এলপি গ্যাসে আশার আলো

0
97

আবাসিক লাইনে গ্যাস সংযোগ বন্ধ তাও প্রায় এক যুগ। এতে গ্রাহকরা পরিবেশবান্ধব তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাসে (এলপিজি) ঝুঁকেছেন। প্রাকৃতিক গ্যাসের সংকট, প্রচলিত জ্বালানির দুষ্প্রাপ্যতায় দিন দিন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে এলপিজি। গ্যাস সংযোগের পাইপলাইন নেই এমন শহর, গ্রামগঞ্জেও রান্নার কাজে সিলিন্ডার এলপিজির ব্যবহার বেড়েছে বহু গুণ। গাড়িতেও ব্যবহৃত হচ্ছে এলপিজি, যা অটোগ্যাস নামে পরিচিত। জেলায় জেলায় গড়ে উঠছে অটোগ্যাস স্টেশন। কলকারখানাতেও এলপিজি ব্যবহৃত হচ্ছে। সরকারের নানা সহযোগিতায় এলপি গ্যাস এখন অনেকটাই গ্রাহকের নাগালে। চাহিদার ৯৯ শতাংশ এলপিজি আমদানি করা হয়, তবে দেশের চাহিদা মিটিয়ে অনেক কোম্পানি এলপিজি বোতলজাত করে এখন রপ্তানিও করছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশের গ্যাস ক্ষেত্রগুলোর মজুত দিন দিন কমে যাওয়া এবং তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানি ব্যয়বহুল হওয়ায় চাহিদা অনুসারে গ্যাস সরবরাহ করা যাচ্ছে না। গ্যাস সংকটে শিল্প উৎপাদনও ব্যাহত হচ্ছে। বাসাবাড়িতে জ্বলছে না চুলা। এই সংকটের সমাধান দিতে পারে এলপিজি। এ ছাড়া এলপিজি দামে সাশ্রয়ী, পরিবেশবান্ধব ও নিরাপদ জ্বালানি। তাই এলপিজি দেশের জ্বালানি নিরাপত্তায় বড় ভূমিকা রাখছে।

এলপিজি অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশনের (লোয়াব) তথ্য বলছে, দেশে এলপি গ্যাসের ব্যবহার শুরু হয় ১৯৯৯ সালে। এখন দেশে অনুমোদন পাওয়া এলপিজি সরবরাহকারী বেসরকারি কোম্পানি ৫৮টি, এর মধ্যে সক্রিয় ২৯টি। এ ছাড়া এলপিজি কোম্পানি লিমিটেড নামে একটি সরকারি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান রয়েছে। বেসরকারি কোম্পানিগুলোর মধ্যে বসুন্ধরা, বেক্সিমকো, ওমেরা, সেনা, যমুনা, টোটাল, ওরিয়ন, জি-গ্যাস, নাভানাসহ অনেক কোম্পানি বাজারে এলপিজি বিক্রি করছে। বড় ২০ কোম্পানি এলপিজি কাঁচামাল প্রোপেন ও বিউটেন আমদানি করে নির্দিষ্ট অনুপাতে মিশিয়ে বিক্রি করছে বোতলজাত করে। কয়েকটি কোম্পানি এদের থেকে কিনে শুধু বোতলে ভরে এলপিজি বিক্রি করছে। দেশে ১২ থেকে ৪৫ কেজি পর্যন্ত বিভিন্ন পরিমাণে এলপি গ্যাস সিলিন্ডারে বিক্রি হয়। বাসাবাড়িতে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয় ১২ ও ১৫ কেজির সিলিন্ডার, দাম যথাক্রমে ৯৯৯ ও ১২৪৮ টাকা। ৩০-৪৫ কেজির সিলিন্ডার বেশি ব্যবহৃত হয় হোটেল-রেস্তোরাঁসহ বিভিন্ন বাণিজ্যিক কাজে। ৩০ কেজির দাম ২৪৯৬ টাকা আর ৪৫ কেজির দাম ৩৭৪৪ টাকা।

এলপিজির বার্ষিক চাহিদা ১৪ লাখ টনের বেশি। এই খাতে বিনিয়োগ ৩২ হাজার কোটি টাকা। গ্রাহক প্রায় ৪০ লাখ। প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে তিন কোটির বেশি মানুষ এ গ্যাসের সুবিধাভোগী। তিন-চারজন সদস্যের একটি পরিবারের ১২ কেজির এক থেকে দেড়টি সিলিন্ডারে মাস চলে যায়।

