ম্যালেরিয়া দিবসের বিজ্ঞাপন ১০৩ সেকেন্ড করে কম প্রচার, টাকা ‘ভাগ–বাঁটোয়ারা’

0
60
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর

কেনাকাটাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে অনিয়ম–দুর্নীতির জন্য অনেক দিন ধরেই স্বাস্থ্য খাত আলোচিত। এবার ম্যালেরিয়া দিবসের বিজ্ঞাপন প্রচার নিয়েও একই রকম তথ্য পাওয়া গেছে। এই ক্ষেত্রে দরপত্র ছাড়াই বিজ্ঞাপন প্রচারের কাজ দেওয়া হয়েছে বেসরকারি টেলিভিশনকে। একেকবার যত সময় বিজ্ঞাপনটি প্রচারের কথা, তার চেয়ে ১০৩ সেকেন্ড করে কম প্রচার করা হয়েছে। এ ছাড়া বিজ্ঞাপনের মান নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।

প্রতিবছর ২৫ মে বিশ্ব ম্যালেরিয়া দিবস পালিত হয়। দিবসটি উপলক্ষে সেমিনার, শোভাযাত্রা আয়োজন ছাড়াও টেলিভিশনে বিজ্ঞাপন প্রচার করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জাতীয় ম্যালেরিয়া নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি।

গত বছর স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক দেশের বাইরে থাকায় ম্যালেরিয়া দিবসের অনুষ্ঠান হয়েছিল ১৫ জুন। তখন ম্যালেরিয়া দিবসের থিম সং বা বিষয়ভিত্তিক গান পরপর তিন দিন তিনটি বেসরকারি টেলিভিশনে বিজ্ঞাপন প্রচারের জন্য ৬০ লাখ টাকার কাজ দেওয়ার ক্ষেত্রে অনিয়মে জড়ান সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।

এখানে বহুমাত্রিক অনিয়ম হয়েছে। প্রথমত ক্রয় আইন লঙ্ঘিত হয়েছে। ব্যক্তিস্বার্থে কাজ দেওয়া হয়েছে। মানসম্মত কাজ হয়নি। পুরো কাজে জড়িত ব্যক্তিদের জবাবদিহি নিশ্চিত করা জরুরি।ইফতেখারুজ্জামান, নির্বাহী পরিচালক, টিআইবি

সংশ্লিষ্ট সূত্র থেকে জানা গেছে, গানটি প্রচারিত হয় ১৫, ১৬ ও ১৭ জুন। গত অক্টোবরে সরকারের নিরীক্ষা কর্মকর্তারা দেখেছেন, দুটি টেলিভিশনে গানটি প্রচার করার জন্য কোনো ধরনের প্রতিযোগিতামূলক দরপত্র ডাকা হয়নি। গানটি প্রচারের জন্য টেলিভিশন দুটিকে ৪৫ লাখ ৬২ হাজার ২৮০ টাকা দেওয়া হয়েছে। অপর একটি সরকারি টেলিভিশনে গানটি প্রচারের কাজ দেওয়া হয় দরপত্রের মাধ্যমে। কাজটি পায় ‘হেলথ ফর পিউপিল’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠানটিকে দেওয়া হয় ১৪ লাখ ৮২ হাজার টাকা।

তিনটি বেসরকারি টেলিভিশনে ম্যালেরিয়ার গানটি প্রচারিত হয়েছিল ১৫, ১৬ ও ১৭ জুন। কিন্তু কাগজপত্রে দেখা গেছে, হেলথ ফর পিউপিলের সঙ্গে জাতীয় ম্যালেরিয়া কর্মসূচির চুক্তি হয়েছে ১৯ জুন। সরকারি নিরীক্ষা কর্মকর্তারা বলেছেন, এটা সরকারি ক্রয় আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।

