বাংলাদেশের নির্বাচন ও রাজনীতি ঘিরে বৃহৎ শক্তিগুলোর পাল্টাপাল্টি

0
183
বিশ্বের বৃহৎ শক্তি

বাংলাদেশে জাতীয় নির্বাচনের সময় এগিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে বিশ্বের বৃহৎ শক্তিগুলো একে অন্যের বিরুদ্ধে নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করছে। সর্বশেষ গতকাল বৃহস্পতিবার রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বাংলাদেশে ‘অবাধ ও সুষ্ঠু’ নির্বাচন নিয়ে ইউরোপ ও মার্কিন রাজনীতিবিদদের চিঠিকে ‘অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে নির্লজ্জ হস্তক্ষেপ’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছে।

গতকাল এক টুইটে রুশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মারিয়া জাখারোভা বলেন, ‘কিছু ইউরোপীয় ও মার্কিন রাজনীতিবিদেরা বাংলাদেশে ‘অবাধ ও নিরপেক্ষ’ নির্বাচনের আহ্বান জানিয়েছে চিঠি প্রকাশ করেছেন বলে আমরা জেনেছি। এটা নব্য-উপনিবেশবাদ এবং সার্বভৌম দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নির্লজ্জ হস্তক্ষেপের আরও একটি অপচেষ্টা।’

রুশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্রের টুইটের আগে একই দিনে ইউরোপীয় ইউনিয়নের পররাষ্ট্রনীতি ও নিরাপত্তা বিষয়ক প্রধান জোসেপ বোরেল ইউরোপীয় পার্লামেন্টের সদস্য ইভান স্টিফেনেককে একটি চিঠি দিয়েছেন। ওই চিঠিতে তিনি বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংকট নিরসনে অর্থবহ সংলাপের তাগিদ দেন।

গত মে মাসে বাংলাদেশ সরকারের ‘মানবাধিকার লঙ্ঘন’ বন্ধ, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের সুযোগ তৈরির লক্ষ্যে জরুরি পদক্ষেপ নিতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের প্রতি আহ্বান জানিয়ে চিঠি লেখেন মার্কিন কংগ্রেসের ৬ সদস্য। আর অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনে ভূমিকা রাখতে ইভান স্টিফেনেকসহ ইউরোপীয় পার্লামেন্টের ৬ সদস্য গত জুনে জোসেপ বোরেলকে চিঠি লেখেন।

বাংলাদেশে জাতীয় নির্বাচন নিয়ে বিশ্বের বৃহৎ শক্তিগুলোর একে অন্যের বিরুদ্ধে নিজেদের অবস্থান জানানোর বিষয়টি এবারই প্রথম নয়। রাশিয়ার সর্বশেষ মন্তব্যের মাসখানেক আগে বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সমালোচনা করে নিজেদের অবস্থান তুলে ধরে চীন। গত মাসে চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ওয়াং ওয়েনবিন নিয়মিত ব্রিফিংয়ে এক প্রশ্নের উত্তরে বলেন, বাংলাদেশের বিশেষায়িত নিরাপত্তা বাহিনী র‍্যাব ও এর কয়েকজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অবস্থানকে সমর্থন করে চীন। একই সঙ্গে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব, স্বাধীনতা ও অখণ্ডতা রক্ষায় চীন সব সময় সমর্থন দেবে।

উল্লেখ্য, ২০২১ সালের ডিসেম্বরে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে র‍্যাব ও সংস্থাটির সাবেক-বর্তমান সাত কর্মকর্তার ওপর যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা দেয়।

ওয়াং ওয়েনবিন বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাম্প্রতিক বক্তব্যের ব্যাপারে আমরা অবগত। আসলে একটি নির্দিষ্ট দেশ (যুক্তরাষ্ট্র) নিজের জাতিগত বৈষম্য, আগ্নেয়াস্ত্রের সহিংসতা ও মাদক বিস্তারের মতো সমস্যাগুলোর দিকে না তাকিয়ে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের অজুহাত দিয়ে দীর্ঘ সময় ধরে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ইস্যুতে নাক গলাচ্ছে এবং আরও অনেক উন্নয়নশীল দেশের অভ্যন্তরীণ ইস্যুতে হস্তক্ষেপ করছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই ইস্যুতে শক্তভাবে বাংলাদেশি জনগণের অবস্থান ব্যক্ত করার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক বিশ্বের একটি বড় অংশের, বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশগুলোর মনের কথা ব্যক্ত করেছেন।’

বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে এর আগেও রাশিয়ার মার্কিনবিরোধী অবস্থান প্রকাশ্যে এসেছে। গত বছর রাজধানীর শাহিনবাগে মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসকে ঘিরে অপ্রীতিকর ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া নিজেদের প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিল।

গত বছরের ১৪ ডিসেম্বর ঢাকায় মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস রাজধানীর শাহিনবাগে এক বিএনপি নেতার বাসায় যান। এই বিএনপি নেতা ৯ বছর আগে নিখোঁজ হয়েছিলেন। ওই দিন হঠাৎ করেই সেখানে হাজির হন প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের আমলে সশস্ত্র বাহিনীতে হত্যা ও নিখোঁজের শিকার ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্যদের সংগঠন ‘মায়ের কান্না’র সদস্যরা। নিরাপত্তার আশঙ্কায় মার্কিন রাষ্ট্রদূত তাঁর পূর্ব নির্ধারিত অনুষ্ঠান সংক্ষিপ্ত করে সেখান থেকে সরাসরি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে যান। তিনি পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেনের সঙ্গে দেখা করে ঘটনার বিবরণ দিয়ে নিরাপত্তার শঙ্কার কথা জানান।

পরদিন ১৫ ডিসেম্বর ওয়াশিংটনে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ ইমরানকে তলব করে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর। যুক্তরাষ্ট্র তখন ঢাকায় পিটার হাসের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগের কথা জানিয়েছিল।

এ নিয়ে বাংলাদেশে নানামুখী প্রতিক্রিয়ার মধ্যে ঢাকার রুশ দূতাবাস তাদের ফেসবুক পেজে এক বিবৃতিতে বলে, ‘রাশিয়া অন্য কোনো দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করার নীতিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। বাংলাদেশের মতো যে দেশগুলো বিদেশি শক্তির নেতৃত্ব অনুসরণ না করে জাতীয় স্বার্থ বিবেচনায় বৈদেশিক ও অভ্যন্তরীণ নীতি গ্রহণ করে, সে দেশগুলোর প্রতি রাশিয়া পুরোপুরি সমর্থন জানায়।’

রুশ দূতাবাসের ওই বিবৃতি প্রকাশের পরদিন পাল্টা অবস্থান প্রকাশ করে ঢাকার মার্কিন দূতাবাস। এক টুইটে মার্কিন দূতাবাস ইউক্রেনে রুশ আক্রমণের প্রসঙ্গ টেনে আনে। মার্কিন দূতাবাসের টুইট বার্তায় বলা হয়, ‘ইউক্রেনের ক্ষেত্রে কি এই নীতি মানা হয়েছে?’

বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের পাশাপাশি রাজনীতি নিয়ে বিভিন্ন সময়ে নিজেদের অবস্থান ব্যক্ত করে আসছে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের দেশগুলো। এর পাশাপাশি রাশিয়া ও চীনও পাশ্চাত্যের বিরোধিতা করে নিজেদের অবস্থান তুলে ধরছে।

বাংলাদেশের রাজনীতি ও নির্বাচন নিয়ে নিকট প্রতিবেশী ভারতের ভূমিকা নিয়েও সব সময় আলোচনা হয়ে থাকে। যদিও সম্প্রতি ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শংকর গণমাধ্যমে বলেছেন, প্রতিবেশী দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলায় না ভারত। তবে ভারতের বিভিন্ন গণমাধ্যমে নিয়মিত বিরতিতে বাংলাদেশের নির্বাচনকেন্দ্রিক রাজনীতি নিয়ে লেখালেখি হচ্ছে। আগামী নির্বাচন নিয়ে ভারতের যুক্ততার কথাও কূটনৈতিক মহলগুলোতে শোনা যায়।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.