হাসপাতালে যন্ত্রের ‘রোগ’

0
109

লিনিয়ার এক্সিলারেটর। ক্যান্সার রোগীকে রেডিওথেরাপি দিতে যন্ত্রটি কেনা হয়েছিল সেই ২০১২ সালে। তখনই দাম পড়েছিল অন্তত ১০ কোটি টাকা। তবে ১১ বছর পরও খোলা হয়নি ওই বাক্সের গিঁট। বাক্সবন্দি হয়ে এটি পড়ে আছে খুলনা মেডিকেল কলেজ (খুমেক) হাসপাতালের রেডিওথেরাপি বিভাগের সামনে ধুলার আস্তরণে। এত বছর পর যন্ত্রটি কার্যকর আছে কিনা, তাও জানা নেই কারও! শুধু বাঙ্কার না থাকায় চালু হয়নি যন্ত্রটি। দামি লিনিয়ার এক্সিলারেটরের এ করুণ পরিণতির জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে দুষছে খুমেক হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।

এদিকে, রাজধানীর শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ১৮ কোটি টাকা দামের ম্যাগনেটিক রেজোন্যান্স ইমেজিং (এমআরআই) যন্ত্রটির দম ফুরিয়েছে, তাও সাড়ে তিন বছর। ২০১৬ সালের অক্টোবরে যন্ত্রটি হাসপাতালে সরবরাহ করেছিল ‘মেডিটেল’। ওয়ারেন্টি ছিল তিন বছর। ওয়ারেন্টি শেষ হতে না হতেই ২০২০ সালের শুরুতে যন্ত্রটি বিগড়ে যায়। মেরামতের জন্য ৩২ লাখ টাকা নিলেও এমআরআই যন্ত্রটি সচল করতে পারেনি মেডিটেল। এর পর থেকে সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান আর স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মধ্যে চলছে ‘ইঁদুর-বিড়াল খেলা’। জটিলতার গাড্ডায় পড়ে আর হয়নি মেরামতকাজ।

শুধু শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল নয়; ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, রংপুর মেডিকেল কলেজ (রমেক) হাসপাতাল, গোপালগঞ্জ জেনারেল হাসপাতাল, মানিকগঞ্জ ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতাল, খুলনার শহীদ শেখ আবু নাসের বিশেষায়িত হাসপাতাল, রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতাল, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালসহ অনেক সরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে একদম বন্ধ এমআরআই সেবা।

সচল-অচল খেলা

কেবল এমআরআই যন্ত্র অকেজো, এমনটা নয়। সরকারি বড় বড় হাসপাতালের অচল যন্ত্রের ভয়ংকর কীর্তি উঠে এসেছে সমকালের অনুসন্ধানে। শত শত কোটি টাকার মেডিকেল যন্ত্র কোথাও বিকল, কোথাও পড়ে আছে অব্যবহৃত। যন্ত্রের বাক্স খোলা হয় না বছরের পর বছর, এমন অদ্ভুত কাণ্ডও আছে। গুরুত্বপূর্ণ এসব যন্ত্রের ব্যবহার না থাকায় রোগীদের কষ্ট, ভোগান্তি বাড়ছেই। যন্ত্রের অভাবে সরকারি হাসপাতালে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে না পেরে বেসরকারি হাসপাতালে গিয়ে নিরুপায় রোগীর পকেট থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে তিন-চার গুণ টাকা।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বেশি লাভের আশায় স্বাস্থ্য খাতের সঙ্গে যুক্ত ব্যবসায়ীরা হাসপাতালগুলোতে ব্যয়বহুল যন্ত্র কেনার পক্ষে যুক্তি খাড়া করেন।
তবে এসব যন্ত্র পরিচালনার উপযুক্ত দক্ষতাসম্পন্ন লোকবল পরে আর পাওয়া যায় না। শেষমেশ প্রযুক্তিগত ত্রুটি-বিচ্যুতি রেখেই কোনোমতে যন্ত্র কর্তৃপক্ষকে বুঝিয়ে দিয়ে টাকা-পয়সা উসুল করে সরে যায় সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান। এ ছাড়া আগের যন্ত্রটি চালু না হওয়ার অজুহাতে নতুন যন্ত্র কেনারও আয়োজন চলে কোথাও কোথাও।

তবে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, হাসপাতালের কোনো যন্ত্র নষ্ট হলে তা অকেজো ফেলে রেখে রোগীদের বাইরে চিকিৎসা নিতে পাঠানো এক ধরনের অপরাধ। অকেজো যন্ত্র সচলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে তৎক্ষণাৎ উদ্যোগী হবে হবে।

