‘ব্যাংকাস্যুরেন্স’ চালু করতে বিমামালিকদেরই বাধা, নেপথ্যে কী

0
98

বিমাপণ্য বিক্রি করার জন্য বিমা কোম্পানির এজেন্ট হিসেবে কাজ করবে ব্যাংক। এ জন্য বহুল প্রতীক্ষিত ‘ব্যাংকাস্যুরেন্স নীতিমালা’ ও ‘করপোরেট এজেন্ট (ব্যাংকাস্যুরেন্স) নির্দেশিকা’ দুটির খসড়া অনুমোদন করেছে সরকার। কিন্তু প্রজ্ঞাপন জারির আগমুহূর্তে এসে আপাতত তা আলোর মুখ দেখছে না। বিমা কোম্পানির চেয়ারম্যানদের সংগঠন বাংলাদেশ ইনস্যুরেন্স অ্যাসোসিয়েশন (বিআইএ) নিজেই এর বিরোধিতা করছে।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ গত মঙ্গলবার নীতিমালা ও নির্দেশিকা অনুমোদনের কথা জানিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরকে চিঠি পাঠিয়েছে। চিঠিতে গভর্নরকে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর উদ্দেশে এ ব্যাপারে প্রজ্ঞাপন জারির অনুরোধ জানানো হয়।

চিঠিতে বলা হয়, ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে বিমাপণ্য বাজারজাত করতে বাংলাদেশ ব্যাংক ব্যাংকাস্যুরেন্স নীতিমালা প্রণয়ন করেছে। আর বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ) প্রণয়ন করেছে করপোরেট এজেন্ট (ব্যাংকাস্যুরেন্স) নির্দেশিকা। বাংলাদেশ ব্যাংক এখন ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে বিমাপণ্য বিক্রির কার্যক্রম পরিচালনা করতে ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুযায়ী প্রজ্ঞাপন জারি করতে পারে।

তবে প্রজ্ঞাপন জারি হওয়ার আগেই এর বিরোধিতায় নেমেছে বিমা কোম্পানির চেয়ারম্যানদের সংগঠন বাংলাদেশ ইনস্যুরেন্স অ্যাসোসিয়েশন (বিআইএ)। বিআইএর সভাপতি শেখ কবির হোসেন গতকাল বুধবার বলেন, ‘আইডিআরএ চেয়ারম্যান মোহাম্মদ জয়নুল বারী এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব শেখ মোহাম্মদ সলীম উল্লাহর সঙ্গে আমি আলাপ করেছি। এটা আপাতত স্থগিত থাকবে।’

বিমা খাতের স্বার্থে আপনারাই তো চেয়েছিলেন এই ব্যাংকাস্যুরেন্স, এখন বিরোধিতা করছেন কেন—এমন প্রশ্নের জবাবে শেখ কবির বলেন, ‘আমরা যেভাবে চেয়েছি, সেভাবে এটা হয়নি। এতে সমস্যা আছে।’ কী সমস্যা আছে, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আছে। আমরা বিআইএর পক্ষ থেকে একটা বিজ্ঞপ্তি দেব। তখনই দেখতে পারবেন।’

শেখ কবির হোসেন না বললেও নন-লাইফ বিমা কোম্পানিগুলোর রমরমা কমিশন বাণিজ্যই বিরোধিতার অন্যতম কারণ বলে মনে করছেন বেসরকারি বিমা কোম্পানির একাধিক মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও)।

আইডিআরএ চেয়ারম্যান স্বীকার করেছেন, তাঁরা ব্যাংকাস্যুরেন্স বিষয়টি নিয়ে ‘ধীর গতিতে’ অগ্রসর হচ্ছেন।

ভারত, পাকিস্তান ও নেপালে চালু

ব্যাংকাস্যুরেন্স একটি ফরাসি শব্দ। ১৯৮০ সালের দিকে ফ্রান্স ও স্পেনে প্রথম এটি চালু হয়। ইউরোপের বেশির ভাগ দেশে ব্যাংকের মাধ্যমে জীবনবিমা পলিসি বিক্রি হয়। এশিয়ার বিভিন্ন দেশেও জনপ্রিয়তা পেয়েছে এটি। নিকটতম প্রতিবেশী ভারতে এটি চালু হয় প্রায় তিন যুগ আগে। পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কাও এতে সফল হয়েছে। অথচ ৬০টি ব্যাংক ও ৭৯টি বিমা কোম্পানি থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশ এ ক্ষেত্রে পিছিয়ে রয়েছে।

জানা গেছে, ব্যাংকও বিমাপণ্য বিক্রি করবে, এমন চর্চাও প্রায় সারা বিশ্বেই চালু আছে। ইউরোপের দেশগুলোয় ব্যাংকাস্যুরেন্স চালু আছে। বাংলাদেশ এ ব্যাপারে ১০ বছর ধরে শুধু আলোচনাই করে গেছে।

ব্যাংকাস্যুরেন্স নিয়ে ফাউন্ডেশন ফর দ্য অ্যাডভান্সমেন্ট অব লাইফ অ্যান্ড ইনস্যুরেন্স অ্যারাউন্ড দ্য ওয়ার্ল্ড (এফএএলআইএ) পরিচালিত এক জরিপে বলা হয়, ব্যাংকের মাধ্যমে সবচেয়ে বেশি ৭৯ শতাংশ পলিসি বিক্রি হয় তুরস্কে। ভারতে এ হার ২০ দশমিক ৮।

অনিবন্ধিত সংগঠন বাংলাদেশ নন-লাইফ ইনস্যুরেন্স ইনচার্জ অ্যাসোসিয়েশনের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি মোহাম্মদ নুরুল হুদা গতকাল বলেন, ‘ব্যাংকাস্যুরেন্স চালু হলে অনেক লোক চাকরি হারাবেন। এটি জীবনবিমার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হলেও নন-লাইফ বিমার ক্ষেত্রে না হোক, এটা আমাদের দাবি।’

ব্যাংকাস্যুরেন্স নিয়ে তেমন কোনো গবেষণা হয়নি দেশে, তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন ইনস্টিটিউটের (আইবিএ) শিক্ষক মোহাম্মদ জেড মামুন কয়েক বছর আগে একটি প্রবন্ধ প্রকাশ করেছিলেন। এতে উঠে আসে যে যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, ইতালি, জার্মানি, স্পেন, নেদারল্যান্ডসের মতো দেশের ব্যাংকগুলো নিজস্ব পণ্যের পাশাপাশি বিমাপণ্যও বিক্রি করে এবং বাংলাদেশেও এর বিশাল সম্ভাবনা আছে।

প্রজ্ঞাপন জারির বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মেজবাউল হক গতকাল বলেন, ‘আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ যদি চিঠি দিয়ে থাকে, তাহলে আমরা প্রজ্ঞাপন জারি করে দেব।’

নীতিমালায় যা আছে

অনুমোদিত নীতিমালা ও নির্দেশিকা অনুযায়ী ব্যাংকাস্যুরেন্স বাস্তবায়িত হবে মূলত দেশের ব্যাংকগুলোর শাখার মাধ্যমে। আরেক অর্থে বলতে গেলে বিমা কোম্পানির করপোরেট এজেন্ট বা প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করবে ব্যাংক। দীর্ঘদিন ধরেই এমন অভিযোগ রয়েছে যে বিমা খাতের প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা তুলনামূলক কম, তাই ব্যাংকাস্যুরেন্স হতে পারে মানুষের ভরসার জায়গা।

