ক্রিকেট খেলার কথা বলে মালয়েশিয়ায় যান ২৭ জন, ফিরেছেন মাত্র দুজন

0
114
মানব পাচার

নাম জিয়াউল আলম (রনি)। তাঁর দাবি, তিনি ক্রিকেটার। ‘হেরিটেজ ক্রিকেটার্স’ নামের একটি ক্লাবের ব্যবস্থাপক তিনি। এ পরিচয় দিয়ে ২৬ জনকে নিয়ে মালয়েশিয়ায় গিয়েছিলেন ক্রিকেট খেলার কথা বলে। কিন্তু ফিরেছেন মাত্র দুজন। কথিত ওই ক্রিকেট দলের বাকি ২৫ সদস্যের খোঁজ পাওয়া যায়নি। পুলিশ বলছে, ক্রিকেট খেলার নাম করে জিয়াউল আলম আসলে মানব পাচার করেছেন।

জিয়াউল আলমসহ ২৭ সদস্যের দলটি মালয়েশিয়া যাওয়ার উদ্দেশে গত ১৫ জানুয়ারি হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছালে ইমিগ্রেশন পুলিশের সন্দেহ হয়। তখন জিয়াউল (৩৫) নিজেকে হেরিটেজ ক্লাবের ব্যবস্থাপক দাবি করে লিখিত অঙ্গীকার করেছিলেন, খেলা শেষে তাঁরা ৩০ জানুয়ারি দেশে ফিরে আসবেন। তবে জিয়াউল আলম এবং ওই দলের আরেক সদস্য পলাশ হোসেন ছাড়া আর কেউ দেশে ফেরেননি।

জিয়াউল দেশে ফেরেন নির্ধারিত সময়ের আড়াই মাস পর, ২৫ এপ্রিল। ওই সময় তাঁকে আটক করা হয়। পরদিন বিমানবন্দর থানায় তাঁর বিরুদ্ধে মানব পাচার প্রতিরোধ আইনে মামলা করে ইমিগ্রেশন পুলিশ। এ মামলায় তিন দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিয়াউলকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে বিমানবন্দর থানা–পুলিশ।

মামলার নথিপত্র ঘেঁটে দেখা যায়, মালয়েশিয়া যাওয়ার সময় জিয়াউল আলম ইমিগ্রেশন পুলিশকে দেওয়া অঙ্গীকারনামায় বলেছিলেন, মালয়েশিয়ার ‘পেরাক ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন’ তাঁদের আমন্ত্রণ জানিয়েছে। তাঁদের দল কুয়ালালামপুরে ১৬ থেকে ২২ জানুয়ারি একটি আন্তর্জাতিক টি–টোয়েন্টি টুর্নামেন্টে অংশ নেবে। এরপর ৩০ জানুয়ারি তাঁরা দেশে ফিরবেন।

গ্রেপ্তারের পর জিয়াউল আলম পুলিশকে বলেছেন, তাঁর সঙ্গে যাওয়া ‘ক্রিকেটাররা’ মালয়েশিয়ায় কোথায় অবস্থান করছেন, তা তিনি জানেন না।

হেরিটেজ ক্রিকেটার্স ক্লাবটি ঢাকার উত্তরার ৪ নম্বর সেক্টরের। মামলার নথি থেকে পাওয়া ক্লাবটির মুঠোফোন নম্বরে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। তবে নম্বরটি বন্ধ থাকায় ক্লাবের বক্তব্য জানা সম্ভব হয়নি। মামলার প্রধান আসামি জিয়াউল আলমের বাড়ি চট্টগ্রামের হাটহাজারী উপজেলায়। আরেক আসামি পলাশ হোসেন ঢাকার মিরপুরের বাসিন্দা। তবে তিনি কবে দেশে ফিরেছেন, তা জানাতে পারেনি পুলিশ।

এ ব্যাপারে হজরত শাহজালাল বিমানবন্দর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, মালয়েশিয়ায় মানব পাচারের সুনির্দিষ্ট অভিযোগে কথিত হেরিটেজ ক্রিকেটার্স ক্লাবের ব্যবস্থাপক জিয়াউলকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। সংঘবদ্ধ মানব পাচার চক্রের বাকি সদস্যদের শনাক্তের কাজ চলছে।

‘যখন একটি অখ্যাত ক্রিকেট ক্লাব মালয়েশিয়ায় আন্তর্জাতিক ক্রিকেট টুর্নামেন্ট খেলবে বলে জানাল, তখনই ইমিগ্রেশন পুলিশ বিষয়টি যাচাই করার জন্য বিসিবির সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারত’

