উপকূলের গ্রাম কি আর গ্রাম থাকবে

0
171
পানির অভাবে কখনো খরা আবার অতিরিক্ত পানির কারণে বন্যা হচ্ছে

বিদেশি সংবাদমাধ্যমে বাংলাদেশ খুব বেশি একটা শিরোনাম হয় না। কিন্তু গত ২৯ জুন নিউইয়র্ক টাইমস–এর আন্তর্জাতিক সংস্করণের প্রথম পাতায় ছয় কলামের মধ্যে চার কলামজুড়ে শিরোনাম ‘পানির বিড়ম্বনা: একটি প্রাক্‌-পর্যালোচনা’ (ওয়াটার ট্রাবলস: আ প্রিভিউ)।

চার দিন আগে যুক্তরাষ্ট্র সংস্করণে একই প্রতিবেদন প্রথম পাতায় এক কলামে ছাপা হয়েছিল, যার শিরোনাম ছিল পানির সংকট, যা শিগগিরই আপনার কাছে পৌঁছাতে পারে (হিয়ার’স আ লুক অ্যাট দ্য ওয়াটার ক্রাইসিস দ্যাট মাইট বি কামিং টু ইউ সুন)।

সোমিনি সেনগুপ্তর প্রতিবেদনটির মূল বিষয় বাংলাদেশের প্রায় সব নদী হিমালয় থেকে নেমে এসে বঙ্গোপসাগরে মিশে যাওয়ার আগে শাখা-উপশাখা বিস্তৃত হয়ে সৃষ্টি করেছে জলাভূমি। কিন্তু বর্তমানে বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে পানি।

পানির অভাবে কখনো খরা, আবার অতিরিক্ত পানির কারণে বন্যা, ঘূর্ণিঝড় এবং উপকূলে লোনাপানি হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এসব হুমকির কারণ জলবায়ু পরিবর্তন। আর এসব সংকট মোকাবিলা করতে ১৭ কোটি মানুষ প্রাণান্ত চেষ্টা করে যাচ্ছে। আজ বাংলাদেশ যে সংকটে ভুগছে, আগামীকাল অন্য অনেক দেশ সে সংকটে পড়বে।

দুর্যোগ হানা দেওয়ার পূর্বাভাস ও দুর্যোগের মুখে টিকে থাকতে উপকূলের লোকজন কী কী কৌশল রপ্ত করেছে, তাদের জীবনের রূপান্তর এ প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে। জোয়ার–ভাটায় পানি বাড়া-কমা কিংবা জলাবদ্ধতায় জীবিকা টিকিয়ে রাখতে ভাসমান চাষাবাদের প্রচলন, জলবায়ুর প্রভাব এবং চিংড়ি চাষের কারণে বাড়তে থাকা লবণাক্ততার সমস্যায় খাওয়ার পানির ব্যবস্থা করতে বৃষ্টির পানি ধারণ, পরিশোধন ও মজুতের মতো কৌশলের খুঁটিনাটি প্রতিবেদক চমৎকারভাবে বর্ণনা করেছেন।

নিউইয়র্ক টাইমস–এর প্রতিবেদনটি পড়ার সময় আমার দুজনের কথা মনে হলো। একজন হলেন ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনের স্কুল অব ওরিয়েন্টাল স্টাডিজের (সোয়াস) উন্নয়ন অধ্যয়ন বিষয়ে প্রফেসরিয়াল রিসার্চ ফেলো স্বপন আদনান এবং অন্যজন লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকসের পরিবেশ বিষয়ের সহযোগী প্রফেসর কাসিয়া পাপরকি। কিছুদিন আগেই পড়েছি স্বপন আদনানের বই গ্রামবাংলার রূপান্তর, যাতে পানির আধিক্য, বন্যা নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন সময় নেওয়া পরিকল্পনার ত্রুটি এবং তার খেসারত গ্রামের মানুষকে কীভাবে দিতে হয়েছে ও হচ্ছে, তার বিশদ বর্ণনা পাওয়া যায়।

তাঁর বইয়ে যদিও ভূমির মালিকানাকেন্দ্রিক সমাজ গঠন, ক্ষমতাকাঠামো, দুর্নীতির সংস্কৃতি ও পৃষ্ঠপোষকতার রাজনীতি এবং কৃষকদের টিকে থাকার সংগ্রাম প্রাধান্য পেয়েছে কিন্তু তার মধ্যেও অনেকটা জুড়ে আছে পানির কারণে সৃষ্ট সমস্যা ও সংকটের কথা। বৃহত্তর খুলনার উপকূলীয় অঞ্চলে চিংড়ি চাষ ও তার কারণে লবণাক্ততা কী ধরনের প্রভাব ফেলেছে, সে সম্পর্কেও তিনি তাঁর পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেছেন।

