৩৩ বছর আগে ব্যাংকের অর্থ ডাকাতির যে ঘটনা দেশজুড়ে আলোড়ন তুলেছিল

0
119
উত্তরায় প্রকাশ্যে ডাকাতি

ঘটনাটি চাঞ্চল্যকর। তবে এভাবে ব্যাংকের অর্থ ডাকাতির ঘটনা নতুন নয়। দেশে প্রায় একই রকম চাঞ্চল্যকর ঘটনা প্রথম ঘটেছিল ১৯৯০ সালের ৫ মার্চ, রাজধানীর ব্যস্ততম এলাকা মতিঝিলে। সেই ঘটনা দেশজুড়ে তীব্র আলোড়ন তুলেছিল। ওই দিন এভাবে টাকা বহন করার সময় তৎকালীন গ্রিন্ডলেজ ব্যাংকের (এখন স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত) ৫০ লাখ টাকা ছিনতাই বা ডাকাতি হয়েছিল।

ঘটনার পরের দিন দৈনিক ইত্তেফাকে তা তিন কলাম জুড়ে ছাপা হয়। শিরোনাম ছিল, ‘কমান্ডো স্টাইলে ৫০ লাখ টাকা ছিনতাই’। ঘটেছিল সকাল ১০টার দিকে মতিঝিলের অগ্রণী ও পূবালী ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ের ঠিক সামনে। পত্রিকার সংবাদ অনুযায়ী, ব্যাংকটির চিফ ক্যাশিয়ার ও একজন পিয়ন বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে টাকা তুলে দিলকুশায় গ্রিন্ডলেজ ব্যাংকের কার্যালয়ে মাইক্রোবাসে করে নিয়ে যাচ্ছিল। পূবালী ব্যাংকের সামনে আসতেই দুর্বৃত্তরা দুটি বোমার বিস্ফোরণ ঘটায়। এতে রাস্তা ফাঁকা হলে কাটা রাইফেলের ভয় দেখিয়ে ব্যাংকের কর্মচারী ও চালককে নামিয়ে মাইক্রোবাস নিয়ে পালিয়ে যায়। টাকাটা ছিল একটা স্টিলের ট্রাংকে।

সেই ডাকাতের দল ধরা পড়েছিল ৩৬ ঘণ্টার মধ্যেই। শেষ পর্যন্ত উদ্ধারও করা হয় প্রায় সব টাকা। সেই অর্থ উদ্ধারের কাহিনিও ছিল যথেষ্ট নাটকীয়। তখন পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি) উপ–পুলিশ কমিশনার (ডিসি) ছিলেন সফিক উল্লাহ। তার নেতৃত্বেই ডাকাত দল ধরা হয়েছিল। তিনি পুলিশ জীবনের অভিজ্ঞতা নিয়ে একটি বই লিখেছেন। ‘এক পুলিশের ডায়েরি’ নামের বইটি প্রকাশিত হয় ২০১৬ সালে। বইটিতে ৫০ লাখ টাকা উদ্ধারের ঘটনা বিস্তারিত লিখেছেন।

যে মাইক্রোবাস নিয়ে ডাকাতেরা পালিয়ে গিয়েছিল সেটি কিছু পরেই পুলিশ উদ্ধার করেছিল রাজারবাগ পুলিশ লাইনের দক্ষিণ পাশের একটি গলি থেকে। গাড়িতে একটি কাটা রাইফেল ও একটি পিস্তল পরিত্যক্ত অবস্থায় ছিল। এ নিয়ে শফিক উল্লাহ লিখেছেন, ‘অফিসে এসে বিগত বছরগুলোতে ব্যাংক ডাকাতির তথ্য সংগ্রহের চেষ্টা করি। কোন থানায় কটি ঘটনা, এগুলো কারা বা কোন চক্র করেছে—সে সব তথ্য মেলাতে থাকি।

এসি আকরাম, এসি আকতারুজ্জামান রুনু, এসি ফজলুল করিম, ইন্সপেক্টর সুলতানসহ সকলকে নিয়ে বসি। বিষয়টি নিয়ে তাঁরা তাদের অভিজ্ঞতা এবং মতামত জানাতে থাকেন। তারা সকলেই রইচ খান নামক একজন অত্যন্ত পাকা পাবলিক ড্রাইভারের কথা উল্লেখ করে জানায়, এ ড্রাইভার ইতিপূর্বে ব্যাংক ডাকাতিতে জড়িত ছিল। ফজলুল করিম জানায়, সেই ড্রাইভারটি বর্তমানে তার সোর্স হিসেবে কাজ করছে।’

