রাজনীতির ছায়া যুদ্ধ

0
110

রংপুরের তারাগঞ্জ উপজেলা ছাত্রলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক পীযূষ সরকার ফেসবুকে ৬ আগস্ট একটি সংবাদের স্ক্রিনশট শেয়ার করেন। খবরের শিরোনাম ‘বিএনপির সমাবেশে ভাড়াটে কর্মী, রেট পুরুষ ৪০০, নারী ৬০০’। তবে এই শিরোনামে আদতে কোনো খবর প্রকাশিত হয়নি। ৪ আগস্ট একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত খবরের শিরোনাম ছিল ‘সভা-সমাবেশে ভাড়াটে কর্মী, রেট পুরুষ ৪০০, নারী ৬০০’।

পীযূষ সরকার জানান, ‘ট্রল বিএনপি’ নামে ফেসবুক পেজে স্ক্রিনশটটি পেয়ে অনেকের মতো তিনিও শেয়ার করেন। পরে জানতে পারেন, ফটোশপের মাধ্যমে ‘সভা’র বদলে ‘বিএনপি’ শব্দ জুড়ে দেওয়া হয়েছে। স্ক্রিনশটটি মিথ্যা তথ্যে বানানো জেনেও গতকাল পর্যন্ত ফেসবুক থেকে তা সরাননি তিনি। তাঁর ভাষ্য, বিএনপিকে বিদ্রুপ তথা ট্রল করতে পোস্ট করেছেন। এতে দোষের কিছু নেই।

গত ২৯ জুলাই ঢাকার প্রবেশমুখে বিএনপির অবস্থান কর্মসূচিতে সংঘর্ষের পর মো. রহমান মাসুদ নামে একজন ফেসবুকে একটি ফটোকার্ড শেয়ার করেন। যাতে লেখা, ‘ফাঁকা বাস নিয়ে এসে আগুন ধরিয়েছে ছাত্রলীগ’। তথ্যসূত্র হিসেবে দুটি সংবাদমাধ্যমের নাম জুড়ে দেন। তবে ওই দুটি সংবাদমাধ্যম এ খবর প্রকাশ করেনি। যুক্তরাষ্ট্রের নিউজার্সির পিটারসনে বাস করা রহমান মাসুদের ফেসবুক ফলোয়ার সংখ্যা প্রায় সাড়ে ৩ লাখ। তাঁর সঙ্গে কথা বলতে পারেনি। ফ্যাক্ট চেকিংয়ে রহমান মাসুদের পোস্ট মিথ্যা প্রমাণ হয়েছে।

নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসছে, গুজব ছড়ানো তত বাড়ছে। সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবর এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়ানো তথ্যের সত্যতা যাচাই করে রিউমর স্ক্যানার নামে একটি প্রতিষ্ঠান। ২০২২ সালে সংস্থাটি ১ হাজার ৪০০ গুজব চিহ্নিত করে। এর মধ্যে ধর্মবিষয়ক গুজব ছিল ২০৬টি। রাজনীতিবিষয়ক গুজব ছিল ৯২টি। রিউমর স্ক্যানারের হেড অব ফ্যাক্ট চেকিং অপারেশন সাজ্জাদ হোসাইন চৌধুরী বলেছেন, গুজব ও মিথ্যা তথ্য প্রায় সব রাজনৈতিক দলের সমর্থকরা তৈরি করে এবং ছড়ায়। দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মৃত্যুর পর ছড়ানো ১৩টি গুজব চিহ্নিত করা হয়েছে। সাঈদীর সমর্থক এবং সমালোচক উভয়পক্ষই তা ছড়িয়েছে।

৩ আগস্ট থেকে গত ১৫ দিনে রাজনৈতিক দল এবং তাদের সমর্থকদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের পেজ ও অ্যাকাউন্ট বিশ্লেষণ করেছে। দলগুলোর ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজ এবং এক্স (সাবেক টুইটার) হ্যান্ডল থেকে খুব বেশি মিথ্যা তথ্য ছড়ানো হয় না। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে হেয় ও ঘায়েল করার মিথ্যা তথ্য ছড়ানো হয় সমর্থকদের পেজ এবং হ্যান্ডল থেকে। ট্রলের নামে গালাগাল করা ও হুমকি দেওয়া হয়। নিজের পক্ষে বয়ান বা ন্যারেটিভ তৈরিতে রয়েছে ‘বট’ (রোবটের সংক্ষিপ্ত রূপ)। অর্থাৎ কৃত্রিম ও যান্ত্রিক ‘বট’ দিয়ে তৈরি লাখ লাখ কমেন্ট করানো হয়, যাতে বার্তাটি ভাইরাল হয়। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ ও ঘৃণা ছড়ানো হয়। নারীনেত্রীরা বেশি ট্রলের শিকার হন।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অপতথ্য ছড়িয়ে নির্বাচন প্রভাবিত করার অভিযোগ পশ্চিমা দুনিয়ায় গত এক যুগ ধরে উঠছে। বাংলাদেশেও এই লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। ভোটের বছরে অনলাইন তৎপরতা ও অপতৎপতা দুই-ই বাড়ছে। ভোটের সময় গুজব ও বিদ্বেষমূলক বক্তব্য ঠেকাতে নির্বাচন কমিশন সম্প্রতি ফেসবুকের স্বত্বাধিকারী প্রতিষ্ঠান মেটার সঙ্গে বৈঠক করেছে। মেটা জানিয়েছে, ক্ষতিকর তথ্য প্রতিরোধে তারা সচেষ্ট।

ভারত হয়ে বাংলাদেশে ভোটের রাজনীতিতে নিজের পক্ষে ন্যারেটিভ তৈরিতে অনলাইন প্রচার ভারতে এক যুগ আগে বিজেপির মাধ্যমে শুরু হয়।

বাকি দলগুলো পরে এই লড়াইয়ে কোমর বেঁধে নেমেছে। দলগুলোর ‘আইটি সেল’ কুখ্যাত ‘ট্রল আর্মি’ এই লড়াইয়ের যোদ্ধা। তারা প্রতিপক্ষকে হেয় করতে ভুয়া খবর ও বয়ান প্রচারে দক্ষ। ২০১৭ সালে রাজস্থানে কর্মী সমাবেশে বিজেপির তৎকালীন সভাপতি অমিত শাহ গর্বের সঙ্গে ঘোষণা করেছিলেন, ‘সত্যিই হোক বা ফেক, জেনে রাখবেন, যে কোনো মেসেজকে আমরা নিমেষে ভাইরাল করার ক্ষমতা রাখি।’

২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে উত্তরপ্রদেশের বিধান সভা নির্বাচনের আগে গুজব ছড়ানো হয়, বিজেপির প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী অখিলেশ যাদব তাঁর বাবা মুলায়ম সিং যাদবকে চড় মেরেছেন। অথচ সে সময় অখিলেশ ছিলেন লক্ষ্ণৌ শহরে। মুলায়ম সিং ছিলেন সাড়ে ৫০০ কিলোমিটার দূরের দিল্লিতে। ঘটনা না ঘটলেও বিজেপির আইটি সেলের দুটি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপের মাধ্যমে তা ৩২ লাখ মানুষের কাছে নিমেষে পৌঁছে যায়। তারা তা ফরোয়ার্ড করে কোটি কোটি মানুষের কাছে। গুজবটি ভোটে প্রভাব ফেলে।

বাংলাদেশে কার কী অবস্থা

রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অনলাইনে এগিয়ে টানা ১৫ বছর ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ। ডিজিটাল বাংলাদেশের পর স্মার্ট বাংলাদেশের অঙ্গীকার করা দলটির অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ ২০১৩ সালের ৩০ আগস্ট খোলা হয়। এখন ফলোয়ার ৩৩ লাখ। আওয়ামী লীগ টুইটারে এসেছে ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে। পৌনে সাত লাখ ব্যবহারকারী টুইটারে অনুসরণ করে এ দলকে। ছাত্রলীগ, যুবলীগসহ আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠনগুলো সমান সক্রিয় অনলাইন দুনিয়ায়।

আওয়ামী লীগের অর্ধযুগ পরে ২০১৯ সালের ১৩ জুন অফিসিয়াল ফেসবুক খোলে বিএনপি। ফেসবুকে বিএনপির ফলোয়ার ২১ লাখ। বিএনপি টুইটারে এসেছে পরের বছর। মাত্র ৩০ হাজার অনুসারী রয়েছে। ২০১৩ সালের ২ জুলাই ফেসবুক পেজ খোলা বিএনপির মিডিয়া সেলের অনুসারী ২৩ লাখ। বছর দুয়েক ধরে এই পেজটি খুব সক্রিয়। মূলধারার টেলিভিশন চ্যানেলে বিএনপির কর্মসূচি খুব বেশি সরাসরি সম্প্রচার করা হয় না। মিডিয়া সেলের পেজ এ কাজটি করে থাকে।

মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জেরে প্রকাশ্য রাজনীতিতে কোণঠাসা জামায়াতে ইসলামীর অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ ২০১৪ সালের ২০ জুন চালু হয়। এই দলটির ফলোয়ার ২০ লাখ। আদালতের রায়ে নিবন্ধন হারানো জামায়াতের টুইটারে ফলোয়ার ৮২ হাজারের বেশি।

সংসদে বিরোধী দল জাতীয় পার্টি (জাপা) ফেসবুক বা টুইটার– কোথাও নেই। দলের চেয়ারম্যান জি এম কাদেরের ভেরিফায়েড ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থাকলেও অনলাইনে দলটি নিষ্ক্রিয়। চরমোনাই পীরের নেতৃত্বাধীন ইসলামী আন্দোলনকে ১১ লাখ ব্যবহারকারী ফেসবুকে অনুসরণ করেন। অন্য দলগুলোর মধ্যে শুধু ওয়ার্কার্স পার্টির ভেরিফায়েড পেজ রয়েছে। ফলোয়ারের সংখ্যা ১৭ হাজার। অনিবন্ধিত দলগুলোর মধ্যে এবি পার্টি এবং গণঅধিকার পরিষদ অনলাইনে সরব। বাকিদের তেমন তৎপরতা নেই।

আওয়ামী লীগ ও বিএনপির জ্যেষ্ঠ নেতাদের কয়েকজনের ভেরিফায়েড ফেসবুক অ্যাকাউন্ট রয়েছে। অনুসারীর সংখ্যায় সবচেয়ে এগিয়ে প্রধানমন্ত্রীর তথ্যপ্রযুক্তি উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়। তাঁকে ৩১ লাখ ফেসবুক ব্যবহারকারী অনুসরণ করেন। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের ফলোয়ার ২০ লাখ। তারা দু’জনই সোশ্যাল মিডিয়ায় নিজ দলের প্রচার এবং প্রতিপক্ষের সমালোচনায় সক্রিয়।

বাঁশের চেয়ে কঞ্চি শক্ত

আওয়ামী লীগ, বিএনপির ভেরিফায়েড পেজ এবং দলীয় নেতাদের অফিসিয়াল ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে প্রতিপক্ষকে হেয় করার চেষ্টা থাকলেও তা নিয়ন্ত্রিত। অধিকাংশ ক্ষেত্রে মূলধারার সংবাদমাধ্যমের খবরের লিঙ্ক পোস্ট করা হয়, যেগুলোতে প্রতিপক্ষের কর্মকাণ্ডের সমালোচনা রয়েছে।

তবে রাজনৈতিক দলগুলোর সমর্থকদের পেজ এবং ওয়েবসাইটে এসবের বালাই নেই। এতে তথ্য ও খবরের চেয়ে বিষোদ্গার প্রাধান্য পায়। যেমন– ঢাকা টেলিভিশন নামের একটি ওয়েব পোর্টালের হোম পেজে থাকা ১৭টি খবরের সব ক’টি বিএনপির সমালোচনা করে লেখা।

