দুর্লভ চলচ্চিত্র সংরক্ষণের পাশাপাশি নায়ক-নায়িকাদের স্মৃতিচিহ্নের দেখা মেলে যেখানে

0
125
ফিল্ম পরীক্ষা–নিরীক্ষা করছেন ‘ফিল্ম চেকার’ শাহজাহান কবীর মজুমদার

কিছুক্ষণ পর পর মেশিনের চাকা ঘুরাচ্ছিলেন আর ম্যাগনিফাইং গ্লাস চোখের সামনে ধরে সেলুলয়েডের ফিতা পরীক্ষা করছিলেন শাহজাহান কবীর মজুমদার। তাঁর গায়ে সাদা অ্যাপ্রন, মুখে মাস্ক, হাতে গ্লাভস।

গত শতকের বিভিন্ন দশকে নির্মিত ৩৫ মিমি, ১৬ মিমি ফরম্যাটের চলচ্চিত্রগুলোর ফিল্ম ঘষামাজা ও মেরামতের কাজ করেন তিনি। ফিল্ম হাসপাতালের পরীক্ষা কক্ষে তাঁর এই পরীক্ষা–নিরীক্ষা শেষ হলে তা আর্কাইভের ভল্টে চলে যাবে সংরক্ষণের জন্য।

শাহজাহান কবীরের পদবি ‘ফিল্ম চেকার’। তিনি বললেন, পুরোনো ফিল্ম পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে আনা, সম্পাদনা এমনকি প্রয়োজনে পুনর্নির্মাণ করাসহ বিভিন্ন কাজের জন্য এই হাসপাতাল তৈরি করা হয়েছে।

গত ২২ জুন রাজধানীর আগারগাঁওয়ে বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভে গিয়ে কথা হলো ফিল্ম চেকার শাহজাহান কবীর মজুমদারের সঙ্গে।

বাইরে গরমে হাঁসফাঁস অবস্থা হলেও ফিল্ম হাসপাতাল থেকে ভল্টে ঢুঁ দিয়ে দেখা গেল, মাইনাস আট ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার ভল্টে কর্মীরা শীতের দেশের মতো পোশাক পরে কাজ করছেন। নির্দিষ্ট পোশাক না পরে ঢোকায় কিছুক্ষণের মধ্যেই মনে হলো হাত কুঁকড়ে যাচ্ছে। তাই সেখান থেকে দ্রুত বের হতে হলো।

ভল্টে এভাবে ফিল্মগুলো সংরক্ষণ করা হচ্ছে
ভল্টে এভাবে ফিল্মগুলো সংরক্ষণ করা হচ্ছে

এই ভল্টসহ ০, ৮, ৪, ১২ ও মাইনাস ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার মোট ছয়টি ভল্ট আছে সেখানে। এগুলোতে ৩৫ মিমি ও ১৬ মিমি ফরম্যাটের চলচ্চিত্রগুলো সংরক্ষণ করা হয়েছে। এর মধ্যে আছে ১৯৫৯ সালের ‘জাগো হুয়া সাভেরা’, ১৯৬০ সালে নির্মিত ‘আসিয়া’, বিশ্বের প্রথম চলচ্চিত্র দি লুমিয়ের ব্রাদার্স (১৮৯৫), পূর্ব বাংলার প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য সবাক চলচ্চিত্র মুখ ও মুখোশ (১৯৫৬), কাজী নজরুল ইসলাম অভিনীত ধ্রুবসহ (১৯৩৪) অনেক দুর্লভ চলচ্চিত্র।

গত শতকের বিভিন্ন দশকে মুক্তি পাওয়া চলচ্চিত্রের দুর্লভ পোস্টারসহ নানা কিছু ভল্টে সংরক্ষিত আছে। ঢাকায় নির্মিত প্রথম স্বল্পদৈর্ঘ্যের নির্বাক চলচ্চিত্র ‘সুকুমারী’ ও পূর্ণদৈর্ঘ্যের নির্বাক চলচ্চিত্র ‘দ্য লাস্ট কিস’–এর দুটি মূল্যবান ও দুষ্প্রাপ্য স্থিরচিত্রও আছে। একটি ভল্টে বঙ্গবন্ধু কর্নারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ওপর নির্মিত বিভিন্ন ধরনের প্রামাণ্যচিত্র, তথ্যচিত্র ও সংবাদচিত্র সংরক্ষণ করা হয়েছে। এই সংরক্ষণের জন্য সিডি, ডিভিডি, ভিএইচ, ডিভি ক্যাম, হার্ড ড্রাইভসহ বিভিন্ন ফরম্যাট ব্যবহার করা হচ্ছে।