স্বপন আদনান লিখেছেন, জনদাবির মুখে সরকারি বিশেষজ্ঞ ও কর্মকর্তাদের হুঁশিয়ারি ছিল যে বাঁধ কাটা হবে আত্মহননের শামিল। কিন্তু গ্রামবাসী বলেছিলেন, বাঁধ কাটা হলে পানির স্বাভাবিক প্রবাহে পলি জমে জলাবদ্ধতা দূর হবে, লবণাক্ততাও কমবে। দুই দশক পর সেখানে প্রাকৃতিকভাবে ভূমি গঠনের মাধ্যমে জলাবদ্ধতা কেটেছে, জমি পুনরুদ্ধার হয়েছে।

কাসিয়া পাপরকি বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ও তা মোকাবিলার কৌশল নিয়ে ১৫ বছরের বেশি সময় ধরে কাজ করছেন এবং এ বিষয়ে তাঁর বই ও একাধিক গবেষণা নিবন্ধ বিভিন্ন সাময়িকীতে প্রকাশিত হয়েছে। বেশ কয়েক মাস আগে সোয়সে তাঁর এক নতুন গবেষণায় পাওয়া তথ্য-উপাত্ত নিয়ে অনুষ্ঠিত সেমিনারে গিয়েছিলাম এবং সেখানেই তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয়।

বলতে দ্বিধা নেই, আমার বেড়ে ওঠা যে জেলায়, সেই খুলনার উপকূলীয় অঞ্চলের কৃষক ও মৎস্যজীবীদের জীবনযাত্রার সংগ্রাম ও রূপান্তর সম্পর্কে তাঁদের দুজনের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা থেকে অনেক কিছুই আমি নতুন করে জেনেছি। উপকূলীয় এলাকায় জোয়ার-ভাটার টানে জীবন-জীবিকায় যে মারাত্মক প্রভাব পড়েছে এবং এখনো পড়ে চলেছে, তার সামাজিক-অর্থনৈতিক বিশ্লেষণ যে–কাউকে বিচলিত করবে।

আর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মানিয়ে চলতে যেসব পরিকল্পনা নিয়ে উন্নয়ন সহযোগী দেশ ও প্রতিষ্ঠানগুলো এবং বেসরকারি বাণিজ্যিক উদ্যোক্তারা সক্রিয় হয়েছেন, তা যে কতটা বিভ্রান্তিকর ও ত্রুটিপূর্ণ, কাসিয়া সেগুলোর নির্মোহ বিশ্লেষণ তুলে ধরেছেন। গ্রামীণ বাংলাদেশকে তাঁদের অনেকেই উন্নয়নের একটি পরীক্ষাগার হিসেবে গণ্য করছেন উল্লেখ করে তিনি জানান, কেউ কেউ এমন ভাবনাও পোষণ করেন যে খুলনার গ্রামীণ জীবনকে বাঁচানোর চেষ্টা অর্থহীন।

শিল্পায়ন, বিশেষ অর্থনৈতিক এলাকা প্রতিষ্ঠা, জোয়ারের প্রবাহ ও সমুদ্রের উচ্চতা বৃদ্ধিতেও টিকে থাকতে পারে—এমন ঊর্ধ্বমুখী গৃহায়ণ পরিকল্পনাও আলোচনায় আছে। কাসিয়ার গবেষণায় জলবায়ু পরিবর্তন ও রপ্তানিমুখী চিংড়ি চাষ যে বিপুলসংখ্যক কৃষিশ্রমিককে কর্মহীন করে ভিটেছাড়া করেছে, অভিবাসনে বাধ্য করেছে, তঁাদের কথা বেশ গুরুত্বের সঙ্গে তুলে ধরা হয়েছে। নিউইয়র্ক টাইমস–এর প্রতিবেদনে বিষয়টি প্রাধান্য না পেলেও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অনেকেই যে উপকূলের বিপন্ন এলাকা থেকে কিছুটা সরে এসে মোংলা এলাকায় বসতি গড়ার চেষ্টা করছেন, তার উল্লেখ আছে।

জলবায়ু পরিবর্তন: নতুন করে ভাবতে হবে প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে

স্বপন আদনান তাঁর গ্রামবাংলার রূপান্তর বইয়ে গ্রামাঞ্চলের সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিবর্তনের যেসব চিত্র তুলে ধরেছেন, তাতে বৃহত্তর খুলনার উপকূলীয় অঞ্চলে আশির দশকে শুরু হওয়া লোনাপানির চিংড়ি চাষের কথা যেমন আছে, তেমনি আছে বন্যা নিয়ন্ত্রণের নামে ষাটের দশকে ভুল পরিকল্পনায় গড়ে তোলা পোল্ডার বা জলাধার তৈরির কথা।

