পাঠকের কাছ থেকে মনোজগৎ, ব্যক্তিজীবন ও সন্তান পালনের মতো সমস্যা নিয়ে ‘পাঠকের প্রশ্ন’ বিভাগে নানা রকমের প্রশ্ন এসেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এডুকেশন অ্যান্ড কাউন্সেলিং সাইকোলজি বিভাগের অধ্যাপক মেহতাব খানম নির্বাচিত একটি প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন এবার।
প্রশ্ন: আমি ছেলে, বয়স ১৭ বছর। প্রায় ছয় মাস আগে সমবয়সী নিকটাত্মীয় এক মেয়েকে দেখে অভিভূত হয়ে পড়ি। তাকে আমি একতরফা ভালোবেসে ফেলেছি, তবে কাউকে সেটা বুঝতে দিইনি। পারিবারিক সীমাবদ্ধতার কারণে মেয়েটির সঙ্গে সেভাবে যোগাযোগও করতে পারি না। তাকে নিয়ে সারাক্ষণ ভাবতে ভালো লাগে। আজকাল কাছের মানুষদের প্রতি আকর্ষণ হারিয়ে ফেলছি। মাঝেমধ্যে তাকে নিয়ে সব চিন্তাভাবনা ঝেড়ে ফেলতে চাই, কিন্তু পারি না। কারও সঙ্গে খোলামনে মিশতে পারি না। মন খারাপ লাগে। এই সমস্যা থেকে উত্তরণের উপায় কী?
উত্তর: তোমার এখন যা বয়স, তাতে বিপরীত লিঙ্গের কারও প্রতি দ্রুত অনুরক্ত হয়ে পড়াটা খুব স্বাভাবিক। এই বয়সের ছেলেমেয়েদের মনে সাধারণত রোম্যান্টিকতা কাজ করে। খুব তাড়াতাড়ি খুশি হয়ে ওঠা, আবার পর মুহূর্তেই মনের আকাশে মেঘ জমাটা এই বয়সের লক্ষণ। এই সময়ে যুক্তির চেয়ে আবেগই বেশি কার্যকর থাকে। আর তাই এই বয়সের ছেলেমেয়েদের কাউকে ভালো লাগলে তাকে নিয়ে সম্পূর্ণভাবে কল্পনার জগতে মগ্ন হয়ে পড়ে। বিজ্ঞানীরা এর নাম দিয়েছেন ‘দিবাস্বপ্ন’।
আমাদের সামাজিক চর্চায় ছেলে ও মেয়েশিশুরা যেহেতু লিঙ্গ–পার্থক্য ভুলে শুধু দুটো মানুষ হিসেবে একে অপরের প্রকৃত বন্ধু হয়ে উঠতে পারে না, তাই বয়ঃসন্ধিতে পৌঁছানোর আগেই একটি দূরত্ব সৃষ্টি হয়ে যায়। যদি বন্ধু হিসেবে পরস্পরের শুভাকাঙ্ক্ষী হয়ে জীবনের এই পর্যায় তারা অতিক্রম করতে পারত এবং পরিবার ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো একটি সুস্থ-নির্মল বন্ধুত্ব তৈরি করতে সহায়তা করতে পারত, তাহলে অনেক অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা এড়ানো সম্ভব হতো।
এই বয়সে শরীরের সঙ্গে মনেরও একটি বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটে যায় বলে তারা পরস্পরের প্রতি আকর্ষণ বোধ করে। বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা এই বিষয়ে খুব সুস্থ ও বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে শিশুদের যদি অবহিত করতে পারতেন, তাহলে তারা বিপরীত লিঙ্গের কারও প্রতি প্রচণ্ড আকর্ষণ বোধ করলেও সেটিকে স্বাভাবিকভাবেই নিতে পারত। তখন একতরফা অনুভূতি সৃষ্টি হলে সেটিকে কীভাবে মোকাবিলা করবে, তা নিয়ে পরিবারে বা বাইরের কোনো বিশ্বস্ত শুভাকাঙ্ক্ষীর সঙ্গে আলোচনা করে মনের ভার লাঘব করতে পারত।
দুর্ভাগ্য এই যে যেসব শিক্ষকের সাহচর্যে এই বয়সের শিশুরা বিদ্যালয়ে সময় কাটায়, তাদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় না। শিক্ষার্থীরা যেহেতু মা–বাবার কাছে এই অনুভূতিগুলো ব্যক্ত করতে পারে না, তাই শিক্ষকেরা এই ভূমিকা নিতে পারলে খুব ভালো হতো। পড়ালেখার বাইরে অন্য জীবনদক্ষতাও থাকা প্রয়োজন, যা অভিভাবকেরা জানেন না বলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর ওপরেই এই দায়িত্ব বর্তায়।
শিক্ষাঙ্গনে শুধু পরীক্ষার ফলাফলের ওপরেই সবটুকু মনোযোগ থাকে বলে তোমাদের মতো সম্ভাবনাময় কিশোরদের আমরা জীবনের চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলায় দক্ষ করে গড়ে তুলতে ব্যর্থ হচ্ছি। অভিভাবকেরাও শুধু পরীক্ষার ফলাফল নিয়ে ব্যস্ত থাকছেন বলে তাঁরাও দাবি তুলছেন না যে বিদ্যালয় ও মহাবিদ্যালয়ের পাঠক্রমে আরও সুযোগ–সুবিধা, যেমন শরীরচর্চা, খেলাধুলা, সংস্কৃতিচর্চার মতো বিষয়গুলোও যেন সমন্বিত করা হয়।
এই মুহূর্তে তোমার যে প্রচণ্ড কষ্ট হচ্ছে, তা বুঝতে পারছি। হয়তো কাছের মানুষদেরও এখন ভালো লাগছে না। নিয়মিত শরীরচর্চা, ইয়োগা, মেডিটেশন ইত্যাদি অনুশীলনের চেষ্টা করো। এসবে মস্তিষ্কের কার্যকারিতা অনেক বেড়ে যায়, মানসিক অস্থিরতা ও বিষণ্নতা কমে যায়। আর একটি আন্তরিক অনুরোধ, মেয়েটির সম্পর্কে তোমার মধ্যে যে ভাবনাগুলো ভিড় করছে, সেগুলো জোর করে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা কোরো না। গবেষকদের কাজের মধ্য দিয়ে জানা গেছে, মস্তিষ্কের ধর্ম হচ্ছে যা আমরা জোর করে দূর করতে চেষ্টা করি, সেটিই সর্বক্ষণ আরও বেশি মনে পড়তে থাকে। কাজেই বিষয়টি জোর করে ঝেড়ে ফেলার ব্যর্থ চেষ্টা না করে বরং এটিকে একটি বাস্তবতা হিসেবে গ্রহণ করো। একসময় নিজের মধ্যে আরও শক্তি খুঁজে পাবে। প্রাপ্তবয়সে প্রবেশ করার পর তোমার এই চিন্তা ও অনুভূতির তীব্রতা অনেকটাই কমে যাবে। তোমাকে যেহেতু আরও অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে, কাজেই এই মুহূর্তের কষ্টগুলো জয় করার প্রতিজ্ঞা করো নিজের কাছে।