তবে ডাকাত দলকে ধরার মূল সূত্রটি পুলিশ পেয়েছিল সায়েদাবাদ এলাকায় বসবাস করা এক সাংবাদিকের কাছ থেকে। সেই সাংবাদিক সন্ধ্যায় যাত্রাবাড়ীর একটি চায়ের দোকানে বসে চা খাচ্ছিলেন। তখন এক বাসের হেলপার অন্য আরেক বাসের হেলপারের কাছে ডাকাতির বর্ণনা দিচ্ছিলেন। হেলপারটি ডাকাতির ঘটনার সময় ‘হিরু ভাই’কে এদিক–সেদিক ছোটাছুটি করতে দেখেছিলেন, যিনি পরে একটি মাইক্রোবাসে উঠে চলে যান। তাঁর গায়ে ছিল লাল হাফ শার্ট। পুলিশ এরপর সেই হিরু ভাইকে খুঁজতে থাকে। ফুলবাড়িয়া বাসস্ট্যান্ডের শ্রমিক ইউনিয়নের সেক্রেটারির ছোট ভাইয়ের নাম ছিল হিরু। আর সেই শ্রমিক ইউনিয়ন ছিল সরকার দলীয় জাতীয় পার্টি সমর্থিত। হিরু সেই ইউনিয়ন কমিটির প্রভাবশালী সদস্য। সে ঢাকার তৎকালীন মেয়র কর্নেল মালেকের ডান হাত হিসেবে পরিচিত। জেনারেল এরশাদ তখন দেশের প্রেসিডেন্ট।

সেই হিরুকেই তুলে নিয়ে আসে পুলিশ। শ্রমিকনেতা তাই রাজনৈতিক চাপ আসতে পারে এই আশঙ্কায় হিরুকে ডিবি অফিসে না রেখে ক্যান্টনমেন্ট থানায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়। সেখানেই চলে জিজ্ঞাসাবাদের কাজ। সেই রাতেই সবকিছু স্বীকার করেন হিরু। পাওয়া যায় চোরাই মাইক্রোবাসের ড্রাইভারের খোঁজ। তিনি থাকেন মোহাম্মদপুরের নুরজাহান রোডের একটি বাড়িতে। ড্রাইভারটি অবাঙালি, নাম রইচ খান। বাসায় হানা দিয়ে ভোররাতে তাকে ধরা হয়। আর বাথরুমের অব্যবহৃত ফ্লাশ থেকে উদ্ধার করা হয় পাঁচ লাখ টাকা। এই সেই রইচ খান , যাঁকে এসি ফজলুল করিম সোর্স হিসেবে ব্যবহার করতেন। এরপর হিরুকে অভিযান চালায় পুলিশ। খিলগাঁওয়ের বাসা থেকে হিরুর গায়ে দেওয়া লাল শার্ট ভাগের ১২ লাখ টাকা উদ্ধার করা হয়। হিরু জানায় ডাকাতির ৫০ লাখ টাকা ১১ ভাগ হয়েছে। সারা রাত চলে অভিযান।

সকালে শফিক উল্লাহ পুলিশের তৎকালীন আইজি তৈয়ব উদ্দিন এবং পুলিশ কমিশনার নসরুল্লাহ খানকে নিয়ে চলে যান গুলশানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মাহমুদুল হাসানের বাসায়। সব শুনে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী লাল টেলিফোনে রাষ্ট্রপতি এরশাদকে ডাকাতির ঘটনা উদ্‌ঘাটন ও টাকা উদ্ধারের কথা জানান। এরপরে বাকি অর্থ উদ্ধারে অভিযান অব্যাহত থাকে। হিরু ও ড্রাইভারের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী আজিমপুরের নিউ পল্টন লাইনের একটি বাড়ি থেকে আরও তিনজনকে আটক করে উদ্ধার হয় ৯ লাখ টাকা।

ওই তিন ডাকাতের দেওয়া তথ্য অনুসারে মোহাম্মদপুরের কাটাসুর এলাকা থেকে দুজনের কাছ থেকে পাওয়া যায় আরও ১০ লাখ টাকা। সব মিলিয়ে উদ্ধার করা অর্থ ৩৬ লাখ টাকা। এরপর সাভারের বিরুলিয়ায় আরেকটা অভিযান চালানো হয়। সেখানে খড়ের গাদার ভেতর থেকে তিনজনের কাছ থেকে পাