ব্রিকসে যোগ দিতে চায় বাংলাদেশ

অর্থনৈতিক জোট

0
108
ব্রিকস

এই অর্থনৈতিক জোটে যোগ দিতে আনুষ্ঠানিকভাবে আবেদন করেছে বাংলাদেশ।

অর্থনৈতিক জোট ব্রিকসে যোগ দিতে চায় বাংলাদেশ। এ জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে আবেদন করেছে বাংলাদেশ। আগামী ২২ থেকে ২৪ আগস্ট দক্ষিণ আফ্রিকায় অনুষ্ঠেয় ১৫তম ব্রিকস শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দেবেন জোটটির নেতারা। সেখানে নতুন সদস্য নেওয়ার বিষয়ে আলোচনা হবে বলে জানা গেছে।

ব্রিকস হচ্ছে পাঁচ দেশের একটি আঞ্চলিক অর্থনৈতিক জোট। মূলত ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন ও দক্ষিণ আফ্রিকা—সদস্য এই পাঁচ দেশের আদ্যক্ষর অনুযায়ী ব্রিকসের নামকরণ করা হয়েছে। ২০০৬ সালে ব্রিকসের যাত্রা শুরু হয়েছিল।

বেশ কিছুদিন ধরেই ব্রিকসে বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তি নিয়ে কথাবার্তা হচ্ছিল। পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মোমেন এ নিয়ে একাধিকবার কথা বলেছেন। বাসসের খবরে বলা হয়, গত ১৪ জুন সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় পররাষ্ট্রমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, বাংলাদেশ শিগগির ব্রিকসের সদস্যপদ পেতে পারে। জেনেভায় প্যালেস ডি নেশনসের দ্বিপক্ষীয় বৈঠককক্ষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট সিরিল রামাফোসার মধ্যে বৈঠকে বিষয়টি (ব্রিকসের সদস্যপদ) উত্থাপিত হয়েছে।

বর্তমানে ব্রিকসের নেতৃত্বে আছে দক্ষিণ আফ্রিকা। ব্রিকসে যোগ দিতে বাংলাদেশের আনুষ্ঠানিকভাবে আবেদন জানানোর কথা পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম গতকাল মঙ্গলবার নিশ্চিত করেছেন।

সদস্য হতে চায় ২০ দেশ

কেবল বাংলাদেশ নয়, সব মিলিয়ে ২০টি দেশ ব্রিকস জোটে যোগ দেওয়ার আগ্রহের কথা জানিয়েছে। এর মধ্যে বেশ কিছু দেশ আনুষ্ঠানিকভাবেই আবেদন জানিয়ে রেখেছে। গত এপ্রিলে দক্ষিণ আফ্রিকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী নালেদি পানডোর জানিয়েছিলেন, মোট ১২টি দেশ তখন পর্যন্ত আনুষ্ঠানিক আবেদন জানিয়েছে। এসব দেশের মধ্যে রয়েছে আলজেরিয়া, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন, ইরান, মিসর, আর্জেন্টিনা, মেক্সিকো, ইন্দোনেশিয়া, কম্বোডিয়া, কাজাখস্তান, উজবেকিস্তান, নাইজেরিয়া ইত্যাদি।

২০টি দেশ সদস্য হতে চাইলেও আলজেরিয়া ও সৌদি আরবের আগ্রহই আন্তর্জাতিক মাধ্যমে সবচেয়ে বেশি আলোচনা হচ্ছে। এই দুই দেশ তেল উৎপাদন করে। ধারণা করা হচ্ছে, তেলের উৎপাদন ও দর নির্ধারণে ব্রিকসের মধ্যে থেকে তারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে চেষ্টা করবে।

চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন মুখপাত্র বাংলাদেশের আনুষ্ঠানিক আবেদন পাওয়াসহ নতুন সদস্য অন্তর্ভুক্তির বিষয়ে কথা বলেছেন। বার্তা সংস্থা ইউএনবি জানায়, গতকাল এক ব্রিফিংয়ে রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা রিয়া নভোস্তির পক্ষ থেকে ব্রিকসে যোগ দিতে বাংলাদেশের আনুষ্ঠানিকভাবে আবেদন করা নিয়ে প্রশ্ন করা হয়েছিল। জবাবে চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মাও নিং বলেছেন, বিকাশমান বাজার ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে সহযোগিতার ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্ল্যাটফর্ম হিসেবে ব্রিকস বহুপক্ষীয়তা সমুন্নত রাখা, বৈশ্বিক শৃঙ্খলের সংস্কারকে গতিশীল করা এবং উদীয়মান বাজার ও উন্নয়নশীল দেশের প্রতিনিধিত্ব ও বক্তব্য তুলে ধরতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।

