কয়লাকে ‘ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে’ নিক্ষেপ করা গেল না কেন

0
134
কয়লা

২০২১ সালের নভেম্বর মাসে গ্লাসগোতে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের এক সম্মেলনে বিশ্বনেতারা একটি ঘোষণা দিয়ে বেশ হর্ষধ্বনি পেয়েছিলেন। তাঁরা বলেছিলেন, কয়লাকে ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষেপের জন্য ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।

বিভিন্ন দেশের সরকার কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধের অঙ্গীকার করে, বিনিয়োগকারীরাও কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে বিনিয়োগ বন্ধের ঘোষণা দেয়। কিন্তু আজ ১৮ মাস পরও বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত এই জ্বালানি পোড়ানো বন্ধ হয়নি।

দ্য ইকোনমিস্টের এক নিবন্ধে বলা হয়েছে, ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে রাশিয়া ইউক্রেনে হামলা চালালে কয়লার ব্যবহার আরও বেড়ে যায়। এর ফলে গত বছর কয়লার ব্যবহার রেকর্ড উচ্চতায় ওঠে। জ্বালানি তেল ও গ্যাসের দাম কমলেও চলতি বছর কয়লার ব্যবহার আরও বাড়বে বলেই পূর্বাভাস।

বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে রাখতে হলে এই দশকের মধ্যে কয়লার উৎপাদন এক-তৃতীয়াংশ হ্রাস করতে হবে। কিন্তু পূর্বাভাস হচ্ছে, তা হয়তো পাঁচ ভাগের এক ভাগের কম হারে কমবে।

২০২১ সালে জাতিসংঘের সেই সম্মেলন ঘিরে আশাবাদ তৈরির কারণ হলো বিশ্বের শীর্ষ ব্যাংক ও অন্যান্য বিনিয়োগকারীরা একের পর এক কয়লায় বিনিয়োগ বন্ধের অঙ্গীকার করেছে। দুই শতাধিক বিনিয়োগকারী, বিশেষ করে ইউরোপীয় বিনিয়োগকারীরা কয়লাখনি ও কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে বিনিয়োগ কমানোর ঘোষণা দেয়।

অন্যদিকে বিশ্বের ব্যাংকিং খাতের দুই-তৃতীয়াংশ সম্পদের অধিকারী ব্যাংকগুলোর জোট ‘নিট জিরো ব্যাংকিং অ্যালায়েন্স’ গঠন করে, যারা ২০৫০ সালের মধ্যে কার্বন নিঃসরণ শূন্যের পর্যায়ে নামিয়ে আনার অঙ্গীকারের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে কাজ করার কথা দেয়। আশা ছিল, জীবাশ্ম জ্বালানিতে বিনিয়োগের পরিমাণ হ্রাসের কারণে এই খাতের বিকাশ অনেকটা বন্ধ হবে এবং শেষ পর্যন্ত কয়লার সরবরাহই থেমে যাবে।

কিন্তু কয়লার ব্যবহার উল্টো বেড়ে যাওয়ার ঘটনায় বোঝা গেল, এই মনোভঙ্গিতে দুর্বলতা রয়েছে। প্রশ্ন হলো, তাহলে ভুলটা হলো কোথায়? প্রথমত, ব্যাংকগুলোর অঙ্গীকারের প্রভাব খুবই সীমিত। তাদের অনেক অঙ্গীকারই এই দশকের শেষ ভাগের আগে কার্যকর হবে না। দ্বিতীয়ত, তাদের অনেক অঙ্গীকার কেবল নতুন খদ্দের ও নতুন খনির ক্ষেত্রে সীমিত।

যেসব খনি তাদের রাজস্ব আয়ের একটিমাত্র অংশ কয়লাসংক্রান্ত কর্মকাণ্ড থেকে সরিয়ে নেবে, তাদের ছাড় দেওয়া হয়েছে। এর ফলে দেখা গেল, ৬০টি বড় ব্যাংক বিশ্বের সবচেয়ে বড় কয়লাখনিগুলোকে গত বছর ১ হাজার ৩০০ কোটি ডলার ঋণ দিয়েছে।