অন্য দুটি টেলিভিশনের মধ্যে একটির সঙ্গে চুক্তি হয় ১৪ জুন, আরেকটার সঙ্গে চুক্তি হয় ১৫ জুন। দুটি চুক্তিতেই বিজ্ঞাপন দিনের কখন প্রচারিত হবে, কতবার প্রচারিত হবে, তার কোনো শর্ত উল্লেখ ছিল না।

এই চুক্তি যখন হয়, তখন ম্যালেরিয়া নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির দায়িত্বে ছিলেন উপপরিচালক একরামুল হক। তিনি ৮ জানুয়ারি প্রথম আলোর কাছে দাবি করেন, ‘সবকিছু নিয়মমতো হয়েছে।’

হেলথ ফর পিউপিলের মালিক শাহেদ ইমরান; তিনি সরকারের অর্থে পরিচালিত মাতুয়াইলে শিশু-মাতৃস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের কর্মকর্তা। আইন অনুযায়ী তিনি সরকারের সঙ্গে ব্যবসা করতে পারেন না। তা ছাড়া তিনি ব্যবসা করার আগে নিজ প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে অনুমতি নেননি। এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে শাহেদ ইমরানের মুঠোফোনে কল করে ও খুদে বার্তা পাঠিয়েও তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি।

শাহেদ ইমরান উপপরিচালক একরামুল হকের ঘনিষ্ঠ বন্ধু বলে জানা গেছে। একরামুলের দাবি, শাহেদ ইমরানের প্রতিষ্ঠান দরপত্রের মাধ্যমে কাজটি পেয়েছিল।

অবশ্য বিজ্ঞাপন প্রচার নিয়ে অনিয়মের খবরটি পরে জানাজানি হলে একরামুল হককে বদলি করা হয় জাতীয় পুষ্টি কর্মসূচিতে। এখন জাতীয় ম্যালেরিয়া নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি পরিচালনার দায়িত্বে আছেন অসংক্রামক রোগনিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির (সিডিসি) উপপরিচালক শ্যামল কুমার দাস। তিনি বলেন, তিনি মাস দুয়েক আগে এই পদে যোগ দিয়েছেন। তার আগে কী হয়েছিল, সেটা তাঁর জানা নেই।

যে তিনটি টেলিভিশনে গানটি প্রচার করা হয়, তার মধ্যে দুটি টেলিভিশনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে এই প্রতিবেদকের কথা হয়। তাঁরা জানান, কোন সময়ে বিজ্ঞাপন প্রচারিত হয়, তার ওপর বিজ্ঞাপনের মূল্য নির্ভর করে। বেলা ১১টায় প্রচারিত বিজ্ঞাপন প্রচারের মূল্য রাত আটটায় প্রচারিত বিজ্ঞাপনের চেয়ে কম। আবার ২১৭ সেকেন্ড প্রচারের দর ১১৪ সেকেন্ড প্রচারের চেয়ে অনেক বেশি। টেলিভিশনে দেখানো হয়েছে ১১৪ সেকেন্ড। কিন্তু টাকা নেওয়া হয়েছে ২১৭ সেকেন্ডের।

এ ছাড়া ম্যালেরিয়ার গান যিনি লিখেছিলেন, তিনি প্রথম আলোর কাছে অভিযোগ করেন, তিনি কোনো সম্মানী পাননি। প্রচারিত বিজ্ঞাপনে গীতিকার হিসেবে তাঁর নামও উল্লেখ করা হয়নি।

এ ব্যাপারে দুর্নীতিবিরোধী প্রতিষ্ঠান ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘এখানে বহুমাত্রিক অনিয়ম হয়েছে। প্রথমত ক্রয় আইন লঙ্ঘিত হয়েছে। ব্যক্তিস্বার্থে কাজ দেওয়া হয়েছে। মানসম্মত কাজ হয়নি। এতে প্রতারণা হয়েছে। পুরো কাজে জড়িত ব্যক্তিদের জবাবদিহি নিশ্চিত করা জরুরি।’

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.