গ্রীষ্মের ফুলের রূপমাধুরী

0
271

প্রকৃতিতে এখন চলছে গ্রীষ্মের রাজত্ব। ‘প্রখর তপনতাপে, আকাশ তৃষায় কাঁপে,/ বায়ু করে হাহাকার।’ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গানের অবিকল প্রতিমূর্তি যেন এবারের বৈশাখের প্রকৃতি। দাবদাহে ব্রহ্মতালু ফেটে যায় প্রায়। মাসের শুরুর দিনগুলোতে সবার মুখে মুখে ফিরেছে কেবল একটিই কথা, ‘নাহ্‌, এই গরমে আর টেকা যাচ্ছে না।’

এই ‘গ্রীষ্মলাঞ্ছনার’ মধ্যেই সাম্প্রতিক দিনগুলোতে আবার কখনো কখনো হয়েছে প্রকৃতির চরিত্র–বদল! দিবাভাগে প্রচণ্ড খরতাপ, আর দিনান্তে আকাশে কালো মেঘের ঘনঘটা। খানিকবাদেই রূদ্ররূপে হাজির বৃষ্টি, বজ্রবৃষ্টি বা কালবৈশাখী।

হাহাকার করা বায়ু বা প্রখর তপনতাপের বিপরীতে এই গ্রীষ্মেই প্রকৃতি আয়োজন করেছে ফুলের জলসা। বহুবর্ণের ফুল আর এর মনকাড়া ঘ্রাণ নাগরিক–জীবন রাঙিয়েছে রঙে আর ঘ্রাণে। সময় হয়তো বৈরী, কিন্তু সংবেদনশীল মানুষ সড়কের দুপাশে, অফিস বা বাড়ির চত্বরে বা পার্কে ফুটে থাকা ফুলের তীব্র আহ্বান কি উপেক্ষা করতে পেরেছেন?

এই নগরের ফুসফুস রমনা, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান আর সংসদ ভবন এলাকা ছাড়াও নানা প্রান্তে সবুজ পাতার ফাঁকে মোরগের লাল ঝুঁটির মতো মাথা উঁচু করে আছে কৃষ্ণচূড়া।
গ্রীষ্মের প্রকৃতিতে এখন রক্তলাল কৃষ্ণচূড়ার বর্ণিল উপস্থিতি। বৃহস্পতিবার রাজধানীর কল্যাণপুর এলাকায়

১ মে সোমবার মেঘাচ্ছন্ন বিকেলে গুলিস্তান জিরো পয়েন্ট থেকে সচিবালয় অভিমুখের সড়কে ঢুকতেই নীরবে সম্ভাষণ জানাল গ্রীষ্মের লাজুক ফুলগুলো। বাঁ পাশে ওসমানী উদ্যানে রক্তলাল কৃষ্ণচূড়ার বর্ণিল উপস্থিতি। গ্রীষ্ম কৃষ্ণচূড়ারই দিন। নিসর্গীরা বলে থাকেন, পলাশ-শিমুল যদি বসন্তের প্রতীক হয়, কদম যদি হয় বর্ষার, তবে কৃষ্ণচূড়া নিশ্চয়ই গ্রীষ্মের প্রতীক।

এই নগরের ফুসফুস রমনা, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান আর সংসদ ভবন এলাকা ছাড়াও নানা প্রান্তে সবুজ পাতার ফাঁকে মোরগের লাল ঝুঁটির মতো মাথা উঁচু করে আছে কৃষ্ণচূড়া। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম সন্ধ্যামালতী কাব্যে প্রশস্তি করেছিলেন এই কৃষ্ণচূড়ার। তিনি লিখেছেন, ‘কৃষ্ণচূড়ার রাঙা মঞ্জুরি কর্ণে/ আমি ভুবন ভোলাতে আসি গন্ধে ও বর্ণে।’

সেদিন আবদুল গনি সড়কের বিভাজকে বাগানবিলাস আর দুই পাশে কাঠগোলাপের সাদা মায়া আর মেঘশিরীষের ফুলের সুধা দেখে হাইকোর্ট এলাকায় প্রবেশ করতেই বিরহী কোকিলের কুহু ডাক। আহা, সার্থক এ বিকেল! ফুলের হাসি আর পাখির গান মনে গেঁথেই রমনা উদ্যানে ঢুকেছি। ছুটির দিন বলে নগরবাসীরা পরিবারসমেত বৈকালিক বিহারে এসেছেন। উদ্যানের গাছ ও পাখির আজ আর নিস্তার নেই। ছবি তোলা চলছে বিরামহীন। সেসব ছবিতে রং ছড়িয়ে রমনায় ফুটেছে কৃষ্ণচূড়া, সোনালু, নাগেশ্বর, রাধাচূড়া, গুস্তাভিয়া, কাঠগোলাপ, ডুলিচাপা, উদয়পদ্ম, মধুমঞ্জুরি, কনকচূড়া, ঝুমকোলতার মতো বহু রঙের ফুল।