মোহাম্মদ নুরুল হুদা, সাবেক মহাপরিদর্শক

এ মামলার বাদী বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশন উপপরিদর্শক মো. এনায়েত উল্লাহ। তিনি বলেন, মালয়েশিয়ায় ক্রিকেট খেলার পর প্রত্যেক ক্রিকেটারকে দেশে ফিরিয়ে আনার অঙ্গীকার করেছিলেন জিয়াউল আলম। বাস্তবে জিয়াউল, পলাশসহ কয়েকজন প্রতারণার মাধ্যমে আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার জন্য ক্রিকেটার বানিয়ে তাঁদের মালয়েশিয়ায় পাচার করেছেন।

মানব পাচারে জড়িত থাকার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন জিয়াউল আলম। আদালতের কাছে তিনি দাবি করেন, কোনো অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত নন।

বিমানবন্দর থানা-পুলিশের পক্ষ থেকে পাচার করা ২৫ জনের নামের তালিকা ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালতে জমা দেওয়া হয়েছে। তাঁরা হলেন তাজুল ইসলাম, মামুন শেখ, আশিক হাসান ওরফে জাহিদ, সাকিব হোসেন, শিমুল হোসেন, আকবার আলী, সাকিব আল হাসান, দিলার হোসেন, রাহাদ বাবু, শিমুল হাসান, জেহাদ উদ্দিন, হিমন ব্যাপারী, মো. ইমরান, বাবলুর রহমান, আলী মিয়া, মো. রহমান, সৈয়দ আলী, মো. সোহেল, সজিব হোসেন, রবিউল ইসলাম ও সোহেল রানা। এ ছাড়া হেরিটেজ ক্লাবের টিমের সদস্য বিল্লাল হোসেন, রাজু আহম্মেদ ও রুহুল আমিন।

তাঁদের সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য পুলিশের কাছে নেই। এ প্রসঙ্গে বিমানবন্দর থানার ওসি মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা তাঁদের তথ্য সংগ্রহ করার চেষ্টা করছি। মালয়েশিয়ায় তাঁরা কোথায় অবস্থান করছেন, সেটাও খুঁজে বের করার চেষ্টা করছি।’

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও বিমানবন্দর থানার উপপরিদর্শক (এসআই) আহসান উল্লাহ লিখিতভাবে আদালতকে বলেছেন, মালয়েশিয়ায় যে ২৫ বাংলাদেশিকে পাচার করা হয়েছে, তাঁরা কেউই ক্রিকেটার নন। বিমানযোগে তাঁদের মালয়েশিয়ায় পাচার করা হয়েছে। বহুবার জিয়াউল বিদেশে ভ্রমণ করলেও এর কারণ জানতে চাইলে তিনি কোনো ব্যাখ্যা দেননি।

যোগাযোগ করা হলে তদন্ত কর্মকর্তা আহসান উল্লাহ বলেন, জিয়াউল আলম নিজেকে ক্রিকেটার দাবি করেছেন। তবে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, তিনি একসময় পাইলট ছিলেন। তদন্ত কর্মকর্তা জানান, হেরিটেজ ক্রিকেটার্স ক্লাবটি সম্পর্কে জানতে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডে (বিসিবি) চিঠি দেওয়া হয়েছে। তাদের জবাব পেলে বোঝা যাবে, এটা কোন ধরনের ক্লাব।

বিসিবির কাছে এই জানতে চাওয়াটা ২৭ জনকে মালয়েশিয়ায় যেতে দেওয়ার আগেই হওয়া উচিত ছিল বলে মনে করেন পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক মোহাম্মদ নুরুল হুদা। তিনি বলেন, ‘যখন একটি অখ্যাত ক্রিকেট ক্লাব মালয়েশিয়ায় আন্তর্জাতিক ক্রিকেট টুর্নামেন্ট খেলবে বলে জানাল, তখনই ইমিগ্রেশন পুলিশ বিষয়টি যাচাই করার জন্য বিসিবির সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারত। বিষয়টি আরও যাচাই–বাছাই করা উচিত ছিল।’

সংঘবদ্ধ মানব পাচারকারী চক্রের সদস্যরা নানা অজুহাতে বিদেশে বাংলাদেশিদের পাচার করায় দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে বলে উল্লেখ করেন নুরুল হুদা। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর কর্মকর্তাদের আরও দায়িত্বশীল হওয়া উচিত বলে মন্তব্য করেন তিনি।

আসাদুজ্জামান

ঢাকা

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.