গোল কিক যেভাবে ফুটবল মাঠে পার্থক্য গড়ে দিচ্ছে

0
93
রিয়াল মাদ্রিদের বেলজিয়ান গোলরক্ষক থিবো কোর্তোয়ার একটি গোল কিক

ফুটবল মাঠে আপনি কী দেখতে পছন্দ করেন? নিশ্চয়ই সুন্দর একটি গোল! সেটি হতে পারে তিন-চারজনকে কাটিয়ে কিংবা বাইসাইকেল কিকে অথবা ডি-বক্সের বাইরে থেকে নতুন চাঁদের মতো বাঁকানো শটে। গোল বাদ দিলে হতে পারে দুর্দান্ত কোনো অ্যাসিস্টও। তিন ডিফেন্ডারের মধ্য দিয়ে রক্ষণচেরা কোনো পাস বা মাপা ক্রসে ডি-বক্সে ফেলা বল।

আর আপনি সবচেয়ে কম দেখতে পছন্দ করেন বা কম গুরুত্ব দেন কোন বিষয়টিকে? এখানেও হয়তো একাধিক বিষয়ের কথা বলা যায়। তবে গোল কিক তার মধ্যে যে একটি, তা বলাই যায়। গোলরক্ষকের কাছে যখন বল থাকে তখন গোল হওয়ার বা তড়িৎ কিছু ঘটার সম্ভাবনা সামান্য। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে গোলরক্ষক হয় কাছাকাছি কোনো খেলোয়াড়কে বলটি পাস করেন কিংবা লম্বা করে বল বাড়িয়ে দেন মাঝমাঠের খেলোয়াড়দের উদ্দেশে। আর দর্শকেরাও হয়তো এই সময়টিকে বিরতি বা ছোটখাটো কাজে ব্যবহার করেন। যেমন পানি খাওয়া কিংবা জরুরি কোনো আলাপ সেরে নেওয়া ইত্যাদি।

গোল কিককে অবশ্য এতটা হালকা করে দেখা কিন্তু অনুচিত। বিশেষ করে আধুনিক ফুটবলে তো অবশ্যই নয়। কোনো একটি দলের আক্রমণের সুরটাই তৈরি করে দিতে পারে গোল কিক। একটা সময় ছিল যখন গোল কিকের উদ্দেশ্য ছিল বলকে লম্বা করে বাড়িয়ে মাঝমাঠে পাঠানো, যাতে নিজ দলের খেলোয়াড় বলটি পেতে পারেন। কিন্তু আধুনিক ফুটবলে গোল কিক সাধারণ কোনো শটে সীমাবদ্ধ নয়। এখানে গোল কিককে ব্যবহার করা হয় আক্রমণের সূত্রবিন্দু হিসেবে। এখান থেকেই গড়ে ওঠে সম্মিলিত কোনো আক্রমণ। তাই গোল কিক এখন একই সঙ্গে কৌশলী, বৈচিত্র্যময় এবং ভারসাম্যপূর্ণও।

গোল কিক এখন আর হেলাফেলার বিষয় নয়
গোল কিক এখন আর হেলাফেলার বিষয় নয়

আগের লম্বা গোল কিকের বদলে ছোট কিকে শুরু করার প্রবণতা সাম্প্রতিক সময়ে উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। যার পেছনে অবশ্য ২০১৯-২০ মৌসুমে আইনের পরিবর্তনও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। যেখানে গোল কিকের সময় ডি-বক্সের মধ্যে থাকা খেলোয়াড়কে বল পাস দেওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়েছে।

সবাই যে অবশ্য গোল কিককে ঠিকঠাকভাবে ব্যবহার করতে পারে, তা নয়। কোনো কোনো কোচ কিংবা ক্লাব বিশেষভাবে গুরুত্ব দিয়ে বিষয়টি নিয়ে পরিকল্পনা করার কারণে অধিক সুবিধা পেয়ে থাকে। অনেক সময় অবশ্য নিজ ডি-বক্সের ভেতর বল পাস দেওয়ার বিষয়টি দলের সমর্থকদের বিভ্রান্তি, বিরক্তি এবং ক্ষোভের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এর পেছনে যে কারণ নেই, তা নয়। এমন পাসে অনেক সময় ভুল হলে গোল পর্যন্ত হজম করতে হতে পারে। তবে এটা সত্যি যে গোল কিক কোনো সাধারণ পাস নয়, এটিও দলের আক্রমণের পরিকল্পনার একটি অংশ।

