ঘোড়া যেন বালুচরের জাহাজ

0
80
গাইবান্ধার বালাসী ঘাট থেকে বাগুরিয়া ঘাট পর্যন্ত বালুচরের পথে ঘোড়ার গাড়িতে যাতায়াত করেন যাত্রীরা। সম্প্রতি তোলা

ধু ধু মরুপথে মানুষের চলার বাহন উট। উটের আরেক নাম এ কারণে মরুভূমির জাহাজ। গাইবান্ধায় মরুভূমি না থাকলেও আছে মরুপ্রায় বিস্তীর্ণ বালুচর, কিন্তু উট নেই। উট নেই তো কী! উটের বদলে আছে শত শত ঘোড়া। গাইবান্ধার দৃশ্যপটে তারা দিয়েছে ভিন্ন এক রঙের পোঁচ।

গাইবান্ধায় ব্রহ্মপুত্র নদের কাছে বালাসী ঘাট থেকে বাগুরিয়া ঘাট। সেখানে না চলে সাইকেল, মোটরসাইকেল, রিকশাভ্যান, অটোরিকশার মতো বাহন; সেখানে না যায় হাঁটা। অতএব চড়ে বসো ঘোড়ার গাড়িতে। উট যদি হয় মরুভূমির জাহাজ, এই বালুচরের জাহাজ না হয় ঘোড়া।

বালাসী ঘাট গাইবান্ধা জেলা শহর থেকে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার দূরে। সেখান থেকে জামালপুর জেলার বাহাদুরাবাদ ঘাট পর্যন্ত অঞ্চলে বর্ষামুখর ছয়টি মাস চলে নৌকা। বাকি ছয় মাস প্রায় শুষ্ক। গত বছরের ডিসেম্বরে প্রায় চার কিলোমিটার পর্যন্ত জেগে উঠেছে বালুচর—বালাসী ঘাট থেকে বাগুরিয়া পর্যন্ত। সেই বালুচর পাড়ি দিতে ঘোড়াই ত্রাণকর্তা!

বালুচরের দুস্তর পারাবার ঘোড়াই যদি পার করিয়ে দেয়, বাহাদুরাবাদ ঘাটে যেতে বাকি পথ আর এমনকি! লঞ্চ বা শ্যালো ইঞ্জিনে চলা নৌকা তো আছেই। সেখান থেকে ময়মনসিংহ হয়ে কম সময়ে গাইবান্ধার মানুষ রাজধানী ঢাকায় যাতায়াত করছেন।

প্রতিদিন হাজারো মানুষ ঘোড়ার গাড়িতে করেই পাড়ি দিচ্ছেন এই পথ। শুধু এখানেই নয়, আর সব চরেও যাবতীয় মালপত্র আনা-নেওয়ায় ঘোড়াই ভরসা। চরাঞ্চলে জনপ্রতিনিধি, রাজনৈতিক নেতা, প্রশাসনিক কর্মকর্তারা ঘোড়ার গাড়িতে চড়ছেন মর্যাদা বাড়ানোর জন্য নয়, এ ছাড়া যে চলাচলেরই কোনো বন্দোবস্ত নেই।

ঘোড়াই তাই এই বালুচরের প্রাণ। শুধু সহযোগিতার নয়, উপার্জনেরও। যাঁরা একসময় দিনমজুরের কাজ করতেন, এখন তাঁদের হাতে কাজ নেই। ঘোড়ার গাড়ি চালিয়ে আয়রোজগার করছেন তাঁরা। বালাসী ঘাট থেকে বাগুরিয়া পর্যন্ত ঘোড়ার গাড়িতে জনপ্রতি ভাড়া ৫০ থেকে ৬০ টাকা। বাগুরিয়া-বাহাদুরাবাদ নৌকাভাড়া ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা।