এতে গত ৬ আগস্ট ‘কর্মসূচির নামে বিএনপির সহিংসতা সুষ্ঠু নির্বাচনী পরিবেশ সৃষ্টিতে মারাত্মক হুমকি : মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র ম্যাথিউ মিলার’ শিরোনামে একটি সংবাদ প্রকাশ করা হয়েছে। ফ্যাক্ট চেকাররা নিশ্চিত করেছেন, খবরটি ভুয়া। আওয়ামী লীগের পেজ থেকে এসব খবর প্রচার করা হয় না।

বিপরীতে ‘নাগরিক টিভি’ নামের একটি ওয়েব পোর্টালের প্রতিটি ‘কনটেন্ট’ আওয়ামী লীগের সমালোচনায় ভরা। ওয়েব পোর্টালটির ফেসবুক পেজে অসত্য তথ্যের প্রচারণা বেশি। তারা ‘শূন্য হাতে আওয়ামী লীগের ভারত থেকে ফেরা’ শীর্ষক একটি বিশ্লেষণ প্রচার করেছে। তাতে যেসব দাবি করা হয়েছে, একটিরও তথ্যসূত্র নেই। আওয়ামী লীগ নেতা এবং সরকারের এমপি-মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ করা হয়েছে, সেগুলোরও তথ্যসূত্র ও দালিলিক প্রমাণ নেই।

পৃষ্ঠপোষক কারা, বুস্টের টাকা কে জোগায়

এসব ওয়েব পোর্টালের কনটেন্ট ফেসবুকে ডলার দিয়ে বুস্ট করা হয়। যাতে এই কথিত খবরগুলো বেশি মানুষের কাছে পৌঁছাতে পারে। ‘হাইপার জসিম’ নামে ফেসবুক পেজে বিএনপিকে বিদ্রুপ করে তৈরি করা অ্যানিমেশন পোস্ট করা হয়। সেখানে একটি ফোন নম্বর পাওয়া যায়। নম্বরটি আওয়ামী লীগের ওয়েব টিমের সমন্বয়ক প্রকৌশলী তন্ময় আহমেদের।

তিনি সাইবার দুনিয়ার রাজনীতির ছায়া যুদ্ধ নিয়ে কথা বলেছেন সমকালের সঙ্গে। তন্ময় জানালেন, আওয়ামী লীগের অফিসিয়াল পেজ থেকে সরকারের কার্যক্রম ও সাফল্য, দলের কর্মসূচি, নেতাদের বক্তব্য-বিবৃতি প্রচার করা হয়। আওয়ামী লীগ সমর্থকরা তাদের মতো কাজ করেন। এর সঙ্গে টাকার লেনদেন নেই। স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে কাজ করেন। হাইপার জসিম তেমনই একটি পেজ।

অমিত শাহর বক্তব্যের রেশ ধরে তন্ময় আহমেদের কাছে জানতে চাওয়া হয়, আওয়ামী লীগও কি যে কোনো কনটেন্ট ভাইরাল করতে সক্ষম? তিনি বলেছেন, যে কোনো তথ্য তৃণমূলে পৌঁছে দেওয়ার সক্ষমতা তাদের রয়েছে। বিরোধী দলগুলোর বিরুদ্ধে কনটেন্ট তৈরির বিষয়ে তিনি বলেছেন, দলীয় একটি স্টুডিও রয়েছে। সেখান থেকে সহায়তা দেওয়া হয়। বুস্টের ডলার কে দেয়– প্রশ্নে তিনি বলেছেন, অধিকাংশ পেজ নিজেরাই আয় করছে। তা দিয়ে বুস্ট করতে পারে।

তন্ময় আহমেদ বলেন, দলের অফিসিয়াল পেজ থেকে গুজব ছড়ানোর প্রশ্নই আসে না। তবে বক্তব্যে কিছুটা ‘টুইস্ট’ আনা হয়, যাতে দলের দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে কনটেন্টটি মিলে যায়। তন্ময় আহমেদের দাবি, বিএনপি ও জামায়াত মিথ্যা তথ্য ও গুজব ছড়ায়।