এবার ২০২২-২৩ মৌসুমে প্রিমিয়ার লিগের কিছু দলের গোল কিক পরিসংখ্যানের দিকে তাকানো যাক। কদিন আগে টটেনহামের দায়িত্ব ছাড়া কোচ আন্তোনিও কন্তে তাঁর দুই গোলরক্ষককে দিয়ে (উগো লরিস চোটে পড়ায় গোলরক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন ফ্রাসের ফ্রস্টার) সবচেয়ে কম দূরত্বে কিক করে বল পাঠান। এই গোলরক্ষকেরা গোল কিকে কাভার করেছেন গড়ে ২৩ মিটার (৭৫ ফিট বা ২৫ গজ) দূরত্ব।

নিউক্যাসল ও এভারটরনের গোলরক্ষকদের গোল কিক আবার কাভার করেছে ৪৮.৪ মিটার পর্যন্ত, যা কিনা গোলরক্ষকের গোল কিকে দেওয়া পাসের মধ্যে দূরত্ব বিবেচনায় সর্বোচ্চ। কোচ শন ডাইচের কথা ধরা যাক। ২০২০-২২ মৌসুমে তাঁর দল বার্নলে গোল কিকে সবচেয়ে বেশি দূরত্ব কাভার করেছে (৩৭ মিটার)। এমনকি বার্নলির তৎকালীন গোলরক্ষক নিক পোপ নিউক্যাসলে গিয়েও নিজের অভ্যাস বদলাননি।

নিউক্যাসল গোলরক্ষক নিক পোপ প্রিমিয়ার লিগের এ মৌসুমে গোল কিক নিতে সবচেয়ে বেশি সময় লাগিয়েছেন
নিউক্যাসল গোলরক্ষক নিক পোপ প্রিমিয়ার লিগের এ মৌসুমে গোল কিক নিতে সবচেয়ে বেশি সময় লাগিয়েছেন ছবি : টুইটার

ওপরের পরিসংখ্যান দিয়ে অবশ্য বৈচিত্র্যকে বোঝা যাবে না। কোন দল কীভাবে এবং কোন কৌশলে এটিকে ব্যবহার করছে, সেটা সংখ্যার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। একটু তলিয়ে দেখলে বোঝা যাবে প্রতিটি দল শর্ট গোল কিক এবং লং গোল কিকের মধ্যে একধরনের সমন্বয় গড়ে তোলে। শর্ট গোল কিক হলো এমন কিছু, যা কিক নেওয়া দলের ৪০ মিটারের মধ্যে শেষ হয়। ৪০–এর বেশি হলে তা লং গোল কিক হিসেবে বিবেচিত হয়।

লিভারপুলের গোলরক্ষক আলিসন মূলত শর্ট গোল কিকেই বেশি আস্থা রাখেন। প্রিমিয়ার লিগের অন্যে গোলরক্ষকদের চেয়ে এই ব্রাজিলিয়ান অনেক বেশি নিচ থেকে আক্রমণ গড়তে পছন্দ করেন। আবার ব্রেন্টফোর্ডের ডেভিড রায়া আবার এর উল্টো। ৭২ শতাংশ সময়ে তিনি ৪০ মিটারের বেশি দূরত্বে শট নিয়ে থাকেন।

মেয়েদের ফুটবলেও গোল কিক এখন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে
মেয়েদের ফুটবলেও গোল কিক এখন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে

আর্সেনাল, অ্যাস্টন ভিলা এবং ক্রিস্টাল প্যালেস আবার ভারসাম্য বজায় রেখেছে সবচেয়ে বেশি। তাদের শর্ট কিক এবং লং কিকের অনুপাত ৫০: ৫০। শর্ট গোল কিকে আক্রমণ গড়ার মূলত অনেকগুলো কারণ থাকে। একেক দল একেক উদ্দেশ্যে এটি ব্যবহার করে। তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বড় কারণ বলের দখল নিজেদের কাছে রাখা। আবার কেউ হয়তো এরিয়ালে (বাতাসে) সুবিধা নেওয়ার জন্য লং কিককে বেছে নেয়। আরেকটি বিশেষ ব্যাপার হলো, দলগুলোর লং গোল কিক এবং শর্ট গোল কিকের কৌশল বেছে নেওয়ার ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখে প্রতিপক্ষ দলের শক্তিও।

