এমপি ওদুদের ‘দমন মিশন’

0
77
আব্দুল ওদুদ বিশ্বাস।

চাঁপাইনবাবগঞ্জ-৩ সদর আসনের উপনির্বাচনে আওয়ামী লীগের দলীয় প্রার্থী ছিলেন আব্দুল ওদুদ বিশ্বাস। গত ১ ফেব্রুয়ারির এ নির্বাচনে তাঁর বিরুদ্ধে সামান্য ভোটে হেরেছিলেন জেলা যুবলীগের সাবেক সভাপতি সামিউল হক লিটন। আগামী সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রত্যাশা করায় চাঁপাইনবাবগঞ্জ পৌর মেয়র মোখলেছুর রহমানের সঙ্গেও বিরোধ চলছে এ সংসদ সদস্যের। এখন এসব রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের নামে হত্যা মামলা দিয়ে প্রতিপক্ষ ‘দমন মিশনে’ নেমেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে তাঁর বিরুদ্ধে। মামলা ও গ্রেপ্তারের ভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন অনেকে।
আব্দুল ওদুদ বিশ্বাসের অনুগত পুলিশের তালিকাভুক্ত শীর্ষ সন্ত্রাসী খায়রুল আলম জেম সম্প্রতি প্রকাশ্যে খুন হন। হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় জড়িত প্রকৃত অপরাধীর তুলনায় এমপি ওদুদ তাঁর রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকেই বেশি আসামি করেছেন। আগামী সংসদ নির্বাচনে নিজের পথ পরিষ্কার রাখতে তাঁর প্রধান প্রতিপক্ষদের ফাঁসিয়ে চাপে রাখতেই এ কৌশল নিয়েছেন বলে দাবি করছেন ভুক্তভোগীরা।

গত ১৯ এপ্রিল সন্ধ্যায় চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহরের উদয়ন মোড়ে প্রকাশ্যে ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হয় শিবগঞ্জ পৌরসভার ৯ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর ও জেলা যুবলীগের শ্রমবিষয়ক সম্পাদক খায়রুল আলম জেমকে (৫৪)। তাঁর বাড়ি শিবগঞ্জ পৌরসভার মর্দনা গ্রামে হলেও তিনি শহরের নয়াগোলা এলাকায় বসবাস করতেন।
স্থানীয়রা জানান, দীর্ঘদিন ধরে জেলা কৃষক লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মেসবাউল হক টুটুল ও ইব্রাহিমের সঙ্গে বিরোধ ছিল জেমের। সেই বিরোধকে কেন্দ্র করে দু’পক্ষের মধ্যে পাল্টাপাল্টি সংঘাত, হত্যাকাণ্ড ও বোমাবাজির ঘটনা ঘটেছে। এসব অভিযোগে জেমের বিরুদ্ধে হত্যাসহ ১৬টি মামলা রয়েছে। নিহত জেম জেলা পুলিশের তালিকাভুক্ত শীর্ষ সন্ত্রাসী ছিলেন বলে সদর থানার ওসি সাজ্জাদ হোসেন নিশ্চিত করেন।

পুলিশ ও দলীয় সূত্রগুলো থেকে জানা যায়, গত ৫ ডিসেম্বর স্থানীয় পৌর পার্ক মাঠে জেলা কৃষক লীগের সম্মেলনে ব্যাপক বোমাবাজির ঘটনা ঘটে। জেম ও তাঁর প্রতিপক্ষ টুটুল গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এসবকে কেন্দ্র করে ফেসবুকে প্রতিপক্ষের উদ্দেশ্যে পাল্টাপাল্টি হুমকিমূলক পোস্ট দিতেন তাঁরা। খুন হওয়ার এক দিন আগে জেম হুমকি দিয়ে ফেসবুকে একটি পোস্ট দেন। এর পরের দিন প্রতিপক্ষের ছুরিকাঘাতে তিনি খুন হন।

জেম হত্যার ঘটনাটি রাজনৈতিক আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে শহরের মধ্যে ঘটলেও অভিযোগ উঠেছে, স্থানীয় এমপি আব্দুল ওদুদের ইন্ধনে এ মামলায় পৌর মেয়র, সম্ভাব্য এমপি প্রার্থী ছাড়াও জেলার হাট, ঘাট মালিক, বালু ব্যবসায়ী, চেয়ারম্যান-মেম্বার থেকে শ্রমিক, শিক্ষক-ছাত্র বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ আসামি হয়েছেন। যাঁরা গত উপনির্বাচনে ওদুদ বিশ্বাসের বিরোধিতা করেছেন, তাদেরও আসামি করেছেন।
তাঁর রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ চাঁপাইনবাবগঞ্জ পৌর মেয়র ও জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য মোখলেসুর রহমানকে এ মামলায় প্রধান আসামি করা হয়। আগামী সংসদ নির্বাচনে ওদুদের বিরুদ্ধে তিনি আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চাইবেন বলে প্রচার রয়েছে। এ কারণে মেয়রের সঙ্গে বিরোধ চলছে।
এ ছাড়া গত সংসদ উপনির্বাচনে ওদুদের বিরুদ্ধে ২ হাজারের বেশি ভোটে হেরে যাওয়া জেলা যুবলীগের সাবেক সভাপতি সামিউল হক লিটনকে করেছেন দুই নম্বর আসামি।