সেদিন আবদুল গনি সড়কের বিভাজকে বাগানবিলাস আর দুই পাশে কাঠগোলাপের সাদা মায়া আর মেঘশিরীষের ফুলের সুধা দেখে হাইকোর্ট এলাকায় প্রবেশ করতেই বিরহী কোকিলের কুহু ডাক। আহা, সার্থক এ বিকেল!
গ্রীষ্মের শোভা বাড়িয়ে ফুটেছে বেগুনি রঙের জারুল ফুল। সম্প্রতি রাজধানীর মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে
গ্রীষ্মের শোভা বাড়িয়ে ফুটেছে বেগুনি রঙের জারুল ফুল। সম্প্রতি রাজধানীর মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে

শুধু গ্রীষ্ম নয়, বৈচিত্র্যের কারণে রমনা পার্কে বছরজুড়েই কোনো না কোনো ফুলের হাসি ও সৌরভ চারদিক মাতিয়ে রাখে। সন্ধ্যার খানিক আগে হঠাৎ ঝিরঝির বৃষ্টিতে অভ্যাগতের সংখ্যা কমে আসে। আর উদ্যানের তৃষ্ণার্ত গাছ আর ফুলগুলো বৃষ্টির স্পর্শে আরও তাজা হয়ে ওঠে।

রমনার পাশেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এই ক্যাম্পাসে অনেক গাছ কাটা পড়লেও কিছুটা সবুজ এখনো টিকে আছে। কার্জন হলের বোটানিক্যাল গার্ডেনে শুভ্র হাসিতে স্বাগত জানায় কুরচি। সেখানে আরও ফুটেছে সোনালু, কৃষ্ণচূড়া, জারুল, কাঠগোলাপ ও স্বর্ণচাপা।

এর বাইরে হাতিরঝিল বা জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যান—যেখানেই সামান্য সবুজ, সেখানেই গ্রীষ্ম ঋতুর ফুলের হাসি। এই রূপমাধুর্য এড়িয়ে যায় সাধ্য কার। সংসদ ভবন এলাকায় ফুটে থাকা কৃষ্ণচূড়া, রাধাচূড়া, সোনালুর সৌন্দর্যে মুগ্ধ নগরবাসীর অনেকেই চলতি পথে মোটরসাইকেল বা গাড়ি থামিয়ে ছবি তুলছেন। এই দৃশ্য নিত্যকার।

তেজগাঁও এলাকা থেকে অশোক, স্বর্ণচাপা আর শিরীষের ছবি তুলে ফেসবুকে দিয়েছেন গ্রন্থাগার আন্দোলনের কর্মী ও সাংবাদিক ফাহিমা কানিজ (লাভা)। তিনি বলেন, প্রকৃতিপাঠ তাঁর কাছে অফুরন্ত আনন্দের উৎস। নিজে তাই সব ঋতুর ফুল আর গাছের নাম জানার চেষ্টা করেন। তাঁর ইচ্ছা গ্রন্থাগারের ছেলেমেয়েদেরও এতে আগ্রহী করে তোলার, যাতে ওদের মধ্যেও গড়ে ওঠে প্রকৃতির প্রতি প্রেম, পরিবেশের প্রতি সচেতনতা।

বৈশাখের চতুর্থ সপ্তাহ চলছে। জ্যৈষ্ঠ আসছে। একদিন ঝড়–বৃষ্টিতে বিদায় নেবে গ্রীষ্মকাল। আসবে বর্ষাঋতু। চিরাচরিত পঞ্জিকার পাতার মতো করেই যে প্রকৃতি তার পাণ্ডুলিপি রচনা করবে, এমন নয়। গ্রীষ্মে ফোটা ফুল আর কিছুদিন আয়ু পাবে বৃক্ষে ও শাখায়। ফুল ঝরার আগেই কিছুটা সময় কাটাতে এমন মুগ্ধতার কাছে, এমন নিঃশব্দ আনন্দের কাছে যাওয়া যায় সহজেই।

কাজী আলিম-উজ-জামান

ঢাকা

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.