আবারও অস্থিরতা আওয়ামী ওলামা লীগে

0
103
ওলামা লীগের আংশিক কমিটিতে সহসভাপতির পদ পাওয়া মুফতি মাসুম বিল্লাহ নাফিয়ী ২৪ জুন জাতীয় প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে প্রতিবাদ জানান

টাকার বিনিময়ে কমিটিতে পদ দেওয়াসহ নানা অভিযোগে অস্থিরতা দেখা দিয়েছে আওয়ামী ওলামা লীগে। আনুষ্ঠানিক কমিটি ঘোষণার আগেই বিদ্রোহ শুরু হয়েছে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ সমর্থক সংগঠনটিতে। ইতিমধ্যে এক পক্ষ সংবাদ সম্মেলন করে প্রকাশিত কমিটি নিয়ে অনাস্থা প্রকাশ করেছে।

ওলামা লীগের একটি আংশিক কমিটির তালিকা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়েছে। তাতে দেখা যাচ্ছে, কমিটি গঠনের ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের সই রয়েছে। ওই কমিটিতে ওলামা লীগের সভাপতি, কার্যকরী সভাপতি, সাধারণ সম্পাদকের পদসহ ৩২ জন বিভিন্ন পদ দেওয়া হয়েছে। সামাজিক মাধ্যমে এটি প্রকাশ হওয়ার পর থেকে ওলামা লীগের অনেকে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করেছেন। তাঁদের একটি অংশ সংবাদ সম্মেলন করে টাকা নিয়ে কমিটিতে পদ দেওয়াসহ নানা অভিযোগ তুলেছেন। যদিও অন্য অংশ অভিযোগ অস্বীকার করেছে। তবে সংগঠনটির ভেতরে বিরোধ বেড়েছে এবং অভিযোগ পাল্টা অভিযোগ চলছে।

দ্বন্দ্ব-সংঘাতের কারণে ২০১৭ সালে ওলামা লীগের কার্যক্রমই বিলুপ্ত ঘোষণা করেছিল আওয়ামী লীগ। এর প্রায় ছয় বছর পর গত ২০ মে প্রথম জাতীয় সম্মেলন হয় সংগঠনটির। সেই সম্মেলনে অতিথি হয়েছিলেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক।

ওলামা লীগের বিতর্কিত নানা কর্মকাণ্ডের কারণে সংগঠনটির সঙ্গে কোনো সম্পর্ক না রাখার কথাই বলে আসছিল আওয়ামী লীগ। কিন্তু জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে ক্ষমতাসীন দলের পক্ষ থেকে ওলামা লীগকে কাছে টানার উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে। আর এই উদ্যোগের অংশ হিসেবে ওলামা লীগকে পুনর্গঠনের প্রক্রিয়া শুরু করে আওয়ামী লীগ। দলটির একাধিক নেতা বলেছেন, ওলামা লীগের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের জেরে অস্থিরতা আরও বেড়েছে। ফলে এই পরিস্থিতি আওয়ামী লীগকেই বিব্রত করছে।

২৪ জুন জাতীয় প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে অনানুষ্ঠানিকভাবে ঘোষিত কমিটির বিরোধিতা করে তা প্রত্যাখ্যান করেন সংগঠনটির একাংশের নেতারা। ওই সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত নেতাদের প্রায় সবাই বিলুপ্ত ওলামা লীগের বিভিন্ন পক্ষের নেতা ছিলেন। নতুন কমিটির তালিকায়ও তাঁদের অনেকের নাম আছে। এরপরও তাঁরা কমিটি প্রত্যাখ্যান করেছেন। এই সংবাদ সম্মেলন করার বিষয়ে আওয়ামী লীগের নেতাদের কেউ আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানাননি।

ওলামা লীগের কমিটি নিয়ে বিরোধ আবারও প্রকাশ্যে

আওয়ামী লীগ ও ওলামা লীগের সূত্র বলছে, কমিটি নিয়ে বিক্ষুব্ধদের মধ্যে দুই শ্রেণির নেতা রয়েছেন। একটি পক্ষ মনে করছেন, তাঁরা কাঙ্ক্ষিত পদ পাননি। গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোয় যাঁদের নাম রয়েছে, তাঁরা আগে ওলামা লীগ করতেন না। আরেকটি পক্ষ নিজেদের নাম কমিটির তালিকায় না দেখে ক্ষুব্ধ হন। তবে সবচেয়ে বেশি ক্ষোভ দেখা গেছে সাধারণ সম্পাদক পদ পাওয়া আমিনুল হককে নিয়ে। বিক্ষুব্ধদের অভিযোগ, টাকার বিনিময়ে ওলামা লীগের পদ দেওয়া হয়েছে।