ভবনের বিভিন্ন তলায় ঘুরতে ঘুরতে এক জায়গায় থামতে হলো। বিভিন্ন চলচ্চিত্রের পোস্টার দিয়ে সিনেমা হলের আদলে জায়গাটি সাজানো। দরজা ধাক্কা দিয়ে অন্ধকার হলটিতে ঢুকে দেখা গেল ‘যাদুর বাঁশি’ চলচ্চিত্রটি দেখানো হচ্ছে। প্রতি বৃহস্পতিবার দর্শকদের বিনা মূল্যে চলচ্চিত্র দেখানোর ব্যবস্থা করা হয়। তবে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলেছেন, বরাবরই সেখানে দর্শক উপস্থিতি কম থাকে।

আর্কাইভের লাইব্রেরিতে বিভিন্ন দশকের পত্রিকা
আর্কাইভের লাইব্রেরিতে বিভিন্ন দশকের পত্রিকা

কলাকুশলীদের স্মৃতিস্মারক

বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভ এ পর্যন্ত ১১৮টি গবেষণা এবং ১৯টি চলচ্চিত্রবিষয়ক জার্নালসহ ৭০টি বই প্রকাশ করেছে। ৫৪ জন চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্বের জীবনভিত্তিক ডকুমেন্টারি তৈরি করা হয়েছে।

২০২০ সালের অক্টোবর মাসে যাত্রা শুরু করা দেশের একমাত্র চলচ্চিত্র বা ফিল্ম জাদুঘরও এই আর্কাইভ ভবনেই অবস্থিত। এখানে বিভিন্ন চলচ্চিত্র ও কলাকুশলীদের স্মারকগুলো রাখা আছে।

‘পদ্মাবতী’, ‘রাজসিংহাসন’, ‘সওদাগর’সহ বিভিন্ন চলচ্চিত্রে বন্দুক নিয়ে মারামারির দৃশ্য ছিল। সেই ‘প্রপস’ বন্দুকগুলো প্রযোজক এ কে এম জাহাঙ্গীর খান আর্কাইভকে দিয়েছেন।

পাকিস্তান ফিল্ম ট্রাস্টের স্বত্বাধিকারী মরহুম মোশাররফ হোসেন চৌধুরী ও সাইফুল ইসলাম চৌধুরী রাজশাহীতে উপহার সিনেমা হল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। মোশাররফ হোসেন চৌধুরীর ছেলে সাজিদ চৌধুরী হলের ৩৫ মিমি ফিল্মের প্রজেক্টরটি আর্কাইভকে দিয়েছেন।

১৯৫৬ সালে নির্মিত ‘মুখ ও মুখোশ’ চলচ্চিত্রের প্রযোজক নুরুজ্জামানের মেয়ে জেসমিন জামান একটি পিয়ানো দিয়েছেন। গত শতকের ৪০-এর দশকে নুরুজ্জামান পিয়ানোটি বাজাতেন। ’৬০ ও ’৭০–এর দশকে বিভিন্ন চলচ্চিত্রের সুরকার ও সংগীত পরিচালকেরা এই পিয়ানো ব্যবহার করেছেন।

বিভিন্ন চলচ্চিত্রের পোস্টার আর্কাইভে সংরক্ষণ করা আছে ছবি: প্রথম আলো
বিভিন্ন চলচ্চিত্রের পোস্টার আর্কাইভে সংরক্ষণ করা আছে

১৯৬৫ সালে ‘মালা’ চলচ্চিত্রের নায়িকা সুলতানা জামান যেসব গয়না পরেছিলেন, সেসব গয়না তিনি ১৯৮৯ সালে নিজেই ফিল্ম আর্কাইভকে দিয়েছিলেন। নায়ক রাজরাজ্জাকের ব্যবহার করা ব্লেজার, পাঞ্জাবি, চশমা, হ্যাট, অভিনেতা আজিমের ব্যবহার করা ঘড়ি, লাঠি, টাই, নায়িকা সুজাতার শাড়ি, ব্যাগ, হাতে লেখা স্ক্রিপ্ট, বাংলাদেশ শর্ট ফিল্ম ফোরামের ব্যবহার করা প্রজেক্টর, ক্যামেরা সেখানে আছে।

পরিচালক হারুন-উর রশিদ, পরিচালক ও প্রযোজক নার্গিস আক্তার, অভিনেত্রী ডলি জহুরসহ অনেকেই তাঁদের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারসহ বিভিন্ন পদক, চলচ্চিত্রসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পণ্য আর্কাইভে দিয়েছেন।

তবে ফিল্ম আর্কাইভের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, এখনো চলচ্চিত্রসংশ্লিষ্ট মানুষের মধ্যে সচেতনতা তেমন একটা নেই। আর্কাইভে সংরক্ষণের জন্য জিনিসগুলো দিলে তা সুরক্ষিত থাকবে। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম অতীত সম্পর্কে জানতে পারবে। নায়ক, নায়িকা বা সংশ্লিষ্টদের অনেকেই আক্ষেপ করে বলেন, তাঁরা যদি তাঁদের স্মৃতিস্মারকগুলো আরও আগেই আর্কাইভে দিতেন, তাহলে অনেক কিছু নষ্ট হতো না।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভের মহাপরিচালক মো. জসীম উদ্দিন বলেন, প্রতিষ্ঠানটির বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে জনবলের স্বল্পতা। মাত্র ৪৫ জনবল দিয়ে কার্যক্রম চালাতে হচ্ছে।

৫০টি নতুন পদ সৃজিত হয়েছে উল্লেখ করে জসীম উদ্দিন বলেন, এই জনবল নিয়োগ দেওয়া হলে আর্কাইভের কাজের পরিমাণ আরও বাড়ানো সম্ভব হবে।

আর্কাইভে চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্ট কারো ব্যক্তিগত জিনিসপত্র রাখার চেয়ে চলচ্চিত্রের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট যন্ত্রপাতিসহ অন্যান্য জিনিস রাখার দিকে মনোযোগ দিতে হবে। যাতে চলচ্চিত্রের অগ্রযাত্রার ধারাবাহিক কার্যক্রমগুলো স্পষ্ট হয়।

মানজারে হাসীন মুরাদ, শিক্ষক, বাংলাদেশ চলচ্চিত্র ও টেলিভিশন ইনস্টিটিউট

চলচ্চিত্র সংরক্ষণে বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন প্রয়োজন

চলচ্চিত্র ও চলচ্চিত্রসংশ্লিষ্ট সামগ্রী সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও গবেষণার মাধ্যমে চলচ্চিত্রকেন্দ্রিক ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি সংরক্ষণের জন্য ১৯৭৮ সালের ১৭ মে তথ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন ফিল্ম ইনস্টিটিউট ও আর্কাইভের যাত্রা শুরু হয়। ১৯৮৪ সালে বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভ নামকরণ করা হয়।

ফিল্ম আর্কাইভ কর্তৃপক্ষের দেওয়া তথ্য বলছে, বর্তমানে আর্কাইভে পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র (বাংলাদেশ, ভারত, চীনসহ অন্যান্য দেশের) মোট ৪ হাজার ২৫৮টি, স্বল্পদৈর্ঘ্যের ৭০৩টি, সংবাদচিত্র ১ হাজার ৭১৯টি এবং প্রামাণ্যচিত্র/তথ্যচিত্র ৩ হাজার ৭৪১টিসহ মোট সংগ্রহ দাঁড়িয়েছে ১০ হাজার ৪২১টিতে।

প্রামাণ্যচিত্র পরিচালক মানজারে হাসীন মুরাদ বলেন, ফিল্ম আর্কাইভের প্রধান কাজ দেশি ও বিদেশি চলচ্চিত্র সংরক্ষণ করা। তবে কোন যুক্তিতে টাকা ব্যয় করে চলচ্চিত্রটি সংরক্ষণ করা হচ্ছে, তা আগে নির্ধারণ করতে হবে। অর্থাৎ শুধু সংরক্ষণ করলেই চলবে না, তার পেছনে যুক্তি থাকতে হবে। চলচ্চিত্র সংরক্ষণের জন্য যাচাই-বাছাইয়ে একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করতে হবে।

নায়ক রাজ রাজ্জাকের ব্যবহৃত ব্লেজার, পাঞ্জাবি, চশমা ও হ্যাট আর্কাইভের জাদুঘরে সংরক্ষণ করা হয়েছে
নায়ক রাজ রাজ্জাকের ব্যবহৃত ব্লেজার, পাঞ্জাবি, চশমা ও হ্যাট আর্কাইভের জাদুঘরে সংরক্ষণ করা হয়েছে

বাংলাদেশ চলচ্চিত্র ও টেলিভিশন ইনস্টিটিউটের শিক্ষক মানজারে হাসীন মুরাদ বলেন, আর্কাইভে চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্ট কারো ব্যক্তিগত জিনিসপত্র রাখার চেয়ে চলচ্চিত্রের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট যন্ত্রপাতিসহ অন্যান্য জিনিস রাখার দিকে মনোযোগ দিতে হবে। যাতে চলচ্চিত্রের অগ্রযাত্রার ধারাবাহিক কার্যক্রমগুলো স্পষ্ট হয়। ফিল্ম আর্কাইভকে চলচ্চিত্র মাধ্যম সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা দিতে বিভিন্ন কোর্স চালু করতে হবে। এতে চলচ্চিত্র নিয়ে সাক্ষরতা বাড়বে। ফিল্ম আর্কাইভের গবেষণার বিষয় ও মানের দিকে লক্ষ্য রাখার পাশাপাশি আর্কাইভে দক্ষ জনবলের বিষয়েও গুরুত্ব দেন তিনি।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.