ইসির ক্ষমতা কমানো সর্বোচ্চ আদালতের রায়ের লঙ্ঘন

0
114
ইসির ক্ষমতা কমানো

গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) সংশোধনের মাধ্যমে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) ক্ষমতা খর্বের বিলকে সর্বোচ্চ আদালতের রায়ের পরিপন্থি বলে আখ্যা দিয়েছেন কয়েকজন বিশেষজ্ঞ। তবে গত মঙ্গলবার রাতে বিরোধীদের আপত্তির মুখে পাস হওয়া এ বিলের বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেননি প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল। তিনি বলেছেন, বিলটি আইনে পরিণত হওয়ার পর কথা বলবেন।

তবে সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন বলেছেন, ইসি আরপিও সংশোধন প্রস্তাব করার মাধ্যমে উপযাচক হয়ে নিজের ক্ষমতা কমিয়েছে। আপিল বিভাগের রায় থাকার পর আরপিওর ৯১(ক) ধারা স্পষ্ট করার নামে সংশোধনের প্রয়োজন ছিল না।

সংসদে পাস হওয়া আরপিও সংশোধন বিলকে সংবিধানের ১২৬ অনুচ্ছেদের মূল ধারণা ও চেতনার পরিপন্থি বলে আখ্যা দিয়েছেন বিশিষ্ট আইনজীবী ড. শাহ্‌দীন মালিক। সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেছেন, ১৯৯৯ সালে নূর হোসেন বনাম নজরুল ইসলাম মামলায় আপিল বিভাগ রায় দিয়েছেন– অনিয়ম হলে ফলাফল বাতিল করে পুনঃভোটের আদেশ দিতে পারবে নির্বাচন কমিশন। সংশোধিত আরপিওতে এ ক্ষমতা খর্ব করা হয়েছে।

বর্তমান আরপিওর ৯১ (ক) ধারা অনুযায়ী নির্বাচনে অনিয়ম হলে ইসি যে কোনো ভোটকেন্দ্রের বা পুরো নির্বাচন এলাকার ভোট গ্রহণ এবং সকল নির্বাচনী কার্যক্রম যে কোনো পর্যায়ে বন্ধ করতে পারে। এ ধারার ক্ষমতাবলে ইসি নির্বাচন এবং ফল বাতিল করতে পারে। ভোট গ্রহণের আগে নির্বাচন বন্ধ করতে পারে।

সংশোধিত আরপিও অনুযায়ী, নির্বাচনের পরিবর্তনে ‘ভোট গ্রহণ’ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। ফলে ভোট গ্রহণের আগে ইসি চাইলেও এখন আর নির্বাচন বন্ধ করতে পারবে না। এ ছাড়া রিটার্নিং কর্মকর্তা ফলাফল ঘোষণা করার পর কোনো অনিয়মের অভিযোগ উঠলেও পুরো আসনের ফল স্থগিত বা ভোট বাতিল করতে পারবে না। শুধু যেসব ভোটকেন্দ্রে অনিয়মের অভিযোগ থাকবে, সেসব   কেন্দ্রের ফলাফল চাইলে স্থগিত করতে পারবে।

গত বছর গাইবান্ধা-৫ আসনের উপনির্বাচনে ৫১টি কেন্দ্রে অনিয়মের কারণে পুরো নির্বাচন বাতিল করেছিল ইসি। এই ক্ষমতা আর থাকছে না সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানটির। তবে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সংসদে বলেছেন, আরপিও সংশোধনে ইসির ক্ষমতা খর্ব করা হয়নি। তাঁর দাবি, কোনো একটি কেন্দ্রের অনিয়মের কারণে পুরো নির্বাচন বাতিল করা হলে, অন্য কেন্দ্রের ভোটারদের গণতান্ত্রিক অধিকার ক্ষুণ্ন হয়।

নীরব সিইসি

ক্ষমতা হারালেও আরপিও সংশোধন নিয়ে এখনই কথা বলতে নারাজ প্রধান নির্বাচন কমিশনার। গতকাল বুধবার রাজধানীর আগারগাঁওয়ে নির্বাচন ভবনে সাংবাদিকদের প্রশ্নে তিনি বলেছেন, ‘সংসদে পাস হওয়া বিলটি আগে আইনে পরিণত হোক। বিল পাস হলেও এখনও আইন হয়নি। পাস হওয়া বিলে রাষ্ট্রপতি সম্মতি দিলে তা গেজেট হবে। আইনে পরিণত হবে। তখনই বলা সমীচীন হবে। তার আগে পর্যন্ত নিশ্চিত নই। তারপর আমি অবশ্যই কথা বলব। বিস্তারিত ব্যাখ্যা করে বলব ইসির অবস্থান কী। এই মুহূর্তে কথা বলব না।’

