৫২ কিশোর গ্যাং: রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ায় ‘বড় ভাইয়েরা’

0
135

এসব চক্রের নেতাদের বেশির ভাগই ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে যুক্ত অথবা স্থানীয় নেতাদের ছত্রচ্ছায়ায় থাকেন।

রাজধানীর দারুসসালাম থানার লালকুঠি এলাকার বসুপাড়ায় গত ২২ মে স্কুলছাত্র সিয়াম খানকে (১৪) প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। তার আগে ১০ মে দনিয়া কলেজের সামনে ‘জুনিয়র–সিনিয়র’ দ্বন্দ্বে খুন হয় মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী তাজুন ইসলাম ওরফে মুশফিক। দুটি হত্যাকাণ্ডের পেছনেই রয়েছে এলাকাভিত্তিক অপরাধী চক্রের তৎপরতা। এসব চক্র স্থানীয়ভাবে ‘কিশোর গ্যাং’ নামে পরিচিত।

রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় বখাটে কিশোর–তরুণদের নিয়ে এমন অপরাধী চক্র গড়ে উঠেছে। যারা মাদক কারবার নিয়ন্ত্রণ, চাঁদাবাজি, ছিনতাই, নারীর শ্লীলতাহানিসহ নানান অপকর্মে যুক্ত। এসব চক্রের সদস্যদের বড় অংশ কিশোর হলেও নেতাদের বয়স ১৯ থেকে ৩৮ বছর। তাঁদের ‘সিনিয়র’ বা ‘বড় ভাই’ বলে ডাকে চক্রের সদস্যরা। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, এসব চক্রের নেতাদের বেশির ভাগই ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত অথবা স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের ছত্রচ্ছায়ায় থাকে বলে স্থানীয় সূত্রগুলো থেকে জানা গেছে।

ডিএমপির আটটি অপরাধ বিভাগের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ‘কিশোর গ্যাং’ মিরপুরে বিভাগে। এই বিভাগে ১৩টি কিশোর অপরাধী চক্রের ১৭২ সদস্য সক্রিয় বলে পুলিশের তালিকায় উল্লেখ রয়েছে।

রাজধানীতে সক্রিয় ‘কিশোর গ্যাংয়ের’ তালিকা করছে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)। এখন পর্যন্ত এই তালিকায় ৫২টি চক্রের নাম এসেছে। ডিএমপির আটটি অপরাধ বিভাগের অধীন ৩৩ থানা এলাকায় এসব চক্রের সদস্যসংখ্যা প্রায় ৬৮২।

পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, এসব অপরাধী চক্রের নেতা বা সদস্যদের বড় অংশ পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন। অনেকেই থাকে বস্তিতে। তবে সঙ্গদোষে অনেক স্কুল–কলেজের ছাত্রও এসব চক্রে জড়িয়ে পড়ে।

‘তুই কি সিয়ামের বন্ধু’ বলেই স্কুলছাত্রকে জখম করল কিশোর গ্যাং

ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশনস) খঃ মহিদ উদ্দিন বলেন, এ পর্যন্ত ৪৬ মামলায় ২৩৬ জন কিশোর অপরাধী চক্রের সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাঁর মতে, এ ধরনের অপরাধপ্রবণতা কমাতে পরিবার থেকে শুরু করে সমাজ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা—সবাইকে উদ্যোগী হতে হবে। কিশোর-তরুণেরা যাতে পড়াশোনার পাশাপাশি খেলাধুলা ও বুদ্ধিভিত্তিক চর্চার সঙ্গে যুক্ত হতে পারে, সেই ব্যবস্থা করতে হবে।

এর বাইরে ‘রাজু গ্রুপ’, ‘রকি গ্রুপ’, ‘রোমান্টিক গ্রুপ’, ‘মুসা-হারুন গ্রুপ’ ও ‘সোহেল গ্রুপ’ নামে পাঁচটি চক্র এই থানার বিভিন্ন এলাকায় সক্রিয় রয়েছে।

মিরপুর এলাকায় বেশি চক্র

ডিএমপির আটটি অপরাধ বিভাগের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ‘কিশোর গ্যাং’ মিরপুরে বিভাগে। এই বিভাগে ১৩টি কিশোর অপরাধী চক্রের ১৭২ সদস্য সক্রিয় বলে পুলিশের তালিকায় উল্লেখ রয়েছে।

এর মধ্যে মিরপুরের দারুস সালাম থানার লালকুঠি এলাকায় রয়েছে দুটি চক্র। একটি ‘অতুল গ্রুপ’, অপরটি ‘পটেটো রুবেল গ্রুপ’ নামে পরিচিত। এর মধ্যে অতুল গ্রুপের সদস্য ২০ থেকে ২৫ জন। চক্রটির প্রধান শফিকুর রহমান ওরফে অতুল।

স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, অতুল গ্রুপের সদস্যরা প্রায়ই সন্ধ্যা থেকে গভীর রাত পর্যন্ত মোটরসাইকেলে মহড়া দেয়। তুচ্ছ কারণে মারধর করে। এই চক্র লালকুঠি, বসুপাড়া, ইব্রাহিম নামা ও মতিন নামা এলাকায় মাদক ব্যবসা, ছিনতাই ও চাঁদাবাজিতেও জড়িত। এই চক্রের নেতা শফিকুর স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতা নাবিল খানের ছত্রচ্ছায়ায় অপকর্ম করে যাচ্ছে বলে স্থানীয় লোকজন অভিযোগ করেন। অভিযোগের ব্যাপারে বক্তব্য জানতে নাবিল খানের মুঠোফোনে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি ধরেননি। খুদেবার্তা পাঠালেও সাড়া দেননি।

মূল দল আওয়ামী লীগ থেকে শুরু করে সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের নেতা–কর্মীরা যদি অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে যান, তাহলে আমি বলব সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল যাঁরা আছেন, তাঁদের সেভাবে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।
ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ বজলুর রহমান

পুলিশ জানায়, শফিকুর রহমান ওরফে অতুলের বিরুদ্ধে দারুস সালাম ও শাহ আলী থানায় হত্যা, ছিনতাইসহ আটটি মামলা রয়েছে। এ ছাড়া বিভিন্ন থানায় চারটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) রয়েছে।

২০২০ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর লালকুঠিতে কলেজছাত্র মো. মাহিন ওরফে শুভকে হত্যা মামলার আসামি শফিকুর ও তাঁর সহযোগীরা। বোনকে উত্ত্যক্তের প্রতিবাদ করায় কিশোর মাহিনকে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে ও ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হয়।

আশরাফুল আহসান জিতু করতেন ‘ইভ টিজিং’, ছিলেন ‘কিশোর গ্যাং এর নেতা’

মাহিনের বাবা মো. বাবুল বলেন, মাহিন হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার শফিকুর এখন জামিনে মুক্ত। শফিকুর ও তার সহযোগীরা গত ২৫ মে মধ্যরাতে ছুরি ও চাপাতি নিয়ে বাবুলের বাসার সামনে এসে ‘দেখে নেওয়ার’ হুমকি দিয়ে গেছে।

মো. বাবুলের অভিযোগ, শফিকুর ও তার সহযোগীরা মাহিন হত্যা মামলার সাক্ষী আকবর আলী ও আল আমিনকে হত্যা করতে চায়। তাদের ওপর গত ২২ মে হামলা করে। আকবর ও আল আমিন পালিয়ে যেতে সক্ষম হলেও তাঁদের সঙ্গে থাকা ইমরানকে কুপিয়ে আহত করে।

আল আমিন ওই এলাকায় সক্রিয় আরেক অপরাধী চক্র পটেটো রুবেল গ্রুপের সদস্য। ওই দিন তারা পরে পাল্টা হামলা করলে দুই গ্রুপের সংঘর্ষে নিহত হয় সিয়াম খান নামের এক কিশোর। স্থানীয় লোকজনের ধারণা, সিয়ামকে প্রতিপক্ষ গ্রুপের সদস্য মনে করে পটেটো রুবেল গ্রুপ হত্যা করেছে।

শুধু পুলিশি তৎপরতায় এ ধরনের অপরাধ প্রতিরোধ করা যাবে না। তাই এটা বন্ধে সামাজিক উদ্যোগ দরকার। রাজনৈতিক নেতৃত্বকে এগিয়ে আসতে হবে

মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগের প্রধান অধ্যাপক মুহাম্মদ উমর ফারুক

পটেটো রুবেল গ্রুপের নেতা মো. শান্তানুর হোসেন ওরফে পটেটো রুবেল (২৮)। তাঁর বিরুদ্ধে দারুস সালাম থানায় হত্যা, মাদক, ছিনতাই, চাঁদাবাজিসহ ৩০টি মামলা রয়েছে। তিনি ঢাকা মহানগর ১০ নম্বর ওয়ার্ড যুবদলের সদস্যসচিব। কিশোর সিয়াম হত্যা মামলায় পটেটো রুবেলকে গত ২৫ মে র‍্যাব গ্রেপ্তার করেছে।

পুলিশের তালিকা অনুসারে, মিরপুর এলাকার মধ্যে সবচেয়ে বেশি কিশোর অপরাধী চক্র রয়েছে পল্লবী থানা এলাকায়। এখানে সাতটি চক্র রয়েছে। এর মধ্যে এক নম্বরে আছে ‘আশিক গ্রুপের’ নাম। এই চক্রে ২৫ জনের মতো সদস্য রয়েছে।

কিশোর গ্যাং দমনে যা করা যেতে পারে

এই চক্রের নেতা আশিক পল্লবী থানা ছাত্রলীগের এক নেতার পৃষ্ঠপোষকতায় বেপরোয়া বলে অভিযোগ আছে। একইভাবে মিরপুর ১১ নম্বর সেকশনের পিন্টু-কালু গ্রুপ ঢাকা মহানগর উত্তরের ৫ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের এক নেতা ও যুবলীগের এক সদস্যের পৃষ্ঠপোষকতা পান বলে স্থানীয় সূত্রগুলো থেকে জানা গেছে ।

