বুয়েটে শিবিরকে ‘চাঙ্গা’ করতে টাঙ্গুয়া মিশন

0
106
সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ার হাওরে গিয়ে বুয়েটের ২৪ ছাত্রসহ ৩৪ শিক্ষার্থী গ্রেপ্তার হয়েছেন।

সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ার হাওরে গিয়ে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ২৪ ছাত্রসহ ৩৪ শিক্ষার্থী পুলিশের হাতে গ্রেপ্তারের ঘটনাটি নানামুখী আলোচনার জন্ম দিয়েছে।

স্থানীয় পুলিশের একাধিক কর্মকর্তা জানান, মূলত ঢাকা থেকে পাওয়া গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে ওই অভিযান হয়েছে। এতে নেওয়া হয়েছে তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তাও। বিস্তারিত জিজ্ঞাসাবাদ ও বিভিন্ন আলামত জব্দ করার পর তাদের বিরুদ্ধে মামলা ও গ্রেপ্তার দেখানো হয়। ছাত্রশিবিরের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের কাগজপত্র, সংগঠনের তহবিল-সংক্রান্ত প্রচারপত্র, সংগঠনের সাথি ও সদস্যদের পাঠযোগ্য সিলেবাস, কর্মী ঘোষণা সংক্রান্ত নথিপত্র জব্দ করা হয়। পুলিশের দায়ের করা মামলার জব্দ তালিকায় তা উল্লেখ করা হয়েছে।

গ্রেপ্তারদের মধ্যে ছাত্রশিবিরের বুয়েট শাখার বায়তুল মাল সম্পাদক আফিফ আনোয়ার রয়েছেন। তাঁর নেতৃত্বে সবাই হাওরে এসেছিলেন। জব্দ নথিপত্র বিশ্লেষণ ও গোয়েন্দা সূত্র জানায়, সংগঠনকে ‘চাঙ্গা’ করার উদ্দেশ্যে প্রাকৃতিক পরিবেশের সান্নিধ্য নিতে আফিফের নেতৃত্বে তারা সুনামগঞ্জ যান। সেখানে ‘মোটিভেশনাল’ নানা বক্তব্য রাখার কথা ছিল। জব্দ আলামত ও ডিভাইস পরীক্ষা করে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। আফিফ বুয়েটের ম্যাটেরিয়ালস অ্যান্ড মেটালার্জিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী। তাঁর বাড়ি চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জ উপজেলার মান্দারখিল  গ্রামে।

এদিকে, গ্রেপ্তার বুয়েট শিক্ষার্থীদের অবিলম্বে মুক্তি দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন তাদের অভিভাবকরা। তাদের ভাষ্য, সন্তানরা নিরপরাধ। সন্তানরা কোনো ধরনের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত নন। এ ধরনের অভিযোগ সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন, বানোয়াট ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।

গতকাল মঙ্গলবার বিকেলে বুয়েটের শহীদ মিনারে এক সংবাদ সম্মেলন করে এই দাবি করেন গ্রেপ্তার শিক্ষার্থীদের অভিভাবকরা। কথা বলতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যান্ড প্রডাকশন প্রকৌশল বিভাগের শিক্ষার্থী আবরার মুহতাদীর মা ওয়াহিদা নাসরিন। তিনি বলেন, ‘আমার ছেলে বাসা থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে আসা-যাওয়া করত। হলেও থাকত না। আমাকে বলেছিল ট্যুরে যাব, এটা কিনব ওটা কিনব। সবকিছু সুন্দরভাবেই হলো। বললাম ঠিক আছে যাও। জিজ্ঞেস করিনি কয়জন যাচ্ছ। নিজের হাতে সবকিছু গুছিয়ে দিলাম। কীভাবে সন্ত্রাসে জড়িত থাকার মামলা দেয় বুঝি না।’

আরও কয়েকজন অভিভাবক বলেন, আমরা মানসিকভাবে বেদনাদায়ক সময় পার করছি। সন্তানদের ভবিষ্যৎ জীবনের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কায় আছি। আমরা চ্যালেঞ্জ দিয়ে বলতে পারি, কোনো ধরনের রাষ্ট্রবিরোধী কার্যকলাপে আমাদের সন্তানরা জড়িত নয়। ছোটবেলা থেকেই তারা লেখামুখী। তাদের জামিন এবং মামলা থেকে মুক্তি দেওয়ার দাবি জানাচ্ছি।

নেভাল আর্কিটেকচার অ্যান্ড মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সাকিব শাহরিয়ারের বাবা জালালুদ্দিন চৌধুরী বলেন, ‘আমার নিরীহ ছেলে, খুব মেধাবী। আমাকে বলেছিল হাওর এলাকায় পিকনিকে যাবে। আর কিছু তো ভাবিনি। সোমবার আমার কাছে ফোন করে জাতীয় পরিচয়পত্র চাইল। তখন আমার সন্দেহ হয়। এরপর আমরা জানতে পারি। আমরা খুবই সাধারণ পরিবারের। কী রকম অনিশ্চয়তার মধ্যে আছি, এটা বোঝানো সম্ভব হবে না।’