এদিকে নিট জিরো ক্লাবও বিপদে পড়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের রিপাবলিকান আইনপ্রণেতারা এই ক্লাবের বিরুদ্ধে অ্যান্টি–ট্রাস্ট মামলা করার হুমকি দিয়েছেন। এর আগে গত মাসে আলিয়ানজ, এএক্সএ ও স্কর—এই তিনটি বিমা কোম্পানি নিট জিরো ইনস্যুরেন্স অ্যালায়েন্স ছেড়ে গেছে।

এ ছাড়া পৃথিবীতে এখন পশ্চিমা বিনিয়োগকারীরাই অর্থের একমাত্র উৎস নয়। তারা হয়তো নতুন খনিতে বিনিয়োগ করছে না, কিন্তু অন্যরা তো আর বসে নেই। তারা অর্থ নিয়ে ঝাপিয়ে পড়ছে। কয়লার অন্যতম বৃহৎ ব্যবহারকারী হচ্ছে ভারত ও চীন। দেশ দুটির ব্যাংকগুলো কয়লা উৎপাদনে অবাধে বিনিয়োগ করছে। ইন্দোনেশিয়ার ব্যাংকের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য।

এদের কেউই নিট জিরো অ্যালায়েন্সে যোগ দেয়নি। ইকোনমিস্টের সংবাদে বলা হয়েছে, সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে কয়লার চাহিদা হ্রাস করা। যত দিন কয়লায় বিনিয়োগ করে লাভবান হওয়া যায়, তত দিন এতে বিনিয়োগের চাহিদা থাকবে। ধূমপান বন্ধ করার জন্য যেমন সিগারেটপ্রাপ্তি কঠিনতর করা ও এর দাম বাড়ানোর বিকল্প নেই, তেমনি কয়লার চাহিদা কমানোর সবচেয়ে কার্যকর মাধ্যম হচ্ছে এর চাহিদা কমানো।

পরিবেশবান্ধব ও পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদনে বিনিয়োগ উৎসাহিত করা হলে কয়লার প্রতি আগ্রহ কমবে। এ ছাড়া কার্বন নিঃসরণে আরও কার্যকরভাবে করারোপ করা হলেও জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমবে।

যেসব নীতির কারণে মানুষের জ্বালানি ব্যয় বেড়ে যায়, সেই সব নীতির বিকল্প রাজনীতিকেরা অনেক দিন ধরেই খুঁজছেন। দাম বাড়লে জনপ্রিয়তা হারানোর ঝুঁকি থাকে। অনেক সরকার তাই কয়লায় ভর্তুকি দিয়ে যাচ্ছে। তাদের বরং যেটা করা দরকার ছিল, তা হলো কয়লার দাম আরও বাড়িয়ে দেওয়া। সেই পথে হাঁটা শুরু করার সময় এখনই।

ভারতে কয়লা উত্তোলনে বরাদ্দ বাড়ছে

এদিকে ইকোনমিক টাইমসের এক সংবাদে বলা হয়েছে, দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতির চাহিদা মেটাতে ভারত আরও কয়লাখনি খনন করবে। এ লক্ষ্যে দেশটির সরকার ২ হাজার ৯৮০ কোটি রুপি অনুমোদন করেছে।

২০২৩-২৪ অর্থবছরে ১২০ কোটি টন কয়লা উত্তোলনের পরিকল্পনা করেছে ভারত। এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হলে ভারত বর্তমানে যে পরিমাণ কয়লা উত্তোলন করে, তার চেয়ে ৭৫ শতাংশ বেশি উৎপাদন করতে হবে। সম্প্রতি এক প্রতিবেদনে এমনটা জানিয়েছে ভারতের কয়লাবিষয়ক মন্ত্রণালয়।

ওই লক্ষ্য অর্জনের জন্যই কয়লা উৎপাদন বাড়াতে নতুন করে বিপুল পরিমাণ অর্থের এই তহবিল অনুমোদন করেছে দেশটির কেন্দ্রীয় সরকার।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.