গত ২০ মে ওলামা লীগের সম্মেলনে দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ও প্রচার সম্পাদক আবদুস সোবহান ওরফে গোলাপ উপস্থিত ছিলেন। এই দুই নেতার তত্ত্বাবধানেই কমিটি গঠিত হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে। তবে সংগঠনটির বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে চেষ্টা করেও আবদুস সোবহানের বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক হতে আগ্রহীর সংখ্যা অনেক

সূত্রগুলো আরও জানায়, সম্মেলনের আগে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পদে ১৫ জনের মতো নাম আসে। কিন্তু সম্মেলনের দিন সভাপতি পদের জন্য ১৯ জন এবং সাধারণ সম্পাদক পদে ৩১ জন আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয়, সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম কোনো সংগঠনের সম্মেলনে এভাবে প্রকাশ্যে এত নেতার প্রার্থিতা ঘোষণার নজির নেই বলে জানান দলটির নেতারা। ফলে সম্মেলনের দিন কমিটি না দিয়ে পরে ঘোষণা করা হবে বলে তাঁদের জানিয়েছিলেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের।

‘আওয়ামী ওলামা লীগ’ আ.লীগের সহযোগী সংগঠন নয়

আওয়ামী লীগের দলীয় সূত্র বলছে, কার্যক্রম বিলুপ্তির আগে ওলামা লীগের তিন-চারটি ভাগ সক্রিয় ছিল। তাঁদের প্রতিটি পক্ষই এখন বড় পদ চাইছেন। অন্যদিকে দলের নীতিনির্ধারকদের চিন্তা হচ্ছে কওমি মাদ্রাসাপন্থী, তাবলিগ জামাত, আলিয়া মাদ্রাসার সাবেক ছাত্রসহ সব পক্ষকে নিয়ে ওলামা লীগ সাজানো। বিভিন্ন ধারার, মেজাজের ও বিবদমান সব পক্ষকে এক করতে গিয়ে দ্বন্দ্ব রয়েই গেছে।

আওয়ামী লীগের একজন কেন্দ্রীয় নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, নির্বাচন ও বিরোধীদের আন্দোলন সামনে রেখে ওলামা লীগকে সংগঠিত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। দ্বন্দ্বের কারণে নিজেরাই মাঠে নেমে আগের মতো মারমুখী হয়ে ওঠে কি না, এখন সেই শঙ্কা হচ্ছে।

নতুন কমিটির সাধারণ সম্পাদক আমিনুল হক বলেন, সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক পদ দুটি। সবাইকে তো খুশি করা যাবে না। টাকা দিয়ে পদ নেওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করে তিনি বলেন, তিনি ছোটবেলা থেকে তাবলিগ জামাত করেন। এ জন্য হয়তো সক্রিয় রাজনীতিতে এতটা সময় দিতে পারেননি। কিন্তু এখন সময় দিচ্ছেন।

কমিটির বিরোধিতায় যাঁরা

কমিটি নিয়ে বিক্ষুব্ধ যাঁরা ২৪ জুন সংবাদ সম্মেলন করেছেন, তাঁদের মধ্যে রয়েছেন, মাসুম বিল্লাহ নাফিয়ী, কাজী আবুল হাসান শেখ শরীয়তপুরী, মাওলানা সুলাইমান, আনোয়ার হোসেন, আনোয়ার শাহ, হাসানুজ্জামান চিশতী, আসাদুজ্জামান প্রমুখ। তাঁদের সবাই বিলুপ্ত হওয়ার আগে ওলামা লীগের গুরুত্বপূর্ণ পদে ছিলেন।

নতুন কমিটিতে মাসুম বিল্লাহ ও সুলাইমান সহসভাপতি পদে আছেন। আবুল হাসান উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য। আনোয়ার হোসেন সাংগঠনিক সম্পাদক ও হাসানুজ্জামান চিশতি সমাজকল্যাণ সম্পাদক। তবে এতে তাঁরা সন্তুষ্ট নন। বিশেষ করে সাধারণ সম্পাদক পদে আমিনুল হককে নিয়ে তাঁদের বেশি আপত্তি।