অভিভাবকদের ডাকা সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পড়ে শোনান বুয়েটের ছাত্র আলী আম্মার মৌয়াজের ভাই আলী আহসান জুনায়েদ। তিনি বলেন, ‘২৯ জুলাই এই শিক্ষার্থীরা সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ার হাওরে বেড়াতে যায়। দীর্ঘক্ষণ তাদের ফোনে পাওয়া যাচ্ছিল না। প্রায় ৩ ঘণ্টা পর রাত ১০টার দিকে হঠাৎ ফোন করে অনেকেই নিজের ও অভিভাবকের জাতীয় পরিচয়পত্রের নম্বর জানাতে বলে। তারা জানায়, হাওরে নৌকাভ্রমণের সময় জিজ্ঞাসাবাদের কথা বলে পুলিশ তাদের আটক করে তাহিরপুর থানায় নিয়ে এসেছে। তারা ফোনে শুধু এটুকুই বলতে পেরেছে। তাদের ফোন নিয়ে নেওয়া হয়। স্থানীয় পুলিশ সুপার ও ওসির সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তা পাওয়া যায়নি।’

লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, অনেক উদ্বেগের পরে সোমবার বিকেলে বিভিন্ন গণমাধ্যমের খবরে আমরা জানতে পারি, তাদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাস দমন আইনে মামলা দেওয়া হয়েছে। তারা নাকি নাশকতা সৃষ্টির পরিকল্পনার জন্য সেখানে গেছে। আমরা মনে করি, এ রকম হাস্যকর ও বানোয়াট অভিযোগ সম্পূর্ণ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও দুরভিসন্ধিমূলক। ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে তাদের বিরুদ্ধে এমন ভয়ংকর মামলা সাজানো হলো, তা আমাদের বোধগম্য নয়।

সংবাদ সম্মেলনে অন্যদের মধ্যে সুনামগঞ্জ থেকে গ্রেপ্তার বুয়েটছাত্র এ টি এম আবরার মুহতাদীর মা ওয়াহিদা নাসরিন, হাইছাম বিন মাহবুবের মা ফাতেমা বেগম, আফিফ আনোয়ারের বাবা আনোয়ারুল হক, সাকিব শাহরিয়ারের বাবা জামাল উদ্দিন চৌধুরী, বাকি বিল্লাহর ভাই আরিফ বিল্লাহ প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। বুয়েটের ১৯ ব্যাচের শিক্ষার্থীরা বিবৃতিতে জানিয়েছে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে প্রমাণ দিতে হবে তারা নাশকতা পরিকল্পনায় জড়িত। শিবিরের সঙ্গে সংযুক্তির পক্ষে উপযুক্ত প্রমাণ আনতে হবে।

বুয়েটের ছাত্রকল্যাণ পরিদপ্তরের পরিচালক মিজানুর রহমান বলেন, যাচাই করে আমাদের ২৪ জন শিক্ষার্থী গ্রেপ্তারের কথা জানতে পেরেছি। অভিভাবকরা আইনি বিষয় চালিয়ে যাবেন। এটা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরের ঘটনা। আমাদের কিছু করার নেই।

তবে বুয়েটের নিরাপত্তা অফিসার আফগান হোসেন বলেন, অভিভাবকরা এসেছিলেন। ভিসি ও ছাত্রকল্যাণ পরিদপ্তর পরিচালক পুলিশের সঙ্গে কথা বলেছেন। বিশ্ববিদ্যালয় যতটুকু পারে সহযোগিতা করবে।

জানা গেছে, আবু হানিফ বুয়েটের নগর অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের সিনিয়র সহকারী রেজিস্ট্রার। বুয়েটের সেন্ট্রাল মসজিদের পাশেই তাঁর বাসভবন। ওই মসজিদে নামাজ পড়তে আসতেন মেহেদী ও মহসিন নামে দুই বুয়েট শিক্ষার্থী। সেখানে তাদের সঙ্গে পরিচয় হানিফের। পরিচয়ের সূত্র ধরে তাঁর ছেলেকে সপ্তাহে এক দিন করে প্রাইভেট পড়ান মেহেদী ও মহসিন। মহসিনের ছাত্রত্ব শেষ। তবে মাঝে মাঝে ক্যাম্পাসে আসেন।

আবু হানিফ বললেন, আমার ছেলের এসএসসির ফলাফল বেরোনোর পরদিন তাকে মেহেদী ও মহসিন টাঙ্গুয়াতে নেওয়ার প্রস্তাব দেয়। তারা যে ছাত্রশিবিরের সঙ্গে যুক্ত, এটা কী করে বুঝব।

