গরু পালন করে খুলেছে কপাল

0
90
পাইপের মাধ্যমে পানি দিয়ে গরুকে গোসল করাচ্ছেন এক খামারি। গত মঙ্গলবার দিনাজপুরের বীরগঞ্জ উপজেলার সাহাডুবি গ্রামে

বেশি গরু পালন করা হয় সাহাডুবি, মুরারীপুর, আরাজি মিলনপুর, ভেলাপুকুর ও গণপৈত গ্রামে।

দিনাজপুরের বীরগঞ্জ উপজেলার শিবরামপুর ইউনিয়নে মানুষের প্রধান পেশা খেতখামারে কাজ করা। এর পাশাপাশি তাঁরা গরুর খামার গড়ে তুলেছেন। প্রায় প্রতিটি পরিবারেই গরু রয়েছে। এর মধ্যে বেশি গরু পালন করা হয় ইউনিয়নের সাহাডুবি, মুরারীপুর, আরাজি মিলনপুর, ভেলাপুকুর ও গণপৈত গ্রামে। দেশি গরুর পাশাপাশি রয়েছে ফ্রিজিয়ান, শাহিওয়াল ও সংকর জাতের গরু।

শামীম মিয়া-শিরিন বেগম দম্পতির বাড়ি শিবরামপুর ইউনিয়নের সাহাডুবি গ্রামে। পাঁচ বছর আগেও তাঁদের বাড়ি ছিল টিনের চালা-বাঁশের বেড়া দেওয়া। ওই ঘরের সঙ্গে লাগোয়া ১১৫ ফুট দৈর্ঘ্য ও ১২ ফুট প্রস্থের টিনশেডের গোয়ালঘরটি ছিল বেশ মজবুত। স্বামী-স্ত্রীর যত ব্যস্ততা গরু-গোয়ালঘর নিয়ে। গরু মোটাতাজাকরণ করে তাঁরা লাভবান হয়েছেন। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর কর্তৃক গত বছর রংপুর বিভাগে সেরা খামারির পুরস্কারও পেয়েছেন। গেল বছর চার কক্ষবিশিষ্ট পাকা বাড়ি করেছেন। জমি কিনেছেন ৭৫ শতক। বাড়িসংলগ্ন একটি হাস্কিং মিল বসিয়েছেন। দুই ছেলে-মেয়েকে স্কুলে পড়াচ্ছেন।

পাঁচ-ছয় মাস খামারে গরু লালন-পালন করি। যে গরু ৭০ হাজার টাকায় কেনা , ৬ মাস পর সেটি বিক্রি হয় ১ লাখ থেকে ১ লাখ ৩০ হাজার টাকায়।

সোলায়মান আলী, গণপৈত গ্রামের খামারি

জেলা শহর থেকে প্রায় ৫৮ কিলোমিটার দূরে সাহাডুবি গ্রাম। গত মঙ্গলবার দুপুরে ওই দম্পতির বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, খামারে গরুকে গোসল করাতে ব্যস্ত শামীম। পাশেই গরুর জন্য মেশিনে খড় কাটছেন শিরিন।

শামীম বলেন, ২০০৮ সালের মাঝামাঝি সময়ে ঢাকায় রিকশা চালাতে যান তিনি। বছরখানেক বাদে গ্রামের ফিরে আসেন। বাবা তাঁকে একটি বাছুর দেন। পাঁচ মাসের মাথায় বাছুরটি বিক্রি করেন ১২ হাজার টাকায়। সেই টাকায় দুটি বাছুর কেনেন। এর পর থেকে খামারে গরুর সংখ্যা বেড়েছে। গত মঙ্গলবার দুপুর পর্যন্ত তাঁর খামারে গরু ছিল ১৯টি। একেকটির মূল্য ৮০ হাজার থেকে ১ লাখ ৫০ হাজার টাকা। শামীম বলেন, ‘৩০টি গরু ছিল। এখন ঈদের বাজার। প্রতিদিন এক–দুটা করে বিক্রি করছি।’

গণপৈত গ্রামের খামারি সোলায়মান আলী। আটটি গরু আছে তাঁর। খামারের একপ্রান্তে খাটে বিছানা–বালিশ। জানালেন, সম্প্রতি চোরের উপদ্রব দেখা যাচ্ছে। সতর্ক থাকতে গোয়ালঘরের এককোনাতেই রাতে ঘুমানোর ব্যবস্থা করেছেন। বিভিন্ন হাটে গিয়ে অপেক্ষাকৃত কম স্বাস্থ্যবান গরু সস্তায় কেনেন তাঁরা। পাঁচ-ছয় মাস খামারে লালন–পালন করেন। যে গরু ৭০ হাজার টাকায় কেনা কেনেন, ৬ মাস পর সেটি বিক্রি হয় ১ লাখ থেকে ১ লাখ ৩০ হাজার টাকায়।