উপযাচক হয়ে ক্ষমতা হারাল

সাবেক নির্বাচন কমিশনার সাখাওয়াত হোসেন বলেছেন, প্রথম কথা হচ্ছে, আরপিও সংশোধনের কী প্রয়োজন ছিল? বিদ্যমান আরপিওতে ২০০৫, ২০১৪ এবং ২০১৮ সালের নির্বাচন হয়েছে। ইসি আগ বাড়িয়ে সংশোধনের প্রস্তাব দিয়েছে। সরকার এর সুযোগ নিয়েছে। যে কোনো রাজনৈতিক দলই সুযোগ নিত। ইসি সেই সংশোধনের প্রস্তাব করে সুযোগ করে দিয়েছে। ইসি যেসব ক্ষমতা চেয়েছিল তা পায়নি। উল্টো যে ক্ষমতা ছিল তা হারিয়েছে ‘পাগলকে সাঁকো নাড়াতে বারণ করে।’ ২০০৮ সালের নির্বাচন পরিচালনার অভিজ্ঞতা থেকে সাখাওয়াত হোসেন বলেছেন, ইসির আসল ক্ষমতা ৯১(ক)। এই ধারার বলে যে কোনো সময়ে নির্বাচন বন্ধ করতে পারে ইসি। হিরো আলম নামে পরিচিত ঢাকা-১৭ আসনের উপনির্বাচনের প্রার্থী আশরাফুল আলম বুধবার আক্রান্ত হয়েছেন ভোটের প্রচার চালাতে গিয়ে। এমন পরিস্থিতিতে নির্বাচন কমিশন নিজের ক্ষমতা প্রয়োগ করে প্রতিকার করবে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও প্রশাসন নির্দেশনা না মানলে ইসি ৯১(ক) ধারার প্রয়োগ করে নির্বাচনই বন্ধ করে দিতে পারবে। এ ধারাই যদি না থাকে তাহলে ইসির কথা কে শুনবে?

নূর হোসেন বনাম নজরুল ইসলাম মামলার রায়ের বরাতে সাখাওয়াত হোসেন বলেছেন, আপিল বিভাগ কোথাও বলেনি এই রায় জাতীয় নির্বাচনে প্রযোজ্য হবে না। আরপিও সংশোধন হলেও ইসি চাইলে এই রায়ের আলোকে নির্বাচন বন্ধ ও ফল বাতিল করতে পারবে। সংবিধানের ১১৯ অনুচ্ছেদও ক্ষমতা দিয়েছে ইসিকে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, ইসি সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনে এসব ক্ষমতা প্রয়োগে ইচ্ছুক কিনা?

সরকারের এখতিয়ার নিয়ে প্রশ্ন

নূর হোসেন বনাম নজরুল ইসলাম মামলার রায়ের উদাহরণ দিয়ে ড. শাহ্দীন মালিক বলেছেন, সংসদ আইন পাস করতেই। কিন্তু রায়ের পরিপন্থি আইন পাস হলে আদালত সংসদের ইচ্ছার ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। ফলে সমাজে বিশৃঙ্খলা তৈরি হতে পারে। সংবিধান ইসিকে সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনের দায়িত্ব দিয়েছে। কিন্তু হাত-পা বেঁধে দিলে দায়িত্ব পালনে তারা অক্ষম হয়ে পড়বে।

আরপিও সংশোধনের মাধ্যমে ইসির সাংবিধানিক স্বাধীনতাকে অস্বীকার করা হয়েছে বলে মনে করেন শাহ্দীন মালিক। তিনি বলেছেন, ইসির বিচার-বিবেচনা, সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং নিরপেক্ষতাকে সরাসরি প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়েছে। নির্বাচন কমিশন আরপিও সংশোধনের যেসব প্রস্তাব করেছিল, তা পরিবর্তন করে সংসদে পেশ করেছে, যা সংবিধানের ১২৬ অনুচ্ছেদের মূল ধারণা ও চেতনার পরিপন্থি। ১২৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব পালনে সহায়তা করা সব কর্তৃপক্ষের কতর্ব্য। তবে মন্ত্রিপরিষদ ইসির প্রস্তাব সংশোধন করেছে। এই এখতিয়ার মন্ত্রিসভা তথা সরকারের নেই।

সুষ্ঠু নির্বাচন আরও ঝুঁকিতে

সংবিধান ও আরপিও ক্ষমতা দিলেও আগের দুটি সংসদ নির্বাচন ইসি সুষ্ঠুভাবে করতে পারেনি বলে অভিযোগ করেছেন বদিউল আলম মজুমদার। তিনিও প্রশ্ন তুলেছেন, ইসি কেন আরপিও সংশোধনের প্রস্তাব দিয়েছিল?

সুজন সম্পাদক বলেছেন, আরপিও সংশোধনের কারণে নির্বাচন কমিশন শুধু ভোটের দিনে অনিয়মের অভিযোগ পেলে সংশ্লিষ্ট কেন্দ্রের ভোট গ্রহণ বন্ধ করতে পারবে। ভোটের দিন ব্যতীত অন্য কোনো সময় নির্বাচন বা ফলাফল স্থগিত অথবা বাতিল করতে পারবে না। এতে সুষ্ঠু নির্বাচন আরও ঝুঁকিতে পড়বে।

বদিউল আলম মজুমদার বলেন, আগামী নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক ও প্রতিযোগিতাপূর্ণ হবে কিনা তা নিয়ে আগে থেকেই সংশয় ছিল। আরপিও সংশোধনে সেই ঝুঁকি আরও বাড়ল। নির্বাচন বন্ধের ক্ষমতা হারানোর কারণে বড় অনিয়ম হলেও ইসি তার প্রতিকার করতে পারবে না। কোনো অস্পষ্টতা থাকলে ইসি তা বিধিমালা করে দূর করতে পারত। ভারতের নির্বাচন কমিশন তাই করেছে। কিন্তু ইসি আরপিও সংশোধনের প্রস্তাব কেন, কী উদ্দেশ্যে করেছে তা বোধগম্য নয়। নির্বাচন কমিশনাররা উপলব্ধিই করতে পারছে না সংবিধান তাদের কতটা ক্ষমতা দিয়েছে। সে কারণেই ইসি সব দল ও সংগঠনের আস্থা অর্জন করতে পারেনি।

রাজীব আহাম্মদ

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.