আরও যেসব যন্ত্র বিকল

চমেক হাসপাতালে গুরুত্বপূর্ণ এক ডজন চিকিৎসাযন্ত্র কেনার পরপরই অকেজো পড়ে আছে। ব্র্যাকিথেরাপি, ক্যাথল্যাবসহ গাইনি ওয়ার্ডের বারান্দায় পড়ে আছে প্রায় ১৫ লাখ টাকা দামের ১০টি শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র (এসি), সাড়ে পাঁচ লাখ টাকার তিনটি ভায়াথোলজি মেশিন, তিনটি অপারেশন লাইট। দুটি অপারেশন টেবিলের মধ্যে একটি একেবারেই নষ্ট হয়ে গেছে। চার লেবার টেবিল, একটি অ্যানেসথেশিয়া মেশিনও এখন অকার্যকর।

রামেক হাসপাতালের মেমোগ্রাফি মেশিনটি ২০১৮ সালে এক কোটি ৬৩ লাখ টাকায় কেনা হয়। গত ৫ জুলাই যন্ত্রটি অচল হয়ে পড়ে। এখনও এটি মেরামতে উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। এ ছাড়া দুটি সিটি স্ক্যান মেশিন আড়াই বছর ধরে বিকল। তিনটি আলট্রাসনোগ্রাম মেশিন অকেজো তিন বছর। আটটি এক্স-রে মেশিন বিকল। একটি এমআরআই যন্ত্র অকেজো পড়ে আছে ছয় বছর।

রমেক হাসপাতালে দীর্ঘদিন বিকল পড়ে আছে এনজিওগ্রাম ও সিটি স্ক্যান মেশিন। ইকো আলট্রাসনোগ্রাম মেশিন দুই বছর ধরে চলছে না। কিডনি রোগীর ডায়ালাইসিসে ব্যবহৃত ১৪টি মেশিন অচল। এসব যন্ত্র মেরামতে আট কোটি টাকা বরাদ্দ দেয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। তবে গত অর্থবছরে সেই টাকা ফেরত গেছে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, কম সময়ের কারণে মেরামতকাজ করতে না পারায় বরাদ্দ ফেরত দিতে হয়েছে।

রক্ষণাবেক্ষণেও অস্বাভাবিক খরচ

প্রাথমিকভাবে গেল জুনে অকেজো পড়ে থাকা পাঁচটি এমআরআই ও তিনটি সিটি স্ক্যান মেশিন রক্ষণাবেক্ষণে কম্প্রিহেনসিভ মেইনটেন্যান্স কন্ট্রাক্ট (সিএমসি) করতে চেয়েছিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। এর জন্য ৬৭ কোটি ৭১ লাখ ৬৬ হাজার টাকা লাগবে বলে জানায় সরকারি প্রতিষ্ঠান ন্যাশনাল ইলেকট্রো-মেডিকেল ইকুইপমেন্ট মেইনটেন্যান্স ওয়ার্কশপ অ্যান্ড ট্রেনিং সেন্টার (নিমিউ অ্যান্ড টিসি)। যদিও এই আটটি যন্ত্র কেনা হয়েছিল ৯৩ কোটি ৬৭ লাখ ৮৫ হাজার টাকায়। ‘অস্বাভাবিক’ অর্থ খরচ করে চিকিৎসাযন্ত্র রক্ষণাবেক্ষণের এই প্রস্তাব নাকচ করে দেয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। এ ছাড়া অন্য যন্ত্র মেরামতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের আর কোনো উদ্যোগের খবর সমকাল পায়নি।

সাত সদস্যের উপকমিটি

অচল যন্ত্রপাতি সচল করতে গত ১২ মে সাত সদস্যের একটি উপকমিটি গঠন করে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। সিএমসি-সংক্রান্ত কমিটির এক সভায় এই উপকমিটি গঠন করা হয়। স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (হাসপাতাল) নাজমুল হক খান ওই সভায় সভাপতিত্ব করেন। কেন্দ্রীয় ঔষধাগারের (সিএমএসডি) পরিচালক তোফায়েল ইসলামকে এই উপকমিটির আহ্বায়ক এবং নিমিউ অ্যান্ড টিসির চিফ টেকনিক্যাল ম্যানেজার জয়ন্ত কুমার মুখোপাধ্যায়কে সদস্য সচিব করা হয়েছে। এ ছাড়া মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রতিনিধি, দুটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক এবং জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের পরিচালককে কমিটির সদস্য করা হয়েছে। নষ্ট যন্ত্রপাতির মেরামত প্রক্রিয়া কী হবে, তা দেখবে এই উপকমিটি।

যা বলছেন বিশেষজ্ঞরা

সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, স্বাস্থ্য খাতই অসুস্থ। এই অসুস্থতার জন্য দায়ী দলীয়করণ। দুর্নীতি ও দুর্বৃত্তায়নের কারণে মানুষের সেবার জন্য যন্ত্রপাতি কেনার চেয়ে রাজনৈতিক সুবিধাবাদী চক্রের মাধ্যমে এসব কেনাকাটা চলে। কখনও কখনও অপ্রয়োজনীয় যন্ত্র কেনা হয়। অনেক ক্ষেত্রে অযোগ্য ব্যক্তিদের নিয়োগ দেওয়া হয়। ফলে আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলো ভালো চলে না। তিনি আরও বলেন, মন্ত্রণালয়ের গাফিলতি ও চিকিৎসকদের সদিচ্ছা না থাকায় সরকারি হাসপাতালে মিলছে না কাঙ্ক্ষিত সেবা। কমিশন বাণিজ্যের জন্য চিকিৎসকরা পরিকল্পিতভাবে রোগীদের বেসরকারি খাতে সেবা নিতে বাধ্য করছেন। এটি একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট।

জনস্বাস্থ্য সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক ফয়জুল হাকিম বলেন, স্বাস্থ্য খাতে কেনাকাটায় বড় দুর্নীতি হয়। বাজারদরের চেয়ে তিন থেকে চার গুণ বেশি দামে এসব চিকিৎসাযন্ত্র কেনা হয়। এ দুর্নীতির সঙ্গে সরকারি কর্মকর্তা জড়িত থাকে। সেটি পরিচালনার জন্য দক্ষ কারিগর নিয়োগ দেওয়া হয় না। দীর্ঘদিন পড়ে থেকে বিকল হয়ে পড়ে। ফলে ভোগান্তির শিকার হয় মানুষ। এসব অব্যবস্থাপনা দূর করতে স্বাস্থ্য খাতকে দুর্নীতি মুক্ত করতে হবে।

হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের ভাষ্য

সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. মো. খলিলুর রহমান বলেন, এমআরআই মেশিনটি যখন নষ্ট হয়, সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান ‘মেডিটেল’ জানায়, মেরামতে দুই কোটি টাকা লাগবে। ৫০ লাখ টাকা দিতে রাজি হয় মন্ত্রণালয়। তবে কোম্পানি এতে রাজি না হওয়ায় গত অর্থবছর সেটি বাতিল করা হয়। সর্বশেষ জাপানি কোম্পানি হিটাচির ইসিলোনের কাছে চিঠি দেওয়া হয়েছে। তারা যদি মেরামত করতে না পারে, তাহলে নতুন যন্ত্র কিনতে হবে। কবে নাগাদ এমআরআই পরীক্ষা হাসপাতালে শুরু করা যাবে– জানতে চাইলে তিনি বলেন, নতুন যন্ত্রপাতি কেনা এখন বন্ধ। এটি সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। এর পরও আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।
চমেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শামীম আহসান বলেন, নষ্ট হওয়া চিকিৎসাযন্ত্র আমরা ইচ্ছা করলেই মেরামত করতে পারি না। এগুলো ঠিক করতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের অনুমতি লাগে। সেখানে কয়েক দফা চিঠি দেওয়া হয়েছে। এখনও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসেনি। চিকিৎসা কার্যক্রম চালিয়ে নিতে অন্তত একটি করে নতুন এমআরআই ও ক্যাথল্যাব আমাদের দ্রুত দরকার।

চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক সেখ ফজলে রাব্বী বলেন, ২০১৯ সালে এমআরআই মেশিনটি নষ্ট হয়। এতে দুর্ভোগে পড়েন রোগীরা। সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে মামলার কারণে এটি মেরামতে জটিলতা দেখা দিয়েছে।

স্বাস্থ্যের মহাপরিচালক যা বললেন

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম বলেন, হাসপাতালে অচল যন্ত্র সচলের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। হাসপাতালসহ সব স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রের যন্ত্রপাতি নিয়ে কাজ করছি। সম্পূর্ণ তালিকা প্রস্তুত হলে কোনটি মেরামত করা যাবে আর কোনটা মেরামত অযোগ্য, কোন যন্ত্র নতুন লাগবে– এসব জানা যাবে। প্রয়োজনে কেন্দ্রীয় ডাটাবেজের মাধ্যমে তদারকি জোরদার করা হবে।

এসব বিষয়ে কথা বলতে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকের মোবাইলে গতকাল বিকেলে ফোন দেওয়া হলে তিনি সংযোগ কেটে দেন।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.