ধারণাটি এমন যে বিমাপণ্যের জন্য গ্রাহকদের বিমা কোম্পানিতে যেতে হবে না, ব্যাংকের শাখায় গেলেই চলবে। অর্থাৎ ব্যাংক তার নিজের গ্রাহকের কাছে ব্যাংকিং পণ্যের পাশাপাশি বিমাপণ্যও বিক্রি করবে। পণ্যগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে পেনশন, স্বাস্থ্য, দুর্ঘটনা, দেনমোহর, শিক্ষা, ওমরাহ হজ ইত্যাদি।

বলা হয়েছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণে থাকা ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোই ব্যাংকাস্যুরেন্সের এজেন্ট হতে পারবে। সে জন্য বিমা কোম্পানিগুলোর সঙ্গে চুক্তি করতে হবে তাদের। তবে কোনো ব্যাংকাস্যুরেন্স এজেন্ট তিনটির বেশি বিমা কোম্পানির সঙ্গে যুক্ত হতে পারবে না। এ জন্য বিমা কোম্পানিকে আইডিআরএ এবং ব্যাংকাস্যুরেন্স এজেন্টকে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন নিতে হবে।

দেশে ব্যাংকের মোট শাখা প্রায় ১১ হাজার ১৮২টি, এ তথ্য বাংলাদেশ ব্যাংকের। আর বিশ্বব্যাংকের ২০১৮ সালের এক হিসাব অনুযায়ী, দেশে ব্যাংক হিসাবধারীর সংখ্যা ৯ কোটি ছাড়িয়ে গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ তথ্যানুযায়ী এ হিসাব ১০ কোটির কাছাকাছি।

ব্যাংকাস্যুরেন্সের আওতায় ব্যাংকের মাধ্যমে বিমা পলিসি বিক্রি হলে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) তুলনায় বিমা খাতের অবদান বাড়বে জানিয়ে সরকারের এ উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাংকিং অ্যান্ড ইনস্যুরেন্স বিভাগের চেয়ারম্যান হাসিনা শেখ।গতকাল তিনি বলেন, খুবই ভালো হলো। বিমাপণ্যের বাজারজাতকরণটা ঠিক হচ্ছিল না। ব্যাংকের নেটওয়ার্ক ও ব্যাংকের প্রতি মানুষের আস্থাটাকে ব্যবহার করে এখন একদিকে বিমা খাত উজ্জীবিত হবে, পাশাপাশি ব্যাংকেরও ব্যবসা বাড়বে।

বিমা কোম্পানির মালিকদের পাশাপাশি চাকরি হারানোর আশঙ্কার কথা বলে একদল বিমাকর্মীও এর বিরোধিতা করছে, এ বিষয়ে জানতে চাইলে হাসিনা শেখ জানান, কোনো মানে নেই এ বিরোধিতার। বিমা খাতের ভালোর জন্য ব্যাংকাস্যুরেন্সের চেয়ে ভালো কোনো ব্যবস্থা নেই।

বেসরকারি বিমা কোম্পানিগুলোর সমিতির সভাপতি শেখ কবির হোসেন আলাপ করার পর থেকে বিষয়টি নিয়ে আর কথা বলছেন না আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব শেখ মোহাম্মদ সলীম উল্লাহ। তবে আইডিআরএ চেয়ারম্যান মোহাম্মদ জয়নুল বারী আজ বৃহস্পতিবার  সঙ্গে কথা বলেছেন। তিনি বলেন, নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান থেকে প্রয়োজনীয় প্রজ্ঞাপন জারি করা হবে।

মোহাম্মদ জয়নুল বারী আরও বলেন, ‘বিষয়টির বাস্তবায়ন পর্যায়ে কিছু সমস্যা হতে পারে। সে কারণে আমরা একটু ধীরগতিতে যাচ্ছি।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, ১০ বছর ধরে সব পক্ষের সঙ্গে আলোচনার পর ব্যাংকাস্যুরেন্স চালুর দ্বারপ্রান্তে এসে তা বাস্তবরূপ না দেখার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে ওইটুকু আলাপেই। এতেই বোঝা যায়, কোথায় দাঁড়িয়ে আছে দেশের বিমা খাত।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.