একই সঙ্গে পৌর মেয়র মোখলেছুর রহমানের মালিকানাধীন গ্রামীণ ট্রাভেলসের জিএম ও জেলা শ্রমিক লীগের সহসভাপতি আসাদুজ্জামান ছানা, কাউন্টার ম্যানেজার শামসুল হোদা সনি, রানীহাটি ইউপি চেয়ারম্যান রহমত আলী, চর বাগডাঙ্গা ইউপি চেয়ারম্যান শহিদ রানা টিপুসহ ৪৮ জনকে জেম হত্যা মামলার আসামি করা হয়েছে, যাঁরা তাঁকে খুব একটা চিনতেনও না।
এ বিষয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জ পৌর মেয়র মোখলেছুর রহমান বলেন, আমার নামে আজ পর্যন্ত কোনো মামলা হয়নি। এটাই জীবনের প্রথম মামলা। আগামী সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়ন পাওয়ার জন্য কাজ করছি, প্রচার চালাচ্ছি। এ কারণেই সংসদ সদস্য আব্দুল ওদুদ বিশ্বাস আমার নামে হত্যা মামলা করিয়েছেন। নিহত জেম এবং মামলার বাদী মনিরুল ইসলাম তাঁর ঘনিষ্ঠ ও অনুগত। এমপির নির্দেশেই তাঁর রাজনৈতিক প্রতিপক্ষদের নিধন করতে এ হত্যা মামলা দেওয়া হয়েছে।

তিনি আরও বলেন, টুটুল ও ইব্রাহিমের সঙ্গে নিহত জেমের পুরোনো বিরোধ ছিল। এর সূত্র ধরেই এ হত্যাকাণ্ড হয়েছে। হত্যাকাণ্ডের প্রত্যক্ষদর্শী নিহত জেমের সহযোগী শহর যুবলীগের সাংস্কৃতিক সম্পাদক মামুন ও রানা গণমাধ্যমে হামলার পরই বর্ণনা দিয়ে বলেছেন টুটুল, ইব্রাহিম, রানা, শামীমসহ বেশ কয়েকজন এ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। অথচ এ হত্যা মামলায় আমাকে প্রধান আসামি করা হয়েছে।

চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা যুবলীগের সাবেক সভাপতি সামিউল হক লিটন বলেন, রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে আমাকে আসামি করা হয়েছে। নিহত জেমের সঙ্গে আমাদের চলাফেরা ছিল না। আমি সবসময় মারামারি-কাটাকাটির বিপক্ষে। মারামারি-কাটাকাটি পছন্দ করলে গত উপনির্বাচনে আমি এমপি হতাম।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি অধ্যক্ষ আব্দুল জলিল বলেন, যে কোনো হত্যাকাণ্ড বেদনার। কিন্তু জেম হত্যায় এমপি ওদুদ রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে জেলাজুড়ে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষকে আসামি করেছেন। দলের ভেতরে ও বাইরে যাঁরা গত উপনির্বাচনে তাঁর বিপক্ষে ছিলেন তাঁদের অনেকেই জেম হত্যার আসামি হয়েছেন। এ নিয়ে স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীর মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। বিষয়টি কেন্দ্রকে লিখিতভাবে জানানো হবে।

চাঁপাইনবাবগঞ্জ সচেতন নাগরিক কমিটির (সনাক) সিনিয়র সদস্য অ্যাডভোকেট সাইফুল রেজা বলেন, যে কোনো মামলায় প্রকৃত আসামির চেয়ে অধিক আসামি করা হলে গোটা মামলা বিবর্ণ হয়ে যায়। এ ক্ষেত্রে অনেক আসামির অব্যাহতি পেতে কিছুটা সহজ হয়ে যায়। তাদের দায়মুক্তির পথটাও সুগম হয়।
তবে এ বিষয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সংসদ সদস্য আব্দুল ওদুদ বিশ্বাস বলেন, জেম হত্যা মামলায় আমার হাত নেই। তবে হত্যার বিচার দাবি করছি। মামলার বাদী নিহতের ভাই মনিরুল ইসলাম, আমি না। মৃত্যুর আগে জেম বলে গেছে, তারা মেরে ফেলতে পারে। পৌর মেয়র হওয়ার পর মোখলেছ অনেককে মেরেছে। তিনি ১০ জনকে হত্যা করবেন বলে একটা তালিকা করেছিলেন। সেই তালিকায় আমার নাম ১০ নম্বরে, জেম ছিল ১ নম্বরে।

চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর থানার ওসি সাজ্জাদ হোসেন জানান, নিহত জেমের ভাই বাদী হয়ে এ ঘটনায় ৪৮ জনের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করেছেন। পুলিশ এজাহারভুক্ত ১৪ জনকে গ্রেপ্তার করেছে। অন্যদের গ্রেপ্তারে অভিযান অব্যাহত রয়েছে।
চাঁপাইনবাবগঞ্জের পুলিশ সুপার এএইচএম আবদুর রকিব বলেন, বাদী যেভাবে এজাহার দেন সেটাকেই মামলা আকারে রেকর্ড করতে হয়। তবে তদন্তের পর আমরা বলতে পারব কারা অভিযুক্ত আর কারা নির্দোষ।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.