বর্তমানে বছরে এলপিজির মার্কেট ১০ শতাংশ হারে বাড়ছে। এলপি গ্যাস দেশের জ্বালানি চাহিদার ৯ শতাংশ পূরণ করছে। গৃহস্থালিতে ৮৪ শতাংশ, শিল্পকারখানায় ১২ শতাংশ ও পরিবহন খাতে ৪ শতাংশ এলপিজি ব্যবহার হচ্ছে। আশা করা হচ্ছে, ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশে এলপিজির চাহিদা ৩০ লাখ টনে উন্নীত হবে। বাংলাদেশ মূলত কাতার, কুয়েত ও ইরান থেকে এলপিজি আমদানি করে।

কম্প্রেসড ন্যাচারাল গ্যাসের (সিএনজি) দাম বাড়ায় অনেক গাড়ির মালিক এখন এলপিজির দিকে ঝুঁকছেন। তেলের চেয়ে এলপিজিতে জ্বালানি খরচ সাশ্রয় হচ্ছে প্রায় ৩৫ শতাংশ। সাধারণভাবে ঢাকা নগরের মধ্যে ১ লিটার বা ১৩০ টাকার অকটেন দিয়ে ১৫০০ সিসির একটি ব্যক্তিগত গাড়ি ১০-১২ কিলোমিটার যেতে পারে। একই টাকার এলপিজি দিয়ে ১৮-২০ কিলোমিটার যাওয়া সম্ভব। এখন প্রতি লিটার অটোগ্যাসের দাম ৪৬ টাকা ৫৯ পয়সা।

এ খাতের প্রসারে ২০১৭ সালে ১৫ শতাংশ ডিউটি ফি মওকুফ করে সরকার। অগ্রিম আয় কর (এআইটি) ৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২ শতাংশ এবং অগ্রিম কর (এটি) ৩ শতাংশ করা হয়। ২০২১ সালে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ভ্যাট ১৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৭ শতাংশ করে দেয়। দেশে এলপিজি সিলিন্ডার উৎপাদনের ওপর আগের ১৫ শতাংশ ভ্যাট কমিয়ে ৫ শতাংশ করা হয়েছে। এতে এলপিজির দাম অনেক কমে আসে। তবে অভিযোগ রয়েছে, এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) যে দাম নির্ধারণ করে, সে দামে বাজারে গ্যাস মেলে না।

এ ব্যাপারে এলপিজি ব্যবসায়ীরা বলছেন, বিইআরসি প্রতি মাসে একটি নির্দিষ্ট নিয়মের মাধ্যমে খুচরা পর্যায়ে দর নির্ধারণ করে। কিছু অসঙ্গতির কারণে বিইআরসির মূল্য তালিকা খুচরা পর্যায়ে ঠিকভাবে প্রতিফলিত হয় না। কারণ, বিইআরসি ডিস্ট্রিবিউটর পর্যায়ে ৩৭ টাকা এবং খুচরা পর্যায়ে ৩৮ টাকা কমিশন ধরে। তবে ঘর ভাড়া, গাড়ি ভাড়া, কর্মচারীর বেতন দেওয়ার পর পরিবেশক এবং খুচরা ব্যবসায়ীদের কোনোভাবেই মুনাফা আসে না। তাই তারা বিইআরসি নির্ধারিত দরে বিক্রি করতে পারে না। এ জন্য তারা কিছুটা বেশি দামেই বিক্রি করতে বাধ্য হয়। বিইআরসির বৰ্তমান দর নির্ধারণ পদ্ধতি ২০২১ সালের এপ্রিলে করা হয়েছে। এর মধ্যে সব পণ্যের দাম বেড়েছে, মূল্যস্ফীতি, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন বৃদ্ধি, ডলার সংকট, বাড়তি সুদের হার– এর কোনোটিই বিইআরসির দর নির্ধারণ প্রক্রিয়ায় আনা হচ্ছে না। ব্যবসায়ীরা বলছেন, বিইআরসি ঘোষিত দর অনুযায়ী এলপিজি সরবরাহ করার চেষ্টা করতে গিয়ে অনেক কোম্পানি এরই মধ্যে মূলধন হারিয়েছে।

