ভুয়া নিয়োগপত্রে প্রতারিত প্রবাসীরা

0
167
প্রবাসী শ্রমিক

সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর ক্ষেত্রে ২৫ জনের বেশি কর্মীর নিয়োগপত্র একসঙ্গে এলে তা যাচাই করে প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়। সংখ্যাটি ২৫–এর কম হলে মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন লাগে না; সরাসরি যাচাই করে বিএমইটি।

জানতে চাইলে বিএমইটির মহাপরিচালক মো. শহীদুল আলম বলেন, সৌদি আরব থেকে অর্ধেকের বেশি ভিসা আসে ব্যক্তিগত পর্যায়ে। সে ক্ষেত্রে ভিসার সত্যতা যাচাই করা হয়। কিন্তু অল্প জনবল নিয়ে এত নিয়োগপত্র যাচাই করা প্রায় অসম্ভব। এখন অনলাইন প্রক্রিয়ায় এটা যাচাই করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

বেশি হারে কর্মী পাঠানোকেই সফলতা মনে করা হয়। তাই যাচাই-বাছাই হচ্ছে না। ভুয়া নিয়োগপত্রে মানুষ গিয়ে নানা হয়রানির শিকার হচ্ছেন।তাসনিম সিদ্দিকী, প্রতিষ্ঠাতা চেয়ার, রামরু

সক্রিয় ভিসা–বাণিজ্য চক্র

বিএমইটির তথ্য বলছে, বিদেশে সবচেয়ে বড় শ্রমবাজার সৌদি আরব। গত বছর দেশটিতে গেছেন ৬ লাখ ১২ হাজার ৪১৮ জন কর্মী। তবে অনেকেই দেশটিতে গিয়ে কাজ পাচ্ছেন না।

প্রায় সাড়ে তিন লাখ টাকা খরচ করে সৌদি আরবে যান যশোরের মো. নাজমুল। মুঠোফোনে  তিনি বলেন, তিনি চাকরি পাননি। তিন মাস পর কাজের অনুমতিপত্রও ছিল না। অবৈধ হয়ে দেড় বছর ধরে পালিয়ে পালিয়ে আছেন। তাঁর মতো আরও অনেক কর্মী এখানে একইভাবে মানবেতর জীবন যাপন করছেন।

সৌদি আরবের বাংলাদেশ দূতাবাস পরিস্থিতি জানিয়ে একাধিকবার চিঠি দিয়ে সরকারকে সতর্ক করেছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে দূতাবাসের দুই কর্মকর্তা বলেন, সৌদি নাগরিকেরা ২ হাজার রিয়াল (৪৫ হাজার টাকা) জমা দিয়ে একজন কর্মী নিয়োগের জন্য ভিসা করাতে পারে। কর্মী নেওয়ার সক্ষমতা হয়তো ওই নাগরিকের নেই, কিন্তু এই নিয়োগপত্র সৌদি কর্তৃপক্ষ যাচাই করে না।

প্রবাসী শ্রমিক থেকে দেশি উদ্যোক্তা

ওই কর্মকর্তারা বলেন, প্রলোভনে পড়ে সৌদি নাগরিকেরা ভিসা–বাণিজ্যে জড়ান। পরে সেই ভিসা বাংলাদেশি চক্রের কাছে বেশি দামে বিক্রি করেন তাঁরা। সৌদি আরবে কাজ করতে আসা প্রায় ১০ শতাংশ কর্মীর প্রতারিত হওয়ার তথ্য তাঁদের কাছে আসছে বলে জানান দূতাবাসের কর্মকর্তারা।

অবৈধভাবে ভিসা–বাণিজ্য নিয়ে ঢাকার সৌদি দূতাবাসের কিছু কর্মকর্তার বিরুদ্ধেও অভিযোগ আছে। ঘুষের বিনিময়ে অবৈধ পন্থায় বাংলাদেশের কর্মীদের কাজের ভিসা দেওয়ার অভিযোগে সৌদি আরবের দুর্নীতি দমন কর্তৃপক্ষ নাজাহা ৫ মার্চ দূতাবাসের দুই সাবেক কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তার করেছে।