মুরারীপুর বাজারে চায়ের দোকানে আলাপকালে খামারি হাশিম উদ্দিন (৬৫) বলেন, শিবরামপুর ইউনিয়নের গরু দিনাজপুরের ফাসিলাডাঙ্গা, ফার্মেরহাট, বীরগঞ্জ, কাহারোল, গোলাপগঞ্জ, পঞ্চগড়ের বোদা ও ঠাকুরগাঁওয়ের খোঁচাবাড়িসহ বেশ কয়েকটি হাটে বিক্রি হয়। তিন ছেলের মধ্যে দুজনের খামার আছে। নিজেরও গরু আছে, তবে নিজে পালেন না, বর্গা দিয়েছেন কয়েকজনকে।

গরু বর্গা দেওয়ার বিষয়টি বুঝিয়ে বললেন সাহাপুর গ্রামের অশ্বিনী রায় (৫৫)। যাঁদের গরু কেনার সামর্থ্য নেই, বড় খামারিরা তাঁদের এক থেকে চারটি পর্যন্ত গরু বর্গা দিয়েছেন। সেই গরু বাজারজাত করা হলে মূল টাকা বাদ দিয়ে লাভের অঙ্ক হয় তিন ভাগ। যার এক ভাগ পান মালিক, দুই ভাগ বর্গাচাষি। বর্গা চাষ করতে করতেই কপাল খুলেছে কারও কারও। বর্গাচাষি থেকে খামারি হয়েছেন। ভাগ্য বদলে যাওয়াদের একজন প্রফুল্ল চন্দ্র রায়। কৃষিশ্রমিক ছিলেন। মাঠের কাজ শেষে গরুর জন্য এক-দুই বস্তা ঘাস সংগ্রহ করে আনতেন। এভাবে একটি থেকে পাঁচটি পর্যন্ত গরু বর্গায় চাষ করেছেন। কয়েক বছরের মধ্যে প্রফুল্ল খামারি হয়ে ওঠেন। এখন নিজের খামারে আটটি গরু। তুলেছেন পাকা বাড়ি।

শিবরামপুরে বাণিজ্যিকভাবে গরুর খামার গড়ে তোলা বেশি দিন আগের কথা নয়। দু-চারটা গরু প্রায় সবার ঘরেই ছিল। তেমনি একজন মুরারীপুর গ্রামের সালমা বেগম। ২০০৭ সালের কথা। একদিন উপজেলা প্রাণিসম্পদ অফিসে গরুর খুরারোগের চিকিৎসা নিতে এসেছিলেন। দুদিন পরে আবার গরু নিয়ে আসেন সালমার ছেলে মনিরুল (৩৫)। তাঁর সঙ্গে আলাপ হয় কার্যালয়ের এক কর্মকর্তার। পশু চিকিৎসা ও মোটাতাজাকরণ করার বিষয়ে প্রশিক্ষণ গ্রহণের সুযোগ পান মনিরুল। প্রশিক্ষণ শেষে ছোট পরিসরে বাণিজ্যিক খামার গড়ে তোলেন। পাশাপাশি শুরু করেন চিকিৎসাসেবা।

মনিরুল উদ্বুদ্ধ করেন গ্রামের অন্যদের। ২০০৯-১০ অর্থবছরে মনিরুলের নেতৃত্বে মুরারীপুর গ্রামে ন্যাশনাল অ্যাগ্রিকালচারাল টেকনোলজি প্রজেক্টের আওতায় ২০ জনকে নিয়ে গরু পালনের একটি দল গঠন করা হয়। দলের সদস্যদের বলা হয় সিআইজি (কমন ইন্টারেস্ট গ্রুপ) সদস্য। প্রাণিসম্পদ অফিস তাঁদের প্রশিক্ষণ দিয়ে মনিরুলকে ইউনিয়ন সম্প্রসারণ প্রতিনিধি নিয়োগ করে। বর্তমানে শিবরামপুর ইউনিয়নে ৩টি সিআইজি দলে ৬০ জন সদস্য। প্রতিটি দলের সঞ্চয় হয়েছে ১৫-২০ লাখ টাকা।

বীরগঞ্জ উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ওসমান গনি বলেন, উপজেলায় প্রায় প্রতিটি বাড়িতে গরু লালন-পালন হয়। সর্বনিম্ন পাঁচটি গরু থাকলে খামারি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। উপজেলায় খামারি রয়েছেন ৫ হাজার ৩৬৮ জন। প্রায় ২৬ হাজার গরু কোরবানির জন্য প্রস্তুত আছে। এখানকার খামারিরা স্বাস্থ্যসম্মতভাবে গরু পালন করেন।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.