ওলামা লীগ সূত্র বলছে, আগে থেকেই ওলামা লীগ গোপালগঞ্জ, শরীয়তপুর, মাদারীপুর ও ফরিদপুর অঞ্চলের নেতাদের প্রাধান্য ছিল। এর বাইরে ঢাকা জেলা ও চট্টগ্রাম জেলার প্রভাব বেশি ছিল। কিন্তু নতুন কমিটিতে সভাপতি এ কে এম আবদুল মোমিন সিরাজী সিরাজগঞ্জের। আর সাধারণ সম্পাদক আমিনুল হকের বাড়ি পাবনায়। ঢাকা থেকে সাগর আহমেদকে কার্যকরী সভাপতি করে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে। কিন্তু বৃহত্তর ফরিদপুর ও চট্টগ্রাম অঞ্চলের নেতারা গুরুত্বপূর্ণ পদ পাননি। এ জন্যই ক্ষোভটা বেশি ওই অঞ্চলের নেতাদের। তাঁদের সঙ্গে অন্যান্য এলাকার বঞ্চিতরাও যোগ হয়েছেন।

মাসুম বিল্লাহ নতুন কমিটিতে সভাপতির দাবিদার ছিলেন। তিনি বলেন, অতীতে যাঁদের রাজপথে দেখা যায়নি, তাঁদের দিয়ে কমিটি হয়েছে। এ জন্য তাঁরা কমিটি প্রত্যাখ্যান করেছেন।

সাধারণ সম্পাদকের দাবিদার ছিলেন কাজী আবুল হাসান। তিনি বলেন, যে স্পিরিট নিয়ে তাঁরা ওলামা লীগকে ঐক্যবদ্ধ করতে চেয়েছেন, তা হোঁচট খেল। নতুন কমিটির সাধারণ সম্পাদক কখনোই ওলামা লীগ করেননি।

রমনায় ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে ২০ মে অনুষ্ঠিত ওলামা লীগের সম্মেলনে প্রধান অতিথি ছিলেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের
রমনায় ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে ২০ মে অনুষ্ঠিত ওলামা লীগের সম্মেলনে প্রধান অতিথি ছিলেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের

বিলুপ্তি ও পুনরায় অনুমতি

ওলামা লীগ নামে ১৯৯৬ সাল থেকেই তৎপর সংগঠনের নেতারা। একপর্যায়ে নানাভাবে বিভক্ত হয়ে নিজেদের মধ্যে মারামারিতে লিপ্ত হন। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সরকার গঠনের পর মূল দলের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যে বিরোধী দাবিদাওয়া উত্থাপন করতে থাকেন নেতারা।

এর মধ্যে ২০১৬ সালে পাঠ্যপুস্তক বাতিলের দাবি তোলে ওলামা লীগ। তাদের অভিযোগ ছিল, কট্টর ইসলামবিরোধী হিন্দু ও নাস্তিক লেখকদের লেখাকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। একই বছর ১০ এপ্রিল জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে এক মানববন্ধনে পয়লা বৈশাখকে ‘অনৈসলামিক ও হারাম’ বলে ঘোষণা করে তারা। ২০১৭ সালের ৪ মার্চ বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন বাতিলের দাবি জানায় সংগঠনটি। সুপ্রিম কোর্টের সামনের গ্রিক দেবীর ভাস্কর্য অপসারণ এবং ক্রিকেট লিগ বিপিএল বাতিলের দাবিও জানায় তারা।

এসব কর্মকাণ্ড সরাসরি আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্রে ঘোষিত লক্ষ্য ও উদ্দেশের বিরোধী। এর পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৭ সালের ২২ মে আওয়ামী লীগের ধানমন্ডি কার্যালয়ে দলটির সম্পাদকমণ্ডলীর এক সভায় ওলামা লীগের কার্যক্রম বন্ধের সিদ্ধান্ত হয়। এরপরও ওলামা লীগের নামে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে নানা ‘উদ্ভট’ দাবি তোলার বিষয়টি অব্যাহত ছিল।

পরে ২০১৯ সালে আওয়ামী লীগের তৎকালীন দপ্তর সম্পাদক আবদুস সোবহান গোলাপের সই করা বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছিল, ওলামা লীগের কার্যক্রম দলের ‘নীতিবিরোধী’।

এখন আবার আওয়ামী লীগ ওলামা লীগকে সংগঠিত করার উদ্যোগ নিয়েছে। কিন্তু সংগঠনটির নেতৃত্ব নিয়ে কোন্দল, দ্বন্দ্ব আরও বেড়েছে।

আনোয়ার হোসেন

ঢাকা

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.