সরকারের বিরুদ্ধে ‘গোপন ষড়যন্ত্র ও জননিরাপত্তা বিঘ্নিত করার আশঙ্কায়’ রোববার বিকেলে টাঙ্গুয়ার হাওর থেকে ৩৪ জনকে আটক করা হয়। সোমবার বিকেলে তাদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে পুলিশ বাদী হয়ে তাহিরপুর থানায় একটি মামলা করে। এই মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে বিকেলে তাদের আদালতে হাজির করলে আদালতের বিচারক ৩২ জনকে কারাগারে এবং দু’জন কিশোর হওয়ায় তাদের কিশোর সংশোধনাগারে পাঠানোর আদেশ দেন।

সোমবার ওই শিক্ষার্থীদের সুনামগঞ্জের আদালতে তোলা হলে তাদের পক্ষে দাঁড়ান কয়েকজন আইনজীবী। এই আইনজীবীরা একসময় জামায়াত ও ছাত্রশিবিরের সাবেক নেতা ছিলেন।

সুনামগঞ্জ জেলা ছাত্রশিবিরের সাবেক সভাপতি আইনজীবী আবুল বাশার সাংবাদিকদের বলেন, ‘গ্রেপ্তারকৃতরা ছাত্রশিবিরের কোন পর্যায়ের নেতাকর্মী, তা এখনও আমরা নিশ্চিত হতে পারিনি। তাদের জন্য আইনজীবী নিয়োগের ব্যাপারে পরিবার থেকে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে।’

পুলিশের তথ্যমতে, গ্রেপ্তার ৩৪ জনের মধ্যে ২৪ জন্য বুয়েটের বর্তমান শিক্ষার্থী। এর মধ্যে ছয়জন প্রথম বর্ষ, ছয়জন দ্বিতীয় বর্ষ, পাঁচজন তৃতীয় বর্ষ, পাঁচজন চতুর্থ বর্ষ এবং দু’জন স্নাতকোত্তর শ্রেণিতে পড়ছেন। বাকি ১০ জনের মধ্যে সাতজন বুয়েটের সদ্য সাবেক শিক্ষার্থী। অন্য তিনজনের মধ্যে দু’জন এবার এসএসসি পাস করেছে, একজন বুয়েটের এক শিক্ষার্থীর বাসায় কাজ করেন।

সুনামগঞ্জের পুলিশ সুপার মো. এহসান শাহ্‌ বললেন, গ্রেপ্তারকৃতদের কাছে যেসব আলামত পাওয়া গেছে, তাতে বোঝা যাচ্ছে শিবির বুয়েটে গোপনে রাজনৈতিক কার্যক্রম চালাচ্ছে। মোবাইল ও ডিভাইস যাচাই করলে সরকার বা রাষ্ট্রবিরোধী কার্যক্রম পরিচালনা বা নাশকতার বড় বিষয় বেরিয়ে আসতে পারে।

নৌকার মালিক বিপাকে

বুয়েট শিক্ষার্থীদের বহনকারী নৌকার মালিক পড়েছেন বিপাকে। এখনও তিনি ভাড়া পাননি, নৌকাটিও পুলিশ জব্দ করেছে। বুয়েটের পর্যটকদের জন্য দামদর করে নৌকার ব্যবস্থা করে দেওয়া তাহিরপুরের শিবিরকর্মী হিসেবে পরিচিত আবুল আলা, শিবিরের উপজেলা শাখার বর্তমান সভাপতি আশরাফুল ইসলাম আকাশ ও সাবেক সভাপতি শাজাহান আলী এর কোনো সমাধান দিচ্ছেন না।

নৌকার মালিক রতনশ্রী এলাকার আহাদুল বলেন, ‘গোবিন্দশ্রীর আবুল আলাসহ তিনজন এক দিন-একরাত ও পরদিন দুপুর পর্যন্ত থাকার উদ্দেশ্যে ২১ হাজার টাকায় নৌকাটি ভাড়া নিয়েছিলেন। আমি তো কাউকে চিনি না। আবুল আলাসহ তিনজন কথা বলেছেন। পরে আবুল আলা তাঁর দোকানের  সুমনকে দিয়ে পর্যটক পাঠিয়েছেন। এখন কেউ-ই আমার ভাড়ার টাকা দিচ্ছেন না। নৌকাটি আমার ভাইয়ের।  তিনি মারা গেছেন। এখন আমি দেখভাল করছি। ভাইয়ের সংসার চলে এই নৌকার ভাড়ায়। আমি এখন কীভাবে জীবন বাঁচাই, তাদের কীভাবে খাওয়াই।’

তাহিরপুর উপজেলা ছাত্রশিবিরের সভাপতি আশরাফুল ইসলাম আকাশ বলেন, ‘নৌকা ভাড়া করে দিয়েছি বলে আমার দায় নিতে হবে, এমনটা ভাবিনি।’

নৌকারচালক শিবলি মিয়া বলেন, ‘আবুল আলা, কলাগাঁওয়ের আকাশ ও দুতমার শাজাহান আগের দিন নৌকার জন্য কথা বলে গেছেন। এখন আমাদের নৌকা জব্দ। তাদের সঙ্গে কথা বলেও কোনো সমাধান পাইনি।’

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.