এর বাইরে ‘রাজু গ্রুপ’, ‘রকি গ্রুপ’, ‘রোমান্টিক গ্রুপ’, ‘মুসা-হারুন গ্রুপ’ ও ‘সোহেল গ্রুপ’ নামে পাঁচটি চক্র এই থানার বিভিন্ন এলাকায় সক্রিয় রয়েছে।

এ ছাড়া মিরপুর মডেল থানা এলাকার ‘পিয়াস গ্রুপ’ একটি চক্র রয়েছে। পুলিশের তালিকায় কল্যাণপুর এলাকায় সক্রিয় এই চক্রের নেতার নাম লেখা হয়েছে শাহ মো. কিবরিয়া ওরফে পিয়াস। তিনি ঢাকা মহানগর ১১ নম্বর ওয়ার্ড যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক। তাঁর বিরুদ্ধে মডেল থানায় একাধিক মামলা রয়েছে বলে পুলিশ সূত্র জানিয়েছে। তবে শাহ মো. কিবরিয়া মুঠোফোনে বলেন, পুলিশের তালিকা অনুযায়ী তিনি যে একটি কিশোর গ্যাংয়ের প্রধান, সেটা তিনি জানেন না।

কিশোর অপরাধী চক্রে ক্ষমতাসীন দলের কারও কারও জড়িত থাকার অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ বজলুর রহমান বলেন, ‘মূল দল আওয়ামী লীগ থেকে শুরু করে সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের নেতা–কর্মীরা যদি অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে যান, তাহলে আমি বলব সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল যাঁরা আছেন, তাঁদের সেভাবে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। তাঁদের দল থেকে বহিষ্কার করা উচিত। মূল দলেও যদি এমন কেউ থাকেন, তাহলে তাঁদের বিরুদ্ধে ব৵বস্থা নেওয়া হবে।’

উত্তরায় আদনান হত্যা ও নির্মমতা

রাজধানীর উত্তরায় ২০১৭ সালে অষ্টম শ্রেণির ছাত্র আদনান কবির হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে কিশোর গ্যাংয়ের নির্মমতার বিষয়টি ব্যাপকভাবে আলোচনায় আসে। ওই বছরের ৬ জানুয়ারি সন্ধ্যায় উত্তরার ১৩ নম্বর সেক্টরের ১৭ নম্বর সড়কের খেলার মাঠে তাকে পিটিয়ে ও কুপিয়ে হত্যা করা হয়। এরপর র‌্যাব অভিযান চালিয়ে দুটি চক্রের প্রধানসহ আটজনকে গ্রেপ্তার করে।

ডিএমপির তালিকা অনুযায়ী, উত্তরায় এমন ছয়টি চক্র রয়েছে, যাতে ৬৪ জনের মতো সদস্য। ‘ইয়াং স্টার’, ‘ডিসকো বয়েজ’, ‘বিগবস’ ইত্যাদি নামে সক্রিয় এসব চক্রের সদস্যরা পার্টি করা, হর্ন বাজিয়ে প্রচণ্ড গতিতে মোটরসাইকেল চালানো এবং রাস্তায় মেয়েদের উত্ত্যক্ত করে থাকে। এসব করতে গিয়ে নিজেদের মধ্যে সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে। এ ছাড়া ছিনতাইসহ নানান অপরাধেও অনেকে জড়িয়ে পড়ে।

ডিএমপির উত্তরা অপরাধ বিভাগের তথ্য অনুসারে, তুরাগ থানা এলাকায় ‘পারভেজ গ্রুপ’, উত্তরখানে ‘রুস্তম গ্রুপ’ ও ‘নাইন এমএম বিগ বস’, দক্ষিণখানে ‘বিগবস’ ও ‘ইয়াং স্টার গ্রুপ’, উত্তরা পশ্চিম থানা এলাকায় ‘নাইন স্টার গ্রুপ’ নামে অপরাধী চক্র রয়েছে।

বেগ পেতে হয় পুলিশকে

পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, কোনো এলাকায় কিশোর গ্যাংয়ের তৎপরতা বাড়লে ডিএমপি সদর দপ্তর থেকে মাঠপর্যায়ে নির্দেশনা দেওয়া হয়। তারপরও কিছু ঘটনা ঘটছে। এ ছাড়া রাজনৈতিক কারণেও অনেক এলাকায় কিশোর অপরাধীদের তৎপরতা থাকে। সেটা নিয়ন্ত্রণে পুলিশকে বেগ পেতে হয়।

এ বিষয়ে মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগের প্রধান অধ্যাপক মুহাম্মদ উমর ফারুক বলেন, ‘শুধু পুলিশি তৎপরতায় এ ধরনের অপরাধ প্রতিরোধ করা যাবে না। তাই এটা বন্ধে সামাজিক উদ্যোগ দরকার। রাজনৈতিক নেতৃত্বকে এগিয়ে আসতে হবে।’ তাঁর মতে, সমাজ ও রাষ্ট্রের মধ্যে যদি সুস্থ বিনোদন না থাকে, তাহলে কিশোর-কিশোরীদের বিপথগামী হওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.