লিভারপুলের ব্রাজিলিয়ান গোলরক্ষক আলিসন বেকারের একটি গোল কিকের মুহূর্ত
লিভারপুলের ব্রাজিলিয়ান গোলরক্ষক আলিসন বেকারের একটি গোল কিকের মুহূর্ত

যেমন একটি দল প্রতিপক্ষ দলের দুর্বল প্রেসিংয়ের সুবিধা নেওয়ার জন্য শর্ট গোল কিককে ব্যবহার করতে পারে। যার ফলে ফাঁকা জায়গা বের করে আক্রমণে যাওয়া সহজ হয়। আবার উল্টোটা হয়। এয়ারে কিংবা আক্রমণে দুর্বল দলের ক্ষেত্রে লং গোল কিক কার্যকর হতে পারে। গোল কিক মূলত পরিস্থিতি বুঝে ব্যবহারের একটি অস্ত্র। গুরুত্বপূর্ণ সময়ে এর কৌশলী ব্যবহার ম্যাচের ফল বদলে দিতে পারে। গোল কিক নেওয়ার ব্যাপারে দলগুলোর প্রবণতাকে বিশ্লেষণ করলেও মজার চিত্র পাওয়া যায়। লিডস ইউনাইেড যেমন লং কিকের ক্ষেত্রে দুই উইংকে ব্যবহার করার চেষ্টা করে। লিভারপুল আবার লং বলের ক্ষেত্রে রাইট উইংকে একরকম এড়িয়ে চলে।

আধুনিক ফুটবলে শর্ট গোল কিক অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য ট্যাকটিস। কিন্তু সেটি কি আক্রমণের ক্ষেত্রে অনেক বেশি সুবিধা দেয়? প্রিমিয়ার লিগের পরিসংখ্যান বলছে, এই মৌসুমে লং গোল কিকের ১৩ শতাংশই প্রতিপক্ষ ডি–বক্স পর্যন্ত চালিত হয়েছে। শর্ট গোল কিকের ক্ষেত্রে এই হার ১৫ শতাংশ। এ পরিসংখ্যান অবশ্য পুরো চিত্র তুলে ধরে না। তবে প্রথম কিক থেকে বল দখলে রেখে সামনে যাওয়ার প্রবণতা কি সুবিধা পাওয়া যায়, তা বোঝার জন্য এটি গুরুত্বপূর্ণ।

এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি সুবিধা পেয়েছে টটেনহাম। দায়িত্ব ছাড়ার আগপর্যন্ত ব্যাক থেকে আক্রমণ গড়ে অনেকবার সুবিধা পেয়েছেন কন্তে। সিটি ও লিভারপুলও শর্ট গোল কিকের একই রকম সুবিধাভোগী। এখন নিউক্যাসলের মতো দলও নিচ থেকে আক্রমণ গড়ায় মনোযোগ দিচ্ছে। এই দলটির ৪৬ শর্ট গোল কিকের ২৪ শতাংশই ৬০ সেকেন্ডের মধ্যে প্রতিপক্ষ ডি–বক্সে প্রবেশ করেছে।

শর্ট গোল কিকের ঝুঁকির কথা অবশ্য আগেও বলা হয়েছে। যেখানে ভুল করলে বড় ধরনের বিপদে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। কিন্তু এটিকে ঠিকঠাক কাজে লাগানো গেলে এটি দীর্ঘ মেয়াদে বেশ ভালো ফল নিয়ে আসতে পারে।

সম্প্রতি আর্সেনালের বিপক্ষে গোল কিক নিতেই ১৩ মিনিট সময় নষ্ট করে সমালোচিত হয়েছেন সাউদাম্পটনের আইরিশ গোলরক্ষক গাভিন বাজুনু
সম্প্রতি আর্সেনালের বিপক্ষে গোল কিক নিতেই ১৩ মিনিট সময় নষ্ট করে সমালোচিত হয়েছেন সাউদাম্পটনের আইরিশ গোলরক্ষক গাভিন বাজুনু

যদিও শেষ কথা হচ্ছে, প্রতিটি দল কৌশল সাজায় মূলত নিজের শক্তি এবং প্রতিপক্ষের দুর্বলতাকে বিবেচনায় নিয়ে। দল বদলে গেলে হয়তো কৌশলও বদলে যাবে। তাই এখানে নিশ্চিতভাবে কেউ একটি কৌশল আঁকড়ে বসে থাকে না। খেলার মাঠেই বদলে যেতে পারে আক্রমণের সব কৌশল।

দ্য অ্যাথলেটিক অবলম্বনে হাসনাত শোয়েব

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.