের আশা, অস্থায়ী ঘর তৈরি করে এ সপ্তাহ থেকেই বসতে পারবেন। ঘুরে দাঁড়াতে সরকারের আর্থিক সহায়তাও চান তাঁরা। অগ্নিকাণ্ডের চতুর্থ দিন গতকাল শুক্রবারও ক্ষতিগ্রস্ত অনেক ব্যবাসায়ী সেখানে আহাজারি করছিলেন। কেউ কেউ বাকির খাতা খুঁজছেন।

গতকাল সকালে সেখানে গিয়ে দেখা যায়, ধ্বংসস্তূপ সরিয়ে নেওয়ার কাজ শুরু হয়েছে। এদিকে প্রায় ৭৫ ঘণ্টা পর সকাল সাড়ে ৯টায় আনুষ্ঠানিকভাবে অগ্নিনির্বাপণ কাজ সমাপ্ত ঘোষণা করেছে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স। অগ্নিকাণ্ডের দিন ফায়ার সার্ভিসের সদরদপ্তরে হামলার ঘটনায় আরও একটি মামলা হয়েছে। ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে মামলাটি করা হয়। এর আগে একই ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে বংশাল থানায় অচেনা ২৫০-৩০০ জনকে আসামি করে মামলা করে। হামলার ঘটনায় বৃহস্পতিবার রাতে আরও সাতজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। তাদের মধ্যে পাঁচজনকে গতকাল রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে। এর আগে বুধবার গ্রেপ্তার তিনজনকে বৃহস্পতিবার রিমান্ডে নেওয়া হয়।

জানা যায়, পোড়া জিনিসপত্র ৪০ লাখ টাকায় বিক্রি করেছেন ব্যবসায়ী নেতারা। এই টাকা ব্যবসায়ীদের যৌথ হিসাব নম্বরে জমা হবে। ঢাকার বঙ্গবাজার মার্কেটসহ চারটি মার্কেটের সমন্বয়ে বঙ্গবাজার কমপ্লেক্স। গত মঙ্গলবার ভোরের আগুনে চারটি মার্কেটের সব দোকান ও গুদামঘর পুড়ে ছাই হয়েছে। পাঁচ হাজারের বেশি দোকান ও গুদামঘর ছিল সেখানে। বঙ্গবাজার কমপ্লেক্স ছিল তিনতলা।

অস্থায়ী দোকান ক্ষতিগ্রস্ত সব ব্যবসায়ী পাবেন কিনা, তা নিয়ে সংশয় তৈরি হয়েছে। তবে ব্যবসায়ী নেতারা বলছেন, ঈদের আগে সবাইকে ব্যবসা করার সুযোগ করে দিতে চান তাঁরা। প্রয়োজনে ছোট করে দোকান ঘর তৈরি করা হবে, যাতে সব ব্যবসায়ী বসার সুযোগ পান।

বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সের দোকান মালিক সমিতির সহসভাপতি আব্দুর রহমান বলেন, তিন-চার দিনের মধ্যে অস্থায়ীভাবে দোকান করা হবে। ব্যবসায়ীরা ঈদের আগে সেখানে ব্যবসা করতে পারবেন। সব ব্যবসায়ী যাতে দোকান পান, সে চেষ্টা করা হচ্ছে। এ নিয়ে রোববার ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে বৈঠক করার কথা। বঙ্গবাজার মার্কেটের ব্যবসায়ী সমিতির ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক জহিরুল ইসলাম বলেন, চারটি মার্কেটের ২৯৬১ ব্যবসায়ীর তালিকা করা হয়েছে। পাঁচ হাজারের বেশি দোকান ও গুদাম হলেও সেগুলোর মালিক ২৯৬১ জন। অনেকের একাধিক দোকান ছিল। জায়গা কম হলেও সমন্বয় করে তাঁবু দিয়ে ছোট ছোট দোকান করা হবে, যাতে সবাই বসতে পারেন।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মুখপাত্র আবু নাসের বলেন, রোববার বিকেলে মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস, প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, সংসদ সদস্য রাশেদ খান মেনন এবং দোকান মালিক সমিতির নেতাদের নিয়ে বৈঠক হবে। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে বৈঠকে ২৯৬১ দোকান মালিকের তালিকা উপস্থাপন করা হবে। কীভাবে অস্থায়ীভাবে ব্যবসায়ীদের বঙ্গবাজারে বসানো যায়, তা নিয়ে আলোচনা করা হবে। তিনি জানান, আগামী বুধবার থেকে ব্যবসায়ীরা সেখানে অস্থায়ীভাবে ব্যবসা শুরু করতে পারবেন।

অস্থায়ীভাবে দোকানঘরের ব্যবস্থা করে দিলেও নিঃস্ব হওয়ায় বেশিরভাগ ব্যবসায়ী নতুন করে পণ্য তুলতে পারবেন না। তাঁরা সরকারের কাছে আর্থিক সহায়তার দাবি করেছেন। তাঁদের দাবি, চলতি সপ্তাহে বসার সুযোগ করে দেওয়া হোক। ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ী রুহুল আমিনের ২ কোটি টাকার বেশি মালপত্র পুড়েছে। এখন সংসার চালানোর মতো সামর্থ্যই নেই তাঁর। তিনি বলেন, ‘সংসার চালানোর জন্য মানুষের কাছে হাতও পাততে পারব না। বাঁচতে হলে তো ব্যবসা শুরু করতে হবে। সরকার আর্থিক সহায়তা করলে ব্যবসা শুরু করতে সহজ হবে।’ আদর্শ মার্কেটের ব্যবসায়ী মো. তারেকের ১১ লাখ টাকার জিন্স প্যান্ট পুড়েছে। তিনি বলেন, ‘দোকান করার পাশাপাশি সরকারের পক্ষ থেকে কিছু মূলধন দেওয়া হলে ব্যবসা শুরু করতে পারব। সঞ্চিত কোনো টাকা নেই যে, তা দিয়ে পণ্য কিনে দোকানে তুলব।’