বালাসী-বাহাদুরাবাদ রুটে ঘোড়ার গাড়ির সংখ্যা এখন শতাধিক। চরাঞ্চলে উৎপাদিত ধান, পাট, গম, ভুট্টা, কাউনসহ বিচিত্র কৃষিপণ্য পরিবহন করে ঘোড়া টিকিয়ে রেখেছে গরিব মানুষের অর্থনীতি। ঘোড়ার কাজের শেষ নেই। জমি চাষাবাদেও রাখছে ভূমিকা। এলাকার মানুষ শখের বশেও ঘোড়া লালন-পালন করছেন।

বালাসী ঘাটে গেলেই চোখে পড়বে সারি সারি ঘোড়ার গাড়ি। কেউ গাড়িতে উঠছেন, কেউ নামছেন, গলা ছেড়ে হাঁক দিচ্ছেন ঘোড়ার গাড়ির চালকেরা। এক শশব্যস্ত চিত্র। কাঠ আর বাঁশ দিয়ে তৈরি ঠেলাগাড়িতে ট্রাকের চাকা লাগিয়ে তৈরি করা হয়েছে গাড়ি। গাড়ির ওপর তোশক বিছানো। তাতে চাদর পাতা। কায়দা একেবারে জমিদারি। সেখানে আয়েশ করে পারাপার হচ্ছেন যাত্রীরা।

যাত্রীরা জানালেন, বিনোদনকেন্দ্রগুলোয় যাওয়ার সময় মানুষ শখ করেই চড়ে বসেন ঘোড়ায় চালানো টমটমে। সহজে বালুচর পাড়ি দেওয়া যায়, মনে জেগে ওঠে ফুরফুরে অনুভূতি। আর একাকী যাঁরা ঘোড়ার গাড়িতে ঘোরাঘুরি করতে ওঠেন, তাঁদের আনন্দের তো সীমা নেই।

গাইবান্ধা থেকে নৌকায় বালাসী-বাহাদুরাবাদ রুট হয়ে ঢাকা যেতে সময় লাগে ছয় থেকে সাত ঘণ্টা। সড়কপথে ৯ ও রেলপথে ১০ ঘণ্টা। এই রুটের কয়েক কিলোমিটার চরে ঘোড়ার গাড়ির জনপ্রিয়তা আকাশে তুলে দিয়েছে। গাইবান্ধা সদর, ফুলছড়ি, সাঘাটা ও সুন্দরগঞ্জ উপজেলার প্রায় ১৪টি ইউনিয়নে বিস্তীর্ণ চরাঞ্চল। এসব ইউনিয়নের চরাঞ্চলে ঘোড়ার গাড়ি কেবল উপায় নয়, উপভোগও।

ইয়াসিন আলী (৪৫) বাগুরিয়া গ্রামের কোচোয়ান। ঘোড়ার গাড়িতে যাত্রী টেনে ভালোই চলছে সংসার। তিনি বললেন, ‘বালুচরোত অ্যাকনা ভ্যান-অটোরিকশা চলে না। তাই ঘোড়ার গাড়ি বানাচি।’ একজন যাত্রী তুললে তিনি পান ৫০ টাকা। এভাবে ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা তাঁর রোজকার আয়। ঘোড়া তাঁর সংসারে দিয়েছে স্বস্তি।

জেলা প্রাণিসম্পদ কার্যালয়ের তথ্য বলছে, এই জেলায় ঘোড়ার সংখ্যা প্রায় ৫০০। একেকটা ঘোড়ার দাম ১ লাখ থেকে ১ লাখ ৩০ হাজার টাকা। সুন্দরগঞ্জ উপজেলার সীচা-পাঁচপীর এলাকায় বসে ঘোড়ার হাট। রোজগারের পাশাপাশি মানুষের মিলনেরও সেটা আরেক আনন্দময় উপলক্ষ।

ঘোড়া যেন এ অঞ্চলে ঘোষণা করছে মানুষের সঙ্গে প্রাণিকুলের লাখো বছরের বন্ধুত্বের কথা।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.