রূপপুরে পারমাণবিক জ্বালানি হস্তান্তর আজ

0
95
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের কুলিং টাওয়ার। গতকাল ঈশ্বরদীর পাকশীতে

পারমাণবিক শক্তি ব্যবহারের স্বপ্নটা শুরু হয় ১৯৬১ সালে। জমি অধিগ্রহণের কয়েক বছর পর প্রকল্পটি বাতিল করে দেয় তৎকালীন পাকিস্তান সরকার। স্বাধীন দেশে আবার স্বপ্ন দেখা শুরু। এরপর দীর্ঘ অপেক্ষা। বিশ্বের স্বীকৃতি, আন্তর্জাতিক সব সনদ অর্জনের মধ্য দিয়ে রূপপুরে বিদ্যুৎকেন্দ্রের কাঠামো তৈরি প্রায় শেষের দিকে। চলে এসেছে পারমাণবিক জ্বালানিও। এখন পারমাণবিক শক্তি ব্যবহারকারী দেশের তালিকায় ৩৩তম সদস্য হচ্ছে বাংলাদেশ।

রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের জ্বালানি আজ বৃহস্পতিবার আনুষ্ঠানিকভাবে হস্তান্তর অনুষ্ঠান উদ্বোধন করা হবে। এ উপলক্ষে রূপপুরে প্রকল্প এলাকায় এখন সাজ সাজ রব।

বার্তা সংস্থা বাসস জানিয়েছে, অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের অনলাইনে যোগ দেওয়ার কথা রয়েছে।

তবে কয়লা বা জ্বালানি তেলের মতো পারমাণবিক জ্বালানি আসার সঙ্গে সঙ্গেই বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু করা যায় না। চুল্লিপাত্রে জ্বালানি প্রবেশ করানোর আগে আরও কয়েকটি ধাপ বাকি আছে। প্রতিটি ধাপে আন্তর্জাতিক মান বজায় রাখতে হবে। দফায় দফায় অনুমতিও নিতে হবে আন্তর্জাতিক সংস্থার।

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা বলছেন, পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরি হলেও পারমাণবিক শক্তি ছিল না। এখন পারমাণবিক শক্তির মালিকানা হাতে আসছে। আজ এটি হস্তান্তরের মধ্য দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে পারমাণবিক শক্তির অধিকারী হবে বাংলাদেশ। অনুষ্ঠানে পারমাণবিক জ্বালানির একটি নমুনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিমন্ত্রী ইয়াফেস ওসমানের হাতে হস্তান্তর করবেন রুশ পরমাণু শক্তি করপোরেশন রোসাটমের মহাপরিচালক আলেক্সি লিখাচেভ।

আগামী ২০২৫ সালের শুরুতে রূপপুর থেকে বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে। দেশের জিডিপিতে ২ শতাংশ অবদান রাখবে রূপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্র।

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিমন্ত্রী ইয়াফেস ওসমান

তবে কয়লা বা জ্বালানি তেলের মতো পারমাণবিক জ্বালানি আসার সঙ্গে সঙ্গেই বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু করা যায় না। চুল্লিপাত্রে জ্বালানি প্রবেশ করানোর আগে আরও কয়েকটি ধাপ বাকি আছে। প্রতিটি ধাপে আন্তর্জাতিক মান বজায় রাখতে হবে। দফায় দফায় অনুমতিও নিতে হবে আন্তর্জাতিক সংস্থার। সব ধাপ শেষ করে আগামী বছরের ডিসেম্বরে রূপপুরের প্রথম ইউনিটে পরীক্ষামূলক বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হতে পারে।

গতকাল বুধবার পাবনার রূপপুর প্রকল্প এলাকা পরিদর্শনের সময় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিমন্ত্রী ইয়াফেস ওসমান সাংবাদিকদের বলেন, আগামী ২০২৫ সালের শুরুতে রূপপুর থেকে বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে। দেশের জিডিপিতে ২ শতাংশ অবদান রাখবে রূপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্র।

এ সময় রূপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রকল্প পরিচালক শৌকত আকবর বলেন, পারমাণবিক জ্বালানি প্রকল্প এলাকায় আসার পরই এটি পারমাণবিক স্থাপনা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। আনুষ্ঠানিক হস্তান্তরের মধ্য দিয়ে পারমাণবিক ক্লাবের ৩৩তম সদস্য হতে যাচ্ছে বাংলাদেশ।

ওয়ার্ল্ড নিউক্লিয়ার অ্যাসোসিয়েশনের ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, পারমাণবিক শক্তি ব্যবহারকারী দেশের মধ্যে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ফ্রান্স, রাশিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া, কানাডা, ইউক্রেন, জার্মানি, জাপান, স্পেন, সুইডেন, বেলজিয়াম, যুক্তরাজ্য, ভারত, চেক প্রজাতন্ত্র, ফিনল্যান্ড, সুইজারল্যান্ড, বুলগেরিয়া, পাকিস্তান, হাঙ্গেরি, স্লোভাকিয়া, ব্রাজিল, দক্ষিণ আফ্রিকা, মেক্সিকো, রোমানিয়া, আর্জেন্টিনা, সংযুক্ত আরব আমিরাত, বেলারুশ, স্লোভেনিয়া, নেদারল্যান্ডস, ইরান ও আর্মেনিয়া।