বন্যা নিয়ন্ত্রণ প্রকল্পের পরিণতিতে বিল ডাকাতিয়ায় হাজার হাজার মানুষের জীবন-জীবিকার ক্ষতি ও তাদের প্রতিরোধ সংগ্রামের বিশদ বিশ্লেষণ উন্নয়ন অধ্যয়নে এক মূল্যবান সংযোজন। একইভাবে বিশ্বব্যাংক ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের মতো আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলো রপ্তানিমুখী চিংড়ি চাষকে উৎসাহিত করতে বিভিন্ন নীতিসহায়তা দিলেও তা যে প্রাকৃতিক পরিবেশ ও মানুষের জীবিকা ও স্বাস্থ্যের ওপর কী ধরনের ক্ষতিকর প্রভাব ফেলেছে, তারও একটা সামগ্রিক চিত্র তাঁর রচনায় উঠে এসেছে।

যাদের জন্য উন্নয়ন, সেই কথিত উপকারভোগীদের যে উন্নয়ন পরিকল্পনায় কোনো ভূমিকা নেই, বরং তাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া অপপরিকল্পনার ক্ষতি কতটা গুরুতর হতে পারে, তার নজির হিসেবে বিল ডাকাতিয়ার কাহিনি তিনি বিশদভাবে তুলে ধরেছেন তাঁর বইয়ে। ষাটের দশকের মাস্টারপ্ল্যানের অংশ হিসেবে কোস্টাল এমব্যাংকমেন্ট প্রজেক্টের আওতায় বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও পানিনিষ্কাশনের জন্য বিল ডাকাতিয়ায় যে পোল্ডার নির্মাণ করা হয়েছিল, তার পরিণতিতে আশির দশকে সেখানে অপ্রত্যাশিত জলরাশি তৈরি হয়, যার ব্যাপ্তি ও গভীরতা ক্রমেই বাড়তে থাকে। ৩০ থেকে ৪০ হাজার একর জমি পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় সেখানকার জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। ১৯৯০ সালে সেখানে গণপ্রতিরোধ গড়ে ওঠে এবং আন্দোলনকারীরা বাঁধ কাটার কর্মসূচি ঘোষণা করেন। ভুক্তভোগী মানুষের প্রতিবাদ দমনে প্রশাসন শুরুতে নানা রকম কঠোর পদক্ষেপ নিলেও আন্দোলন ঠেকানো সম্ভব হয়নি।

জলবায়ু পরিবর্তন যেভাবে খাদ্য ও পুষ্টিগুণকে পাল্টে দিচ্ছে

স্বপন আদনান লিখেছেন, জনদাবির মুখে সরকারি বিশেষজ্ঞ ও কর্মকর্তাদের হুঁশিয়ারি ছিল যে বাঁধ কাটা হবে আত্মহননের শামিল। কিন্তু গ্রামবাসী বলেছিলেন, বাঁধ কাটা হলে পানির স্বাভাবিক প্রবাহে পলি জমে জলাবদ্ধতা দূর হবে, লবণাক্ততাও কমবে। দুই দশক পর সেখানে প্রাকৃতিকভাবে ভূমি গঠনের মাধ্যমে জলাবদ্ধতা কেটেছে, জমি পুনরুদ্ধার হয়েছে।

তাঁর বইটি জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলার কৌশল ও পরিকল্পনার প্রশ্নেও আলাদা গুরুত্ব বহন করে। কেননা, তিনি তাঁর ভাষায় ‘সরকারি বিজ্ঞান’ ও ‘জনগণের বিজ্ঞান’–এর দ্বন্দ্ব ও তা নিরসনের ভালো-মন্দ সহজবোধ্যভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। দেশে উন্নয়নের অনেক পরিকল্পনাই হচ্ছে, যাতে কথিত উপকারভোগীদের মতামতের কোনো মূল্য আছে বলে মনে হয় না।

পরিবেশবাদীদের বিরোধিতা নাকচ করে রামপালে বিদ্যুৎ প্রকল্প, মোংলা রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। পরিকল্পনা হচ্ছে খুলনা ও বরিশাল বিভাগে ডজনখানেক বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের। তখন নিশ্চয়ই গ্রামবাংলার রূপান্তরের নতুন অধ্যায় লিখতে হবে।

  • কামাল আহমেদ সাংবাদিক

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.