২০২২ সালে গঠিত বিএনপির মিডিয়া সেল সরকারের সমালোচনামূলক কনটেন্ট তৈরি করে। বিএনপির তথ্য ও প্রযুক্তিবিষয়ক সম্পাদক একেএম ওয়াহিদুজ্জামান বলেন, দলের গুরুত্বপূর্ণ পেজ ভেরিফায়েড করা হয়েছে। মূলধারার গণমাধ্যমের পাশাপাশি ‘সাইবার সিটিজেন জার্নালিজম’ অথবা ‘উন্মুক্ত যোগাযোগ’ মাধ্যমে পরিকল্পিতভাবে বিএনপির অবস্থানকে নিশ্চিত করতে কাজ করা হচ্ছে।

জানা গেছে, বিএনপির সঙ্গে দেশ-বিদেশের শতাধিক কনটেন্ট ক্রিয়েটর কাজ করছেন। তারা স্বেচ্ছাসেবী। তারা কর্মসূচি, সংঘর্ষ, হামলার ঘটনা সরাসরি সম্প্রচার ছাড়াও গ্রাফিক্স ডিজাইন এবং ভিডিও সম্পাদনার কাজ করেন। আইনি জটিলতা এড়াতে ‘হেটস্পিচ’ এড়িয়ে ‘ফ্যাক্ট চেক’-এর মাধ্যমে কনটেন্ট তৈরি করে। আওয়ামী লীগের ‘মিম’-এর পাল্টা ‘মিম’ তৈরি করে।

বিএনপির তথ্য ও প্রযুক্তি শাখার কয়েকজন সদস্যের দাবি, সরকার ফেসবুকে ‘রিচ’ কমিয়ে দিলেও তারা কনটেন্ট বুস্ট করেন না। ইউটিউব থেকে যে আয় হয়, তা দিয়ে ড্রোন কেনাসহ অন্যান্য খরচ জোগাড় হয়। অনেক সময় কর্মসূচিতে সদস্যদের মোবাইল ভেঙে ফেলা ও গ্রেপ্তারের ঘটনা ঘটে। তাদের আইনি সহায়তা ও মোবাইল কিনে দেওয়া হয় ওই আয় থেকে। বিএনপির ফেসবুক পেজে মাসে প্রায় ১০ কোটি এবং ইউটিউবে ৪ কোটি ভিউ হয়। এতে আয় হয় প্রায় ২ কোটি টাকা।

আওয়ামী লীগের গবেষণা সংস্থা হিসেবে পরিচিত সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড ইনফরমেশনের (সিআরআই) মাধ্যমেও কাজ করা হয়। সংস্থাটি বুদ্ধিবৃত্তিক কাজ করে। দলটি নির্বাচন উপলক্ষে ৪০ হাজার অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট তৈরির পরিকল্পনার কথা প্রকাশ্যেই জানিয়েছে।

গুজবের ছড়াছড়ি, যুক্ত সব দলই

রিউমর স্ক্যানারের সাজ্জাদ বলেন, আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জামায়াতসহ সব দলের সমর্থকরা গুজব ছড়ানোর কাজ করে। প্রতিষ্ঠিত রাজনীতিবিদরা ভুল তথ্য ছড়ান। নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসছে সরকারবিরোধী গুজব তত বাড়ছে।

ঢাকা-১৭ আসনের এমপি মোহাম্মদ এ আরাফাত গত ২৯ জুলাই টুইটে জ্বলন্ত বাসের ছবি দিয়ে আগুনের জন্য বিএনপিকে দায়ী করেন। তবে এ ছবিগুলো পুরোনো। একটি ছবি ছিল দুর্ঘটনায় আগুন লাগা বাসের। পুলিশের ওপর হামলার ছবি ২০১৫ এবং ২০২২ সালে প্রকাশিত খবরের।

চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে বিএনপি এবং জামায়াতের সমর্থক পেজ গুজব ছড়ানো হয়, ৭২ পুলিশ কর্মকর্তার ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে পদত্যাগ করতে বলেছেন জো বাইডেন। রিউমর স্ক্যানার জানিয়েছে, দুটি গুজবের উৎস ফেসবুক।