এলপিজি ব্যবসায়ীরা এই খাতের প্রসারে কিছু সীমাবদ্ধতাও তুলে ধরেন। তাদের মতে, বর্তমানে এ শিল্পের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ সঠিক অবকাঠামোর অভাব। কর্ণফুলী নদীতে মাত্রাতিরিক্ত পলি জমার কারণে বড় জাহাজের বদলে ফিডার ভেসেলের মাধ্যমে এলপিজি টার্মিনালে আনতে হয়, যা আমদানি খরচ বাড়িয়ে দেয়। এ ছাড়া এলপিজিভর্তি ছোট জাহাজ যদি দেশের নদীগুলোর মধ্য দিয়ে যেতে পারত, তাহলে খরচ কমে আসত। তবে নদীর নাব্যতা সংকটের কারণে এটি সম্ভব হচ্ছে না। এ কারণে কোম্পানিগুলোকে মোংলা, পায়রা বা চট্টগ্রাম বন্দর থেকে রিফাইনারি পর্যন্ত এবং সেখান থেকে দেশের পরিবেশকদের কাছে ট্যাংকারে করে এলপিজি পরিবহন করতে হয়। এতে প্রচুর টাকা খরচ হচ্ছে।

জ্বালানি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দরের ১৫ কোটি ডলারে ৩০ হাজার টন স্টোরেজ ক্ষমতাসহ একটি রেফ্রিজারেটেড এলপিজি বেস টার্মিনাল নির্মাণাধীন রয়েছে। এটির কাজ শেষ হলে বড় জাহাজে এলপিজি আনা সম্ভব হবে। তখন দাম কমে আসবে।

এলপিজি ব্যবসার প্রসারে সরকারের আরও সহযোগিতা চান ব্যবসায়ীরা। তারা জানান, এই শিল্পের গুরুত্বপূর্ণ কিছু যন্ত্রপাতির দাম অনেক বেশি। এর জন্য কিছু প্রণোদনা বা কর ছাড় সুবিধা দেওয়া যেতে পারে। কাস্টমসে প্রডাক্ট ছাড়াতেও অনেক সময় যাচ্ছে, এটাও বড় সমস্যা। তারা বলেন, শিল্পকারখানার মালিকদের বাল্ক এলপিজি ব্যবহারে উৎসাহিত করতে এবং ডিজেল বা ফার্নেস অয়েলের ব্যবহার কমাতে সরকারের ভর্তুকি দেওয়া দরকার। প্রাকৃতিক গ্যাসের সংকট কাটাতে অটোগ্যাসের ব্যবহারকেও সরকারকে উৎসাহিত করতে হবে। সিএনজির জায়গায় এলপিজি প্রতিস্থাপন করতে অটোমোবাইল, থ্রি-হুইলার এবং স্টেশন মালিকদের বিনিয়োগে সমর্থন দিতে হবে।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ম. তামিম বলেন, এলএনজি ও এলপিজি– দুটোই আমদানি করতে হয়। এলপিজির দর জ্বালানি তেলের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। তাই এলএনজির চেয়ে এলপিজি আগামীতে সাশ্রয়ী হতে পারে। তিনি বলেন, যেসব জায়গায় প্রাকৃতিক গ্যাসের নেটওয়ার্ক গড়ে ওঠেনি, সেখানে রান্নার কাজে, শিল্পকারখানা চালাতে, পরিবহনে এলপিজির বিকল্প নেই। যেহেতু বাসাবাড়িতে প্রাকৃতিক গ্যাসের নতুন সংযোগ বন্ধ আছে, তাই ঢাকাসহ অন্য শহরগুলোতে এলপিজির ব্যবহার বাড়ছে। ইদানীং গাড়িতেও এলপিজি ব্যবহৃত হচ্ছে। তাই দেশের জ্বালানির সংকট মেটাতে আগামীতে এলপিজি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, প্রাকৃতিক গ্যাসের মজুত কমছে। তাই বাসাবাড়িতে নতুন করে গ্যাস সংযোগ দেওয়া হচ্ছে না। রান্নার জন্য এলপিজি এখন জনপ্রিয় হচ্ছে। এর দাম সহনীয় রাখতে সরকার নানা পদক্ষেপ নিয়েছে। অনেক কোম্পানিকে লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে। আমদানি পর্যায়ে কমানো হয়েছে ভ্যাট-ট্যাক্স। সিলিন্ডার উৎপাদনেও সুবিধা পাচ্ছে ব্যবসায়ীরা। এলপিজি খাতের বিকাশে আগামীতে আরও ইতিবাচক উদ্যোগ নেওয়া হবে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.