গত ২৮ সেপ্টেম্বর আকাশপথে রাশিয়া থেকে ঢাকায় পৌঁছায় পারমাণবিক জ্বালানি। এরপর বিশেষ নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে সড়কপথে এটি রূপপুরে নিয়ে যাওয়া হয়। এখনই জ্বালানি ব্যবহার করা হবে না, এটি মজুত করে রাখা হয়েছে রূপপুরে।

সরেজমিন রূপপুর

প্রকল্পের আবাসিক এলাকা ‘গ্রিন সিটি’র সীমানাপ্রাচীরে দৃষ্টিনন্দন গ্রাফিতি আঁকা হয়েছে। এতে বাংলাদেশি ও রুশ বন্ধুত্বে বদলে যাওয়া এক জনপদের গল্প ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। শোভা পাচ্ছে দেশীয় সংস্কৃতি, বাংলাদেশ-রাশিয়ার সম্পর্ক এবং বিভিন্ন শিক্ষণীয় বিষয়। আছে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধ, রূপপুর প্রকল্পের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস, ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ, ভালোবাসার রূপপুর, ঐতিহ্যবাহী হার্ডিঞ্জ ব্রিজ, লালন শাহ সেতু ও বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অর্জনসহ নানা অঙ্কন। ফুটিয়ে তোলা হয়েছে বাংলাদেশের ফুল, পাখি, সূর্য ও আবহমান বাংলার নানা সংস্কৃতি। প্রকল্প এলাকা সাজানো হয়েছে বাংলাদেশ-রাশিয়ার পতাকা ও বিভিন্ন ফেস্টুন ব্যানারে। সব মিলিয়ে রূপপুরজুড়ে এখন সাজ সাজ রব।

শান্তিপূর্ণ ব্যবহারে নজরদারি

চুক্তি অনুসারে প্রকল্প খরচের মধ্যেই আগামী তিন বছর রাশিয়া থেকে আসবে এ জ্বালানি। পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে ২৪ ঘণ্টা সমান হারে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে। প্রতি দেড় বছর পর নতুন জ্বালানি দিতে হবে। জ্বালানি বর্জ্য বের করা, নতুন জ্বালানি ঢোকানো ও রক্ষণাবেক্ষণ মিলে একটি ইউনিট সর্বোচ্চ দুই মাস বন্ধ থাকতে পারে।

বিদ্যুৎ উৎপাদন ছাড়া এ জ্বালানি অন্য কোনো খাতে ব্যবহার করা হবে না। পারমাণবিকের শান্তিপূর্ণ ব্যবহারের বিষয়ে লিখিত অঙ্গীকারনামা আগেই নিশ্চিত করেছে বাংলাদেশ। বিষয়টি জাতিসংঘের সহযোগী সংস্থা আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থার (আইএইএ) নজরদারিতে থাকবে।

গত ২৮ সেপ্টেম্বর আকাশপথে রাশিয়া থেকে ঢাকায় পৌঁছায় পারমাণবিক জ্বালানি। এরপর বিশেষ নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে সড়কপথে এটি রূপপুরে নিয়ে যাওয়া হয়। এখনই জ্বালানি ব্যবহার করা হবে না, এটি মজুত করে রাখা হয়েছে রূপপুরে।

বড় প্রকল্পের বড় অগ্রগতি

রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন পরমাণু শক্তি কমিশন। এ প্রকল্পের আওতায় ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াটের দুটি ইউনিট নির্মাণ করছে রাশিয়ার ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান অ্যাটমস্ট্রয়এক্সপোর্ট। পারমাণবিক জ্বালানি উৎপাদন করছে রোসাটমের সহযোগী প্রতিষ্ঠান টিভিইএল ফুয়েল কোম্পানি। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ তাদের থেকে পারমাণবিক জ্বালানি কেনে।

দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় একক প্রকল্প রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র। খরচ হচ্ছে প্রায় ১ লাখ ১৪ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে সরকার দিচ্ছে ২২ হাজার ৫২ কোটি ৯১ লাখ ২৭ হাজার টাকা। আর রাশিয়া থেকে ঋণসহায়তা হিসেবে আসছে ৯১ হাজার ৪০ কোটি টাকা। ২০২১ সালের অক্টোবরে রূপপুরে ইউনিট-১–এর ভৌত কাঠামোর ভেতরে চুল্লিপাত্র স্থাপনের মধ্য দিয়ে এই ইউনিটের কাজ প্রায় শেষ হয়েছে বলা যায়। চুল্লিপাত্র হচ্ছে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের মূল যন্ত্র। এই যন্ত্রের মধ্যেই পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের জ্বালানি হিসেবে ইউরেনিয়াম ভরা হয়। গত বছরের অক্টোবরে বসানো হয় দ্বিতীয় ইউনিটের চুল্লিপাত্র।

মহিউদ্দিন ও
সরোয়ার মোর্শে​দ

ঢাকা ও পাবনা

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.