ব্যবসায়ী মিজানুর রহমান জানান, বঙ্গবাজারের ১৯৯৬, ১৯৯৭ ১৯৯৮ নম্বর দোকান ছিল তাঁর। শাড়ি, থ্রিপিস ও জাকাতের কাপড় বিক্রি করতেন। সবকিছু পুড়ে গেছে। তিনি বলেন, ‘আমি সর্বস্বান্ত। পরিবার নিয়ে বাঁচতে চাই। সরকার সেই ব্যবস্থা করে দিক। আবার ঘুরে দাঁড়াতে চাই।’

দোকান ও মালপত্রের পাশাপাশি ব্যবসায়ীদের ব্যাংকের চেক বই, ট্রেড লাইসেন্সসহ প্রয়োজনীয় কাগজপত্রও পুড়ে গেছে। এ ছাড়া অনেক ব্যবসায়ীর ইন্স্যুরেন্স করা আছে। এসব কারণে সংশ্লিষ্ট থানায় সাধারণ ডায়েরি করছেন ব্যবসায়ীরা। তাঁদের সুবিধার্থে শাহবাগ থানা পুলিশ ঘটনাস্থলের পাশে অস্থায়ী বুথ স্থাপন করেছেন। সেখানে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীরা জিডি করছেন। শাহবাগ থানার ওসি নূর মোহাম্মদ জানান, গতকাল বিকেল পর্যন্ত অন্তত দেড়শ ব্যবসায়ী জিডি করেছেন।

ক্ষতিগ্রস্ত যেসব ব্যবসায়ীর ব্যাংক ঋণ এবং ইন্স্যুরেন্স করা আছে তাঁদের তালিকা করা শুরু হয়েছে গতকাল। সংশ্লিষ্ট ব্যাংক এবং ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির পক্ষ থেকে জরিপ করা হচ্ছে। বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স সার্ভেয়ার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক সোহেল আহমেদ বলেন, অনেক ব্যবসায়ীর বীমা করা আছে। বীমা করা সম্পত্তির ক্ষয়ক্ষতির বিষয়ে জরিপ করা হচ্ছে।

আরও একটি মামলা, পাঁচজন রিমান্ডে: বংশাল থানার ওসি মজিবুর রহমান জানান, অগ্নিকাণ্ডের দিন সকালে ফায়ার সার্ভিসের সদরদপ্তরে হামলা ও ভাঙচুর এবং পুলিশের কাজে বাধা দেওয়ার অভিযোগে এ পর্যন্ত দুটি মামলা হয়েছে। এতে ১০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাদের মধ্যে আটজনকে রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে।

বৃহস্পতিবার রাতে ফায়ার সার্ভিসের সিনিয়র স্টেশন অফিসার শাহিন আলম বাদী হয়ে অচেনা ৩০০ জনকে আসামি করে মামলা করেন। এজাহারে বলা হয়েছে, মঙ্গলবার বঙ্গবাজারে অগ্নিনির্বাপণের সময় সকাল সাড়ে ৯টার দিকে ২৫০-৩০০ জন বেআইনিভাবে রড ও লাঠিসোটা নিয়ে ফায়ার সার্ভিসের সদরদপ্তরে হামলা করে। কর্মীদের মারধর করে তারা। সাতজন আহত হন। ইটপাটকেল ছোড়ে হামলাকারীরা। ফায়ার সার্ভিসের বিভিন্ন মডেলের ১৪টি গাড়ি ভাঙচুর করা হয়। এ ছাড়া অভ্যর্থনা কক্ষ, প্রশাসনিক ভবন ও সিনিয়র স্টেশন অফিসারের অফিস ভাঙচুর করে।

অগ্নিনির্বাপণ সমাপ্তি ঘোষণা: মঙ্গলবার ভোর ৬টার দিকে বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সের আদর্শ মার্কেটে আগুন লাগে। মুহূর্তের মধ্যে বঙ্গবাজার, গুলিস্তান ও মহানগর মার্কেটে আগুন ছড়িয়ে পড়ে। পাশের এনেক্সো টাওয়ার, মহানগর শপিং কমপ্লেক্স, বঙ্গ ইসলামিয়া সুপার মার্কেট ও বরিশাল প্লাজার আংশিক পুড়ে যায়। পর্যায়ক্রমে ফায়ার সার্ভিসের ৫০টি ইউনিট ঘটনাস্থলে এসে আগুন নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চালায়। দুপুর ১২টা ৩৬ মিনিটে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। এর পরও ধ্বংসস্তূপে বিভিন্ন স্থানে আগুন জ্বলতে থাকে। সাড়ে ৭৫ ঘণ্টা পর গতকাল সকাল সাড়ে ৯টায় ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে অগ্নিনির্বাপণ সমাপ্তি ঘোষণা করা হয়। ফায়ার সার্ভিসের উপসহকারী পরিচালক শাহজাহান সিকদার বলেন, সব প্রক্রিয়া শেষ করে অগ্নিনির্বাপণ সম্পন্ন ঘোষণা হয়েছে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.