গত কয়েক দিনে ফেসবুকে সাঈদী-সংক্রান্ত খবরে সয়লাব। তেমন কয়েকটি খবর হলো সাঈদীর মৃত্যুতে শোক জানিয়ে টুইট করেছেন কাবা শরিফের ইমাম, কাবা শরিফে সাঈদীর নাম ঘোষণা করে জানাজা হয়েছে। জামায়াতের পেজে এসব গুজব প্রচার করা না হলেও শামীম বিন সাঈদীর দাবি, তাঁর বাবার মৃত্যুতে কাবার ইমাম শোক প্রকাশ করেছেন। রিউমর স্ক্যানার জানিয়েছে, এগুলো সবই গুজব। সাজ্জাদ জানান, একাত্তরের রাজাকারদের আটকের ছবি দিয়ে বলা হচ্ছে, সেখানে সাঈদী ছিলেন। এ ছবিটিও ভুয়া।

বুলিং ট্রলিংয়ের হেনস্তা

রাজপথে মারামারি না হলেও অনলাইনের ছায়া যুদ্ধে রাজনৈতিক দলের সমর্থকরা গালাগাল করেন। নারী রাজনীতিকরা যৌন হয়রানির শিকার হন। সাজ্জাদ হোসাইন জানান, ফ্যাক্ট চেকাররাও হুমকিতে থাকেন। কোনো গুজব চিহ্নিত করার পর, যারা এটি ছড়িয়ে ছিল তারা হুমকি দেয়।

ফেসবুকে রাজনৈতিক বিষয়ে লেখালেখি করা একাধিক ব্যক্তি জানিয়েছেন, নানামুখী চাপ ছাড়াও মতামত যে দলের বিপক্ষে যায়, সেই দলের সমর্থকরা হামলে পড়ে। শুধু আইনি সমস্যা নয়, পরিবারকে পর্যন্ত টেনে আনা হয়। ট্রলিংয়ের ভয়ে অনেকে লেখা বন্ধ করে দিয়েছেন।

কমেন্টে ‘বট’-এর ব্যবহার পেয়েছে। দেখা গেছে, কমেন্টকারী অ্যাকাউন্টগুলোতে প্রোফাইল ছবি ছাড়া কিছুই নেই। অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা গেছে, এসব ‘বট’ থেকে বিরোধীদের আক্রমণ করা হয়। এসব অ্যাকাউন্ট তৈরির বিষয়ে বিভিন্ন তথ্য পাওয়া গেলেও নিশ্চিত হতে পারেনি সমকাল।

হেনস্তার শিকার নারী রাজনীতিকরা

ঢাকা জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক নিপুণ রায় তাঁর তিক্ত অভিজ্ঞতা জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘বিএনপি নেতাদের বক্তব্য খণ্ডিত করে প্রচার করে বিতর্কিত করা হয়। এর পর শুধু গালাগাল নয়, বিএনপির যারা অনলাইনে সক্রিয়, তাদের ওপরে রাষ্ট্রীয় মদদে নির্যাতন করা হয়। ২০১৯ সালে আমার নামে একটি ফোনালাপ ভাইরাল করে আমাকে গ্রেপ্তার করা হয়।’ নিপুণ রায়ের দাবি, সেই ফোনালাপ এডিট করে তৈরি। তিনি বলেছেন, আজ পর্যন্ত ওই ফোনালাপের সত্যতা প্রমাণ হয়নি।

আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি সাবিনা আক্তার তুহিন বলেছেন, একটা স্ট্যাটাস দেওয়ার পরই শুরু হয় গালাগাল। একমাত্র উদ্দেশ্য হলো, রাজনৈতিক মতপ্রকাশ থেকে বিরত রাখা। তাঁর অভিযোগ, বিএনপি-জামায়াত সমর্থকরা এ কাজটি করে। তিনি জানান, গালাগাল ছাড়াও ইনবক্সে যৌন সহিংসতার হুমকি দেওয়া হয়, নোংরা ছবি পাঠানো হয়।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.