প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন দেখে পদক্ষেপ নেবে যুক্তরাষ্ট্র

0
115

বাংলাদেশের আগামী জাতীয় নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হবে– ক্ষমতাসীনদের কাছ থেকে এমন প্রতিশ্রুতি পেয়েছে সফর করে যাওয়া যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি দল। ঢাকার এ প্রতিশ্রুতিকে স্বাগত জানিয়েছে তারা। তবে প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নই নির্ধারণ করবে ওয়াশিংটন আগামীতে কী ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখাবে। কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা এমনই মন্তব্য করেছেন।

চার দিনের বাংলাদেশ সফর শেষে ঢাকা ছেড়েছে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের বেসামরিক নিরাপত্তা, গণতন্ত্র ও মানবাধিকারবিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি উজরা জেয়ার নেতৃত্বাধীন প্রতিনিধি দলটি। বিশ্লেষকরা বলছেন, ঢাকাকে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হিসেবে দেখতে চায় ওয়াশিংটন। এ জন্য দরকার একটি স্থিতিশীল ও শান্তিপূর্ণ বাংলাদেশ। এ স্থিতিশীলতা ও শান্তিপূর্ণ পরিস্থিতি অর্জনে প্রয়োজন গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া, শান্তিপূর্ণ নির্বাচন, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, নাগরিক অধিকার, আইনের শাসন এবং মানবাধিকারের মতো বিষয়গুলোর আদর্শিক পরিস্থিতি। এ কারণে যে কোনো পরিস্থিতিতে বাংলাদেশে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন দেখতে চায় যুক্তরাষ্ট্র।

ধারণাবশত বলা হচ্ছিল, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির যুক্তরাষ্ট্র সফরের মধ্য দিয়ে ওয়াশিংটনের বাংলাদেশ ইস্যুতে এক প্রকার নমনীয়তা আসবে। তবে উজরা জেয়া বাংলাদেশ সফরের আগে ভারত সফরের সময়ও পরিষ্কার করে দিয়েছেন– তা হয়নি। দেশটিতে একটি গণমাধ্যমকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশে গণতন্ত্র ও অবাধ নির্বাচনের কথা বলেছেন তিনি। তবে বাংলাদেশ ইস্যুতে রাশিয়া ও চীন সরাসরি যুক্তরাষ্ট্রের বিপরীতে অবস্থান করছে।

এদিকে ঢাকার যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাস শুক্রবার বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে, দ্বিপক্ষীয় অংশীদারিত্বের প্রতি অব্যাহত সমর্থন জানাতে উজরা জেয়ার নেতৃত্বে প্রতিনিধি দল বাংলাদেশ সফর করেছে। উজরা জেয়া বলেছেন, ‘ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের সমৃদ্ধি ও স্বাধীনতা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে আমাদের লক্ষ্য পূরণে বাংলাদেশ গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার। গণতন্ত্র সমুন্নত রাখা ও মানবাধিকারের প্রতি সম্মান বজায় রেখে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের সঙ্গে কাজ করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।’

বৃহস্পতিবার ঢাকায় অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে প্রশ্নের উত্তরে উজরা জেয়া বলেন, প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারের সব মন্ত্রীর কাছ থেকে অবাধ, স্বচ্ছ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের বিষয়ে দৃঢ় অঙ্গীকার শুনেছি। যুক্তরাষ্ট্রের বৈশ্বিক মানবাধিকার নীতি হলো অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনকে সমর্থন করা। বাংলাদেশের অংশীদার হিসেবে অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন নিশ্চিতে ভূমিকা রাখার কথা জানান তিনি।

উজরা জেয়ার সফরে কী বার্তা পাওয়া গেল– জানতে চাইলে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক সাহাব এনাম খান বলেন, এ সফর দুই দেশের অভিন্ন রাজনৈতিক বিষয়ে গঠনমূলক আলোচনার পথকে আরও প্রশস্ত করেছে। এটা দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক আরও জোরদারের জন্য জরুরি ছিল। সরকারের পক্ষ থেকে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন এবং ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন (ডিএসএ) সংশোধনের যে নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে, তা ইতিবাচক ফল হিসেবে দেখা যেতে পারে।

তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের নির্বাচনী প্রক্রিয়া আরও গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করবে। ক্ষমতাসীন দলের জ্যেষ্ঠ নেতাদের পক্ষ থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে যে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে, তা বাস্তবায়নের ওপর নির্ভর করবে– দেশটি থেকে আগামীর প্রতিক্রিয়া কী আসবে। বাংলাদেশের নির্বাচন বিষয়ে এখন পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানের কোনো পরিবর্তন আসেনি। তবে তা আঞ্চলিক দেশগুলোর অবস্থানের থেকে আলাদা।

বাংলাদেশ সফরকালে উজরা জেয়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান, পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন এবং বাংলাদেশ সরকারের অন্যান্য ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এ ছাড়া তিনি শ্রমিক নেতা, নাগরিক সমাজের নেতা এবং মানবাধিকারকর্মীদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন।

বৈঠকগুলোতে উজরা জেয়া বাংলাদেশের অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের লক্ষ্য অর্জনে একসঙ্গে কাজ করার ওপর জোর দেওয়ার পাশাপাশি নাগরিক সমাজের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা, মানবাধিকার রক্ষাকর্মী, সাংবাদিক ও শ্রমিক আন্দোলনের কর্মীদের নিরাপত্তার গুরুত্ব; মানবাধিকার লঙ্ঘনে জবাবদিহি থাকা এবং রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য সমর্থন অব্যাহত রাখার প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন।

বাংলাদেশের গণতন্ত্র ও মানবাধিকার নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানের পরিবর্তন হয়েছে বলে মনে করেন না সাবেক রাষ্ট্রদূত এম. হুমায়ুন কবির। তিনি বলেন, তাদের বার্তায় কোনো ধরনের পরিবর্তন লক্ষ্য করিনি। বরং বাংলাদেশকে ভেতর ও বাইরে– দুই দিক থেকেই তারা দেখতে চেষ্টা করেছে। দুই দেশের বিগত ৫০ বছর এবং সামনের ৫০ বছরের অংশীদারিত্বকে ওয়াশিংটন গুরুত্ব সহকারে নেয়। সেই প্রেক্ষাপটে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া, শান্তিপূর্ণ নির্বাচন, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, নাগরিক অধিকার এবং মানবাধিকারের মতো বিষয়গুলোর ওপর যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে অংশগ্রহণমূলক বাংলাদেশ তৈরি হলে সামনের দিনে গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হবে ঢাকা। সেই বার্তাই যুক্তরাষ্ট্র দিয়েছে।

সাবেক এ কূটনীতিক বলেন, যুক্তরাষ্ট্র এ ক্ষেত্রে ইন্দো-প্যাসিফিককে সামনে নিয়ে এসেছে। শুধু বাংলাদেশের ভেতরে নয়; এ অঞ্চলে যে রকম দায়িত্ব পালন করা দরকার, বাংলাদেশ তা করতে পারলে যথাযথ সুবিধাগুলো বাংলাদেশ পেতে পারে। যুক্তরাষ্ট্র মনে করে, ঢাকা ও দিল্লি দুই জায়গাতে মানবাধিকার, নাগরিক অধিকার ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা শক্তিশালী হওয়া দরকার এবং এটি হলে দক্ষিণ এশিয়া ও ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের জন্য ইতিবাচক ভূমিকা পালন করতে পারে দুই দেশ। এ কথা উজরা জেয়া ভারত ও বাংলাদেশে বলেছেন। এ নিয়ে সক্রিয়ভাবে ওয়াশিংটন ভূমিকা রাখবে– সে বার্তাও দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। বিশেষ করে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে যা যা করা প্রয়োজন, তা করবে দেশটি। এটি নির্বাচন ও সংলাপ কিংবা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে শক্তিশালী করার ক্ষেত্রে হতে পারে। আগামী দিনের স্থিতিশীল ও শান্তিপূর্ণ বাংলাদেশ গড়তে তারা পাশে থাকবে– তা জোরের সঙ্গে জানান দিয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের আন্ডার সেক্রেটারি কক্সবাজারে রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবির পরিদর্শন ও সেখানকার সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গেও কথা বলেন। তিনি রোহিঙ্গা সংকট মোকাবিলায় মিয়ানমার এবং বাংলাদেশের উদ্যোগের সমর্থনে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে আরও ৭৪০ কোটি টাকা অনুদানের ঘোষণা দিয়েছেন। এর মধ্যে প্রায় ৬১০ কোটি টাকা মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গা, বাংলাদেশের রোহিঙ্গা শরণার্থী এবং তাদের আশ্রয়দানকারী জনগোষ্ঠী ও অন্যদের সহায়তার জন্য দেওয়া হবে।

উজরা জেয়া ফ্রিডম ফান্ড এবং এর অংশীদারদের জন্য স্টেট ডিপার্টমেন্ট থেকে ১০ লাখ ডলার অনুদান ঘোষণা করেন। এই টাকা মানব পাচারকারীদের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া পাঁচ শতাধিক শিশুকে সমাজে পুনরেকত্রীকরণ কর্মসূচিতে ব্যবহার করা হবে। মার্কিন প্রতিনিধি দলটি গতকাল শুক্রবার ঢাকা ছাড়ে।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সূত্র জানায়, সরকারের প্রতিটি পর্যায়ের বৈঠকে নির্বাচন নিয়ে আলোচনা হয়েছে। বৈঠকগুলোতে সরকারের পক্ষ থেকে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি তুলে ধরা হয়েছে। সেই সঙ্গে কীভাবে সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে– তার ব্যাখ্যা করা হয়েছে। সরকারের প্রতিশ্রুতির প্রশংসা করেছে মার্কিন প্রতিনিধি দল। সেই সঙ্গে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে জোরদারের তাগিদ দিয়েছে। এগুলো জোরদারে সহযোগিতা করার কথা জানিয়েছে।

সূত্র জানায়, বৈঠকে রোহিঙ্গা বিষয়ে সবচেয়ে বেশি আলোচনা হয়েছে। এর একমাত্র সমাধান প্রত্যাবাসনে– এ বিষয়ে দুই পক্ষই একমত। রোহিঙ্গা নিয়ে বাংলাদেশ বর্তমানে যে চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করছে, তা তুলে ধরেছে। এ ছাড়া বৈঠকে শ্রমিক নেতা শহিদুল ইসলাম হত্যার বিষয়ে মার্কিন উদ্বেগ তুলে ধরা হয়। সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচারের তাগিদ জানানো হয়। এ ঘটনার বিচার নিশ্চিতে বাংলাদেশ পদক্ষেপগুলো তুলে ধরেছে।

বাংলাদেশের অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন বিষয়ে উজরা আশ্বস্ত হয়েছেন কিনা– জানতে চাইলে বৈঠকগুলোতে উপস্থিত এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি শুনেছেন এবং প্রতিশ্রুতিকে সাধুবাদ জানিয়েছেন। তবে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন বিষয়ে আশ্বস্ত হয়েছেন– এ কথা বলা যাবে না।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.