এদিকে বাংলাদেশিদের কম্বোডিয়ায় পাঠিয়ে ‘সাইবার ক্রীতদাসে’ পরিণত করার অভিযোগ আছে। এই চক্রের অন্যতম এক হোতাকে গত ২৫ অক্টোবর গ্রেপ্তারের কথা জানিয়েছে র‍্যাব। কম্বোডিয়ায় দূতাবাস না থাকায় প্রতিবেশী থাইল্যান্ডের বাংলাদেশ দূতাবাস বিষয়টি দেখভাল করে। কম্বোডিয়ায় কর্মী পাঠানোর আগে এ দূতাবাস নিয়োগপত্র যাচাই করে সত্যায়ন করে দেয়। তবে সত্যায়ন ছাড়াও দেশটিতে কর্মী পাঠানোর নিবন্ধন দিচ্ছে বিএমইটি। যদিও বিধান অনুসারে এমন সুযোগ নেই।

গত ২৫ জানুয়ারি প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো চিঠিতে থাইল্যান্ড দূতাবাস বলেছে, ২০২২ সালে ২১০ কর্মী পাঠানোর চাহিদাপত্র সত্যায়ন করেছিল তারা। এর ভিত্তিতে মন্ত্রণালয় খোঁজ নিয়ে দেখতে পেয়েছে, ওই বছর ৩ হাজার ১২৭ কর্মীকে নিবন্ধন দিয়েছে বিএমইটি। বিষয়টি নিয়ে তদন্ত করছে মন্ত্রণালয়।

যদিও বিএমইটির মহাপরিচালক শহীদুল আলম দাবি করেন, সত্যায়ন নেই বলে নিবন্ধন আটকে দিলে প্রবাসী আয় বাধাগ্রস্ত হবে। কম্বোডিয়া নিয়ে বিএমইটির কাছে কোনো অভিযোগ আসেনি বলে দাবি করেন তিনি।

জড়িত ব্যক্তিদের শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে

গত ১০ বছরের মধ্যে ২০২২ সালে সবচেয়ে বেশি জনশক্তি রপ্তানি হয় সংযুক্ত আরব আমিরাতে (ইউএই)। ওই সময় দেশটিতে গেছেন ১ লাখ ১ হাজার ৭৭৫ বাংলাদেশি।

আরব আমিরাতে কর্মী পাঠাতে ভুয়া নিবন্ধন দেওয়ার অভিযোগে গত বছর একটি তদন্ত করে প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়। মাত্র আটটি এজেন্সির বিরুদ্ধে এ তদন্ত হয়েছিল। তাতে দেখা যায়, ২ হাজার ৯৬০ জন কর্মীর নিয়োগপত্রের বিপরীতে নিবন্ধন দেওয়া হয়েছে ৬ হাজার ৯৩৮টি। এতে আর্থিক লেনদেনও হয়েছে বলে জানা যায়। বিএমইটির ৯ কর্মকর্তা ও কর্মচারীর বিরুদ্ধে জালিয়াতির প্রমাণ পায় তদন্ত কমিটি। তবে তাঁদের কোনো শাস্তি হয়নি। এ বিষয়ে অধিকতর তদন্ত চলমান আছে বলে জানান প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব আহমেদ মুনিরুস সালেহীন।

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে অভিবাসন খাতের বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্ট রিসার্চ ইউনিটের (রামরু) প্রতিষ্ঠাতা চেয়ার তাসনিম সিদ্দিকী বলেন, বেশি হারে কর্মী পাঠানোকেই সফলতা মনে করা হয়। তাই যাচাই–বাছাই হচ্ছে না। ভুয়া নিয়োগপত্রে মানুষ গিয়ে নানা হয়রানির শিকার হচ্ছেন। ব্যক্তিগত পর্যায়ে আসা নিয়োগপত্রও যাচাইয়ের আওতায় আনতে হবে। জড়িত ব্যক্তিদের শাস্তি নিশ্চিত না করলে এটা ঠিক হবে না। সরকারকে শক্ত হতে হবে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.