আকলিমাদের সুপেয় পানির কষ্টের দিন ফুরাল

0
112

বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে বঙ্গোপসাগরের কোল ঘেঁষে খুলনার দাকোপ উপজেলা। সেখানকার চুনকুড়ি গ্রামের বাসিন্দা আকলিমা খানম। তার দুই সন্তানসহ পরিবারের সবাই বছরের বেশিরভাগ সময় পেটের পীড়ায় ভোগেন। শুধু আকলিমা নয়, এ গ্রামের সব পরিবারেই যেন ডায়রিয়া বা আমাশয়ের মতো রোগ নিত্যসঙ্গী। আর দৈনন্দিন সকল কাজে লবণাক্ত পানির ব্যবহারকে এসব রোগের পেছনে প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।

উপকূলীয় এই অঞ্চলে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর নোনা পানির ব্যবহারের কারণে সবচেয়ে বেশি ভুক্তভোগী হচ্ছে নারী ও শিশুরা। এখানে রোগবালাইয়ের তালিকায় আরও যুক্ত হয়েছে- চর্মরোগ, কিডনি ও জরায়ুজনিত নানান রোগ। উপকূলীয় এসব এলাকায় নারীদের গর্ভধারণের পরিমাণ কমে গেছে, গর্ভপাতের সংখ্যাও আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে গেছে। একমাত্র নিরাপদ ও সুপেয় পানির অভাবেই মারাত্মক এসব রোগে দিনের পর দিন ভুগছেন উপকূলীয় এলাকার মানুষরা।

জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে প্রত্যক্ষ ক্ষতির মুখে এসব অঞ্চল। স্থানীয় বাসিন্দাদের মতে, এসব এলাকার নদী, পুকুর ও জলাশয়ের লবণাক্ততা আগের চেয়ে অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। আর এ কারণে একদিকে যেমন রোগবালাই বাড়ছে, অন্যদিকে তেমনি খাবারের জন্য নিরাপদ পানিও পাওয়া যায় না। বাধ্য হয়ে সেই অতিরিক্ত নোনা পানিই দৈনন্দিন সকল কাজে ব্যবহার করা লাগছে। ‘পানির অপর নাম জীবন’, অথচ আকলিমাদের মতো উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষেরা নিজের জীবন দিয়ে বুঝতে শিখেছেন এই প্রবাদবাক্যের যথার্থতা।

লবণাক্ত পানি ব্যবহারের কারণে একইভাবে দুর্বিষহ হয়ে উঠেছিল ওই এলাকায় বসবাসকারী এক মাঝির জীবন। তার পরিবারের সকল সদস্যও পানিবাহিত রোগের কারণে অসুস্থ। পেশায় মাঝি, তাই নৌকা নিয়ে দূরদূরান্তে যেতেন, কোথাও একটু মিষ্টি পানি পাওয়া যায় কি না, তা আনতে। এমনও হয়েছে তিনি খোঁজ পেয়েছেন, অনেক দূরের কোনো এলাকার পুকুরে কিছুটা কম নোনা পানি আছে। সেই পানি আনতে গিয়ে, আসা-যাওয়ায় এতো সময় চলে গেছে যে ওইদিন আর কোনো কাজই করতে পারেননি। পরিবারের সবার জন্য পানি পেয়েছেন, তাকে এটুকুতেই সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছে।

উপকূলীয় অঞ্চলের প্রতিটি পরিবারেই আছে এরকম নিরাপদ ও সুপেয় পানির জন্য কষ্ট ও সংগ্রামের গল্প। তবে, দাকোপ উপজেলার চুনকুড়ি গ্রামের চিত্র বর্তমানে অনেকটা বদলেছে। এখানে নিজেদের জি-গ্যাস এলপিজি প্ল্যান্টের পাশে নিরাপদ ও সুপেয় পানির প্ল্যান্ট স্থাপন করেছে এনার্জিপ্যাক। ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে সিএসআর (করপোরেট সোশ্যাল রেসপনসিবিলিটি) কার্যক্রমের অংশ হিসেবে তৈরি করা এই প্ল্যান্ট থেকে প্রতিদিন ১০ হাজার লিটার নিরাপদ সুপেয় পানি বিতরণ করা হচ্ছে। এই অঞ্চলের প্রায় ৩০০ পরিবার অর্থাৎ কমপক্ষে ১২০০ মানুষ প্রতিদিন সরাসরি এই প্ল্যান্টের সুবিধা ভোগ করছেন। এই প্ল্যান্ট থেকে এখন পর্যন্ত প্রায় ২০ মিলিয়ন লিটারেরও বেশি নিরাপদ পানি বিতরণ করা হয়েছে।

প্রতিদিন ১০ হাজার লিটার পানি বিতরণের সক্ষমতা রয়েছে এমন একটি প্ল্যান্টের প্রভাব কতোটা সুদূরপ্রসারী হতে পারে তা এই অঞ্চলের মানুষ উপলব্ধি করতে পারছে। এই পরিবারগুলোতে নোনা পানিজনিত রোগ হওয়ার হার কমে এসেছে। প্ল্যান্টের নিরাপদ পানি আশপাশের স্কুলগুলোতে সরবরাহ করা হচ্ছে। আমাদের শিশুরাই আমাদের ভবিষ্যৎ, তাই তাদের সুস্থতা নিশ্চিত করা আমাদের আগামীর জন্য জরুরি। এমনকি দূরদূরান্ত থেকে গ্রামবাসী এসে কয়েকদিন পরপর নিজেদের খাওয়ার জন্য সুপেয় পানি নিয়ে যাচ্ছে। পানি ছাড়াও স্বাস্থ্য সচেতনতায় এনার্জিপ্যাক এই অঞ্চলে বিভিন্ন ধরনের গনসচেতনতামূলক ক্যাম্পেইন পরিচালনা করে । আকলিমার ভাষায় বলতে গেলে, “দুই সন্তানকে বড় করার সময় আমার খুবই কষ্ট হয়েছে। নোনা পানির কারণে সারাবছরই নানান রোগে ভুগতো ওরা। এখন সুপেয় পানি পেয়ে দুশ্চিন্তা কমেছে। আমার সন্তানেরা সুস্থ থাকবে, এটা ভেবেই ভালো লাগছে।”

জাতিসংঘ ঘোষিত টেকসই ভবিষ্যৎ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (এসডিজি) ৬ নাম্বারটি হচ্ছে- ‘সকলের জন্য নিরাপদ পানি ও পয়ঃনিষ্কাশনের টেকসই ব্যবস্থাপনা ও প্রাপ্যতা নিশ্চিত করা।’ ব্যক্তি, সরকার বা কোনো ব্যবসা প্রতিষ্ঠান কারও একার পক্ষে এই লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করা সম্ভব নয়। তবে সবাই একসাথে নিজের জায়গা থেকে সঠিক কাজটি করলে যথাযথ সময়ের মধ্যেই এই লক্ষ্যপূরণ সম্ভব। আমাদের দেশের উপকূল জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে এমন অঞ্চল। আর তাই সেখানকার মানুষের জন্য নিরাপদ ও সুপেয় পানির ব্যবস্থা করা নিঃসন্দেহে সাধুবাদ পাওয়ার দাবিদার।

আগামী প্রজন্মের জন্য নিরাপদ ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে চাইলে আমাদের এখন থেকেই ছোট ছোট পদক্ষেপ নিতে হবে। সেই ছোট ছোট পদক্ষেপ আর সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টার মধ্য দিয়েই বাস্তবায়িত হবে সুখী ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশের স্বপ্ন।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.