নির্বাচন ও মানবাধিকারে গুরুত্ব

0
81
ইমোন গিলমোর ও উজরা জেয়া

এ মাসে ঢাকায় আসছে যুক্তরাষ্ট্র ও ইইউর চার প্রতিনিধিদল। আলোচনায় গুরুত্ব পাবে সুষ্ঠু নির্বাচন ও মানবাধিকার সুরক্ষা।

আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন যাতে অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণভাবে অনুষ্ঠিত হয়, তা নিয়ে বেশ কিছুদিন ধরেই যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপের দেশগুলো ধারাবাহিকভাবে বাংলাদেশকে তাগিদ দিয়ে যাচ্ছে। এরই অংশ হিসেবে চলতি মাসেই যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের চারটি প্রতিনিধিদল ঢাকা সফরে আসার কথা রয়েছে।

সফরকালে এই চার প্রতিনিধিদলের আলোচনায় সুষ্ঠু নির্বাচন এবং সামগ্রিক মানবাধিকার সুরক্ষার মতো বিষয়গুলো গুরুত্ব পাবে বলে ঢাকা, ওয়াশিংটন ও ব্রাসেলসের কূটনৈতিক সূত্রগুলো থেকে আভাস পাওয়া গেছে।

এর মধ্যে চলতি মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে আসছেন বেসামরিক নিরাপত্তা, গণতন্ত্র ও মানবাধিকারবিষয়ক মার্কিন আন্ডার সেক্রেটারি উজরা জেয়া। তৃতীয় সপ্তাহ বা কাছাকাছি সময়ে আসার কথা রয়েছে দেশটির অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, জ্বালানি ও পরিবেশবিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি হোসে ফার্নান্দেজের। কাছাকাছি সময়েই আসছে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) দুটি প্রতিনিধিদল।

যুক্তরাষ্ট্র যখন গণতন্ত্র ও সুষ্ঠু নির্বাচনের বিষয়ে ততটা সোচ্চার ছিল না, তখনো এই বিষয়গুলোতে ইইউ সরব ছিল। তবে এটাও ঠিক যে বড় কোনো পদক্ষেপ গ্রহণের ক্ষেত্রে ইইউ এককভাবে কিছু করতে পারে না। তবে যুক্তরাষ্ট্র কোনো পদক্ষেপ নিলে ইইউ তাতে যুক্ত থাকতে পারে।
সাবেক পররাষ্ট্রসচিব মো. তৌহিদ হোসেন

কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে, উজরা জেয়ার চার দিনের এই সফরে সফরসঙ্গী হিসেবে দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক সহকারী মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লুর আসার কথা রয়েছে। গত জানুয়ারির পর এটি হবে বাংলাদেশে ডোনাল্ড লুর দ্বিতীয় ঢাকা সফর। ১০ জুলাই থেকে প্রস্তাবিত এই সফরের সময় উজরা জেয়া ঢাকায় পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেনের সঙ্গে আলোচনার পাশাপাশি রাজনীতিবিদ এবং নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে মতবিনিময় করবেন বলে জানা গেছে।

এরপর আসার কথা রয়েছে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, জ্বালানি ও পরিবেশবিষয়ক মার্কিন আন্ডার সেক্রেটারি হোসে ফার্নান্দেজের। তিনি ঢাকা সফরের সময় বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র ব্যবসায়ী পরিষদের বৈঠকে যোগ দেবেন। প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের সঙ্গেও বসতে পারেন।

এদিকে বাংলাদেশের আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পর্যবেক্ষক পাঠানোর বিষয়টি মূল্যায়নের জন্য ৯ জুলাই চার সদস্যের স্বাধীন বিশেষজ্ঞ দল আসবে ইউরোপ থেকে। আর ২৪ জুলাই থেকে কয়েক দিনের সফরে আসছেন ইউরোপীয় ইউনিয়নের মানবাধিকারবিষয়ক বিশেষ প্রতিনিধি ইমোন গিলমোর। তিনি আইনমন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং নাগরিক সমাজের সঙ্গে বৈঠক করতে পারেন বলে কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে।

চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে (জুন মাস বাদে) প্রায় ধারাবাহিকভাবে বিভিন্ন স্তরের মার্কিন কর্মকর্তারা ঢাকা ঘুরে গেছেন। পাশাপাশি ওয়াশিংটনে গেছেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন ও পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেন।

ঢাকায় ইইউ রাষ্ট্রদূত চার্লস হোয়াটলি গতকাল রোববার বিকেলে ইউরোপীয় ইউনিয়নের দুটি পৃথক প্রতিনিধিদলের বাংলাদেশ সফরের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, এর আগে ইইউর জ্যেষ্ঠ প্রতিনিধি জোসেফ বোরেল বাংলাদেশের আসন্ন নির্বাচনে পর্যবেক্ষক পাঠাতে প্রস্তুতির কথা জানিয়েছিলেন। তাই বাংলাদেশের নির্বাচনে পর্যবেক্ষক পাঠানোর বিষয়টি মূল্যায়নের জন্য ইইউর স্বাধীন বিশেষজ্ঞ দলটি ঢাকা সফরে আসছে।

চার্লস হোয়াটলি জানান, বিশেষজ্ঞ দলটি ঢাকায় বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, নাগরিক সমাজ ও গণমাধ্যমের সঙ্গে মতবিনিময় করবে। এখানে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের পরিস্থিতি দলটির সদস্যরা দেখবেন। পরিস্থিতি মূল্যায়ন করে তাঁদের মতামত ইইউর জ্যেষ্ঠ প্রতিনিধি জোসেফ বোরেলের কাছে জমা দেবেন। ওই মূল্যায়নের ভিত্তিতে বাংলাদেশে নির্বাচন পর্যবেক্ষণের জন্য ইইউ মিশন পাঠানো হবে কি না, সে বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবেন জোসেফ বোরেল।

বিশেষ নজর মার্কিন দুই কর্মকর্তার সফরে

চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে (জুন মাস বাদে) প্রায় ধারাবাহিকভাবে বিভিন্ন স্তরের মার্কিন কর্মকর্তারা ঢাকা ঘুরে গেছেন। পাশাপাশি ওয়াশিংটনে গেছেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন ও পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেন। এর আগে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে ২০২১ সালে র‌্যাব এবং বাহিনীটির কয়েকজন সাবেক ও বর্তমান কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞাকে ঘিরে দুই দেশের সম্পর্কে টানোপোড়েন শুরু হয়। কিন্তু চলতি বছরের জানুয়ারিতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের বিশেষ উপদেষ্টা রিয়ার অ্যাডমিরাল এইলিন লউবেখার এবং সহকারী মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লুর সফরের মধ্য দিয়ে র‌্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞাকে ঘিরে যে অস্বস্তি, তা কাটতে শুরু করে।

ডোনাল্ড লু ঢাকা সফরে এসে গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সুরক্ষার চ্যালেঞ্জগুলো নিয়ে খোলামেলা আলোচনায় জোর দিয়েছিলেন। মধ্য ও দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ মার্কিন ওই কর্মকর্তার অবস্থানে এটা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল যে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের বিষয়গুলো সমুন্নত রাখার ওপর বাইডেন প্রশাসনের অবস্থান অটুট থাকবে।

এরপর গত ২৪ মে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন বাংলাদেশ সম্পর্কিত নতুন ভিসা নীতি ঘোষণা করেন। যার মধ্য দিয়ে এমন বার্তা দেয় যে বাংলাদেশের অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণভাবে জাতীয় নির্বাচনের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানের হেরফের হবে না।

ভিসা নীতি ঘোষণার দেড় মাস পর মার্কিন আন্ডার সেক্রেটারি উজরা জেয়ার সফর এবং ডোনাল্ড লু নিয়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে কৌতুহল রয়েছে।

কূটনৈতিক সূত্র বলছে, ঢাকায় অবস্থানের সময় উজরা জেয়া পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন, পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেনসহ রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ এবং নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে মতবিনিময় করবেন। এতে নির্বাচন, গণতন্ত্র, নাগরিক অধিকারসহ মানবাধিকারের নানা বিষয়ে আলোচনা হবে। এ ছাড়া উজরা জেয়ার কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শরণার্থীশিবিরে যাওয়ার কথাও রয়েছে।

কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে, অপর মার্কিন আন্ডার সেক্রেটারি হোসে ফার্নান্দেজ বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র ব্যবসায়ী পরিষদের বৈঠকে অংশ নিতে ঢাকায় এলেও সরকারের উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধি, নাগরিক সমাজ এবং শ্রমিক প্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলবেন তিনি। এ সময় তিনি ব্যবসার পরিবেশের উন্নয়ন, শ্রম অধিকার ও মানবাধিকার সুরক্ষার বিষয়গুলোতে জোর দেবেন।

যুক্তরাষ্ট্র ও ইইউর উচ্চপর্যায়ের এসব সফরের বিষয়ে সাবেক পররাষ্ট্রসচিব মো. তৌহিদ হোসেন বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক পদক্ষেপে এটা স্পষ্ট যে বাংলাদেশের নির্বাচনের বিষয়ে তাদের অবস্থান অতীতের চেয়ে এবার ভিন্ন। তারা যে সুষ্ঠু নির্বাচন চায়, এটি নিশ্চিত করতে তারা বাংলাদেশের জন্য নতুন ভিসা নীতি ঘোষণা করেছে। পাশাপাশি এ অঞ্চলের দেশগুলোর জন্য গুরুত্বপূর্ণ সহকারী মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লুর ছয় মাসের মধ্যে দ্বিতীয় ঢাকা সফরটিও তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ, বাংলাদেশকে যে যুক্তরাষ্ট্র বিশেষভাবে গুরুত্ব দিচ্ছে, ডোনাল্ড লুর সফরে আগের বার্তা পাওয়া যায়।

ইইউর অবস্থান সম্পর্কে তৌহিদ হোসেন বলেন, যুক্তরাষ্ট্র যখন গণতন্ত্র ও সুষ্ঠু নির্বাচনের বিষয়ে ততটা সোচ্চার ছিল না, তখনো এই বিষয়গুলোতে ইইউ সরব ছিল। তবে এটাও ঠিক যে বড় কোনো পদক্ষেপ গ্রহণের ক্ষেত্রে ইইউ এককভাবে কিছু করতে পারে না। তবে যুক্তরাষ্ট্র কোনো পদক্ষেপ নিলে ইইউ তাতে যুক্ত থাকতে পারে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.