বায়োগ্যাস: সম্ভাবনার মাত্র আড়াই শতাংশ কাজে লাগছে

0
111
বায়োগ্যাস প্ল্যান্ট

বায়োগ্যাসকে পরিবেশবান্ধব জ্বালানি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। একটি পরিবারের জন্য ছোট আকারের একটি বায়োগ্যাস প্ল্যান্ট স্থাপনে ৩০-৫০ হাজার টাকা খরচ পড়তে পারে।

এটি বেশ লাভজনক। কারণ, গরুর গোবর দিয়েই গ্যাস হচ্ছে। গ্যাস না তৈরি করলে গোবরগুলো ফেলে দিতে হতো।
হোসেন আহমেদ চৌধুরী, উদ্যোক্তা, মুন্সিগঞ্জ

এই খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রথম বায়োগ্যাস প্ল্যান্টটি চালু হয়েছিল ১৯৭২ সালে, ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে। কিন্তু এর পরের ৫০ বছরে এ-সংক্রান্ত প্রযুক্তিটি সারা দেশে প্রত্যাশা অনুযায়ী ছড়িয়ে দেওয়া যায়নি।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানিয়েছেন, এখন বাসাবাড়িতে যেসব প্ল্যান্ট আছে, এর বেশির ভাগই স্থাপন করেছে ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি লিমিটেড (ইডকল)। গবাদিপশু ও পোলট্রি বর্জ্য বায়োগ্যাস উৎপাদনের জন্য খুবই কার্যকর। বাংলাদেশে যে পরিমাণ গবাদিপশুর খামার ও পোলট্রি বর্জ্য উৎপাদিত হয়, সেগুলো কাজে লাগাতে পারলেও ব্যাপক হারে বায়োগ্যাস উৎপাদন করা সম্ভব। সেই হিসাবে বাংলাদেশে ৪০ লাখ বায়োগ্যাসের প্ল্যান্ট স্থাপনের সুযোগ আছে।

প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুসারে, গত মে মাস পর্যন্ত সারা দেশে ৮২ হাজার ২৫৩টি গবাদিপশুর খামার এবং ৮৭ হাজার ৮১৩টি হাঁস-মুরগির খামারের নিবন্ধন দেওয়া হয়েছে। তবে নিবন্ধিত খামারের বাইরেও ব্যক্তি উদ্যোগে অনেক খামার গড়ে উঠেছে। এসব খামার থেকে প্রতিদিন কয়েক হাজার টন বর্জ্য উৎপাদিত হয়, যা বায়োগ্যাস ও জৈব সার উৎপাদনে কাজে লাগানো যেতে পারে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশ স্বাধীনের পরপরই বায়োগ্যাস প্ল্যান্ট স্থাপন নিয়ে কাজ শুরু হলেও সঠিক নির্দেশনার অভাবে এ খাত প্রত্যাশা অনুযায়ী জনপ্রিয় হয়নি। এমনকি দুই দশক আগেও খাতটিকে সেভাবে গুরুত্বও দেওয়া হয়নি। তাঁদের মতে, প্ল্যান্ট স্থাপনের পর সেটি নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ করতে হয়, বর্জ্য ফেলতে হয়। সহজ বিকল্প থাকায় অনেকেই এই কষ্ট করতে চান না। সিলিন্ডার গ্যাস বা কাঠ-খড়কে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করেন।

বিভিন্ন এনজিও থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০১১ সালে সারা দেশে ৪২ হাজারের মতো বায়োগ্যাসের প্ল্যান্ট ছিল। ২০১৫ সালে এটি ৬০ হাজারের মতো হয়। ২০২০ সালে এই সংখ্যা ৭৬ হাজারে পৌঁছায়। পরের তিন বছরে এটি বেড়ে এক লাখের কাছাকাছি হয়েছে।

১৯৯৪ সালে ইডকলের প্রতিষ্ঠা পর নবায়নযোগ্য জ্বালানি হিসেবে বায়োগ্যাসের ব্যবহার দেশে বাড়তে থাকে। এর সঙ্গে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানও যোগ দেয়। আর বাংলাদেশের নবায়নযোগ্য জ্বালানির নীতিমালাটি হয় ২০০৮ সালে।

স্রেডার তথ্য অনুযায়ী, জৈব পদার্থগুলো পচনের ফলে যে বিভিন্ন গ্যাস পাওয়া যায়, তার একটি মিশ্রিত রূপ হচ্ছে বায়োগ্যাস। সাধারণভাবে কৃষি বর্জ্য, জৈব সার, পৌর বর্জ্য, উদ্ভিদ সৃষ্ট উপকরণ, নর্দমার বর্জ্য, সবুজ বর্জ্য বা খাদ্য বর্জ্য ইত্যাদি কাঁচামাল থেকে বায়োগ্যাস উৎপন্ন হয়। বায়োগ্যাস প্ল্যান্ট থেকে রান্নার গ্যাসের পাশাপাশি শস্য ও মাছের পুকুরের জন্য জৈব সারও মেলে। বাংলাদেশ ব্যাংক ও  ইডকল বায়োগ্যাস খাতে বিনিয়োগ করে। এ ছাড়া বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদ (বিসিএসআইআর), জিআইজেড, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর, বিভিন্ন এনজিও এবং যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর বায়োগ্যাস প্ল্যান্ট স্থাপনের সঙ্গে যুক্ত আছে।
প্রত্যাশা অনুযায়ী বায়োগ্যাসের প্রসার না হওয়ার কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে বিসিএসআইআরের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মো. আফতাব আলী শেখ বলেন, ‘বায়োগ্যাসের প্ল্যান্ট নিয়ে আমরা অনেক দূর এগিয়েছিলাম। অনেক গবেষণাও হয়েছে। কিন্তু এটি টেকসই করার জন্য যেমন অবকাঠামো প্রয়োজন, সেটি হয়নি। এ ছাড়া বায়োগ্যাস নিয়ে প্রচার-প্রচারণারও অভাব আছে।’

বায়োগ্যাসের লাভ

বায়োগ্যাসকে পরিবেশবান্ধব জ্বালানি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। একটি পরিবারের জন্য ছোট আকারের একটি বায়োগ্যাস প্ল্যান্ট স্থাপনে ৩০-৫০ হাজার টাকা খরচ পড়তে পারে। ইডকল বলছে, বায়োগ্যাসের প্ল্যান্ট স্থাপন করতে চাইলে এই প্রতিষ্ঠান থেকে ৯ হাজার টাকা পর্যন্ত ভর্তুকি দেওয়া হয়। ফলে অতিরিক্ত যে টাকা বিনিয়োগ করা হবে, তা পরের দুই বছরের মধ্যেই উঠে আসবে। বায়োগ্যাস প্ল্যান্ট একবার স্থাপন করা হয়ে গেলে সেখান থেকে ২০-২৫ বছর পর্যন্ত গ্যাস পাওয়া যায়। ফলে পরিবেশ রক্ষার পাশাপাশি রান্নার কাজে প্রতি মাসের খরচটিও বেঁচে যায়।

ইডকল, স্রেডাসহ এই খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করে জানা গেছে, দেশে বায়োগ্যাস প্ল্যান্টের সংখ্যা ধীরে ধীরে বাড়ছে। তবে এই সময়ে অনেক প্ল্যান্ট অচলও হয়ে গেছে। বিভিন্ন এনজিও থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০১১ সালে সারা দেশে ৪২ হাজারের মতো বায়োগ্যাসের প্ল্যান্ট ছিল। ২০১৫ সালে এটি ৬০ হাজারের মতো হয়। ২০২০ সালে এই সংখ্যা ৭৬ হাজারে পৌঁছায়। পরের তিন বছরে এটি বেড়ে এক লাখের কাছাকাছি হয়েছে। এ ছাড়া খামারভিত্তিক বায়োগ্যাস প্ল্যান্ট করার আগ্রহও আগের চেয়ে বেড়েছে বলে জানিয়েছেন বিসিএসআইআরের কর্মকর্তারা।

মুন্সিগঞ্জের সিরাজদিখানের চৌধুরী অ্যাগ্রো অ্যান্ড ডেইরি ফার্মের উদ্যোক্তা হোসেন আহমেদ চৌধুরী বলেন, বিসিএসআইআরের কাছ থেকে কারিগরি সহায়তা নিয়ে ১০ বছর আগে তাঁরা একটি প্ল্যান্ট করেছেন। খামারের কর্মচারীসহ নিজেদের বাড়ির রান্নাও হয় এই প্ল্যান্টের গ্যাসে। তিনি বলেন, এটি বেশ লাভজনক। কারণ, গরুর গোবর দিয়েই গ্যাস হচ্ছে। গ্যাস না তৈরি করলে গোবরগুলো ফেলে দিতে হতো।

বিদ্যুৎ উৎপাদনে গতি নেই

বায়োগ্যাসের মতোই পশু ও পৌর বর্জ্যের পাশাপাশি তুষ, ফসলের অবশিষ্টাংশ, পাটকাঠি, আখের ছোবড়া ব্যবহার করে বিদ্যুৎও উৎপাদন করা যায়। প্রযুক্তিটি বায়োমাস থেকে বিদ্যুৎ—নামে পরিচিত। স্রেডার তথ্য অনুযায়ী,এখন বায়োগ্যাস বা বায়োমাস থেকে সারা দেশে মাত্র শূন্য দশমিক ৪ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়। যদিও ২০২১ সালের মধ্যে এই খাত থেকে ৩১ দশমিক শূন্য ৮ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছিল।

এই খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, এখন বায়োমাস থেকে যে পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হচ্ছে, সেগুলো মূলত আসে ৮টি প্ল্যান্ট থেকে। ২০১০ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত সময়ে প্ল্যান্টগুলো স্থাপন করা হয়েছে। সব কটির সঙ্গেই যুক্ত ছিল ইডকল, প্ল্যান্টগুলো থেকে উৎপাদিত বিদ্যুৎ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানই ব্যবহার করে, এসবের সঙ্গে বিদ্যুতের জাতীয় গ্রিডের কোনো সংযোগ নেই।

লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী বিদ্যুৎ উৎপাদন না হওয়া সম্পর্কে জানতে চাইলে স্রেডার চেয়ারম্যান মুনীরা সুলতানা বলেন, বায়োমাস নিয়ে এখন কাজ হচ্ছে না। এর আগে বায়োমাস নিয়ে একটি সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে দেখা গেছে, বায়োমাস থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন লাভজনক হয় না। তাই আপাতত সৌর ও বায়ুবিদ্যুৎ নিয়েই কাজ করা হচ্ছে।

জানতে চাইলে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা সংস্থা ইনস্টিটিউট ফর এনার্জি ইকোনমিকস অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল অ্যানালাইসিসের জ্বালানি বিশ্লেষক শফিকুল আলম বলেন, বায়োমাস থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের বিষয়ে ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। কারণ, বায়োমাসের বিকল্প ও বিবিধ ব্যবহার আছে, এগুলো ফেলে দেওয়া হয় না। তবে পরিবেশদূষণ ও মানুষের স্বাস্থ্যের কথা বিবেচনায় নিয়ে খরচ বেশি হলেও গৃহস্থালি বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনে জোর দেওয়া উচিত। কারণ, ল্যান্ড ফিল্ডে জমা হওয়া বর্জ্য মানুষ ও পরিবেশের ক্ষতি করে। এ ব্যাপারের সরকারের উদ্যোগ আছে, সিটি করপোরেশনগুলোর মাধ্যমে এ কাজ করা যেতে পারে। এ ছাড়া দেশের পোলট্রি খামারের বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে, যাতে পোলট্রি খামারগুলো নিজেদের উৎপাদিত বিদ্যুতে চলতে পারে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.