চীন ব্রিকসের সম্প্রসারণকে এগিয়ে নিতে অঙ্গীকারবদ্ধ এবং ব্রিকসের বড় পরিবারে আরও সমমনা অংশীদারদের যুক্ত করতে প্রস্তুত রয়েছে। মাও নিং এ সময় আরও বলেছেন, ব্রিকসের সম্প্রসারণের বিষয়ে জোটের পাঁচ সদস্য একটি রাজনৈতিক ঐকমত্যে পৌঁছেছে। আর বাংলাদেশকে ব্রিকস জোটে স্বাগত জানাতে প্রস্তুত চীন।

বাংলাদেশের আগ্রহ নতুন নয়

বাংলাদেশ অবশ্য কয়েক বছর আগে থেকেই ব্রিকসের বিষয়ে আগ্রহ দেখিয়েছে। এরই অংশ হিসেবে ২০২১ সালের ২ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ ব্রিকস-ব্যাংকের সদস্য হয়। এই ব্যাংকের আনুষ্ঠানিক নাম দ্য নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এনডিবি), যা ব্রিকস সদস্যরা প্রতিষ্ঠা করেছিল ২০১৫ সালে। মূলত ২০২০ সালের শেষের দিকে এনডিবির পরিচালনা পর্ষদ ব্যাংকের নতুন সদস্য নেওয়া নিয়ে আলোচনা শুরু করেছিল। কয়েক দফা আলোচনার পর এনডিবি নতুন সদস্য হিসেবে তিনটি দেশকে অন্তর্ভুক্ত করে। সেই তিন দেশ ছিল বাংলাদেশ, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও উরুগুয়ে।

৫ হাজার কোটি ডলার নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিল এনডিবি। তবে এখন তাদের অনুমোদিত মূলধনের পরিমাণ ১০ হাজার কোটি মার্কিন ডলার। অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশ সদস্য হতে ১ শতাংশ শেয়ার কিনেছে। আর এখন পর্যন্ত এই ব্যাংক ৮০টি প্রকল্প অনুমোদন দিয়েছে, এতে অর্থায়নের পরিমাণ ৩ হাজার কোটি ডলার।

আন্তর্জাতিকভাবে বলা হয়ে থাকে, বিশ্বব্যাংককে চ্যালেঞ্জ জানাতেই দ্য নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এনডিবি) প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। আর ব্রিকস আনুষ্ঠানিকভাবেই আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) বড় ধরনের সংস্কারের পক্ষে। ফলে নতুন নতুন দেশ ব্রিকস জোটে ঢুকলে বিশ্বব্যাংক-আইএমএফের সংস্কারের দাবি আরও জোরালো হবে।

পশ্চিমা ও ধনী দেশগুলোর জন্য নতুন চ্যালেঞ্জ?

ব্রিকস জোটে মাত্র পাঁচটি দেশ থাকলেও বিশ্ব অর্থনীতিতে তাদের অবস্থান বেশ শক্ত। বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ৪০ শতাংশ বাস করে এই পাঁচ দেশে। বৈশ্বিক জিডিপির (মোট দেশজ উৎপাদন) সাড়ে ৩১ শতাংশ ব্রিকসের দখলে। যেখানে বিশ্বের সাত ধনী দেশের ফোরাম জি-সেভেনের জিডিপি কমে এসে দাঁড়িয়েছে ৩০ শতাংশে।

আবার ইউক্রেন আক্রমণ করার পর রাশিয়ার ওপর পশ্চিমা দেশগুলো অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলেও ব্রিকসের কোনো সদস্যই তাতে অংশ নেয়নি; বরং রাশিয়ার সঙ্গে ভারত ও চীনের বাণিজ্য বেড়েছে। বলা হয়ে থাকে, মাঝে ঝিমিয়ে পড়লেও বিদ্যমান ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ব্রিকস এখন যথেষ্ট সক্রিয় ও চাঙাভাব দেখাচ্ছে। সব মিলিয়ে অর্থনৈতিক জোট হলেও পশ্চিমা দেশগুলোর ক্ষেত্রে নতুন চ্যালেঞ্জ নিয়েই হাজির হচ্ছে ব্রিকস। সদস্যসংখ্যা বাড়িয়ে সেই বার্তাটাই দিতে চাইছে জোটটি।

ব্রিকস কী ও কেন

শুরুতে ছিল ব্রিক। অর্থাৎ ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত ও চীন। ধারণাটির প্রবর্তক ছিলেন বিনিয়োগ ব্যাংক দ্য গোল্ডম্যান সাচের অর্থনীতিবিদ জিম ও নেইল। তিনি ২০০১ সালের নভেম্বরে এক রিপোর্ট প্রকাশ করে বলেছিলেন, ২০৫০ সাল নাগাদ এই চারটি দেশই অর্থনীতিতে প্রাধান্য দেখাবে। কারণ হিসেবে জিম ও নেইল বলেছিলেন, এই চার দেশের অর্থনীতি দ্রুত বর্ধনশীল, তাদের শ্রম সস্তা, জনমিতি অনুকূলে এবং ব্যবহার করার মতো প্রচুর প্রাকৃতিক সম্পদ রয়েছে। ২০১০ সালে ব্রিকের সঙ্গে যুক্ত হয় দক্ষিণ আফ্রিকা। জিম ও নেইল অবশ্য এটিকে একটি গবেষণা বলেই উল্লেখ করেছিলেন। কোনো রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক জোটের কথা উল্লেখ করেননি।

ব্রিকসে একটি জোট করার উদ্যোগ ছিল আসলে রাশিয়ার। ২০০৬ সালে নিউইয়র্কে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনের সময় রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন প্রথম জোট গড়ার আগ্রহের কথা জানান। ওই বছরেরই ২০ সেপ্টেম্বর পাঁচ দেশের মন্ত্রীরা এ নিয়ে প্রথম বৈঠকে বসেন। এরপর ২০০৮ সালে রাশিয়ায় অনুষ্ঠিত হয় প্রথম মন্ত্রী পর্যায়ের সম্মেলন। ২০০৮ সালে জাপানে অনুষ্ঠিত জি-এইট সম্মেলনে পুতিন বৈঠক করেন বাকি দেশগুলোর সরকারপ্রধানদের সঙ্গে। তখন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন মনমোহন সিং। এরপরই ব্রিকসের প্রথম সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল ২০০৯ সালের ১৬ জুন, রাশিয়ায়। সেই আনুষ্ঠানিকভাবে ব্রিকসের যাত্রা শুরু। আর সেখানেই এখন যোগ দিতে যাচ্ছে বাংলাদেশ।

ব্রিকস একটি অর্থনৈতিক জোট হলেও একে পশ্চিমা বা মার্কিনবিরোধী জোট বলা হয়। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান দুই প্রতিদ্বন্দ্বী দেশ রাশিয়া ও চীন এর সক্রিয় সদস্য। ইউক্রেন যুদ্ধের পর রাশিয়াকে একঘরে করার পশ্চিমা উদ্যোগ পুরোপুরি সফল হয়নি। চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য যুদ্ধের রেশ এখনো আছে। আবার বাংলাদেশও আছে ভিন্ন এক ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতির মধ্যে। নির্বাচন সামনে রেখে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের জন্য নতুন ভিসা নীতি চালু করেছে। অন্যদিকে চীন প্রকাশ্যে বাংলাদেশকে সমর্থন দিয়েছে। বাংলাদেশকে সমর্থন করে আসা প্রতিবেশী ভারতও ব্রিকসের আরেক সদস্য। ভারতের পত্রিকাগুলো বাংলাদেশের অবস্থানের প্রতি ভারতের সমর্থনের কথা লিখছে। এ রকম এক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের ব্রিকসের সদস্য হতে চাওয়া নতুন মাত্রা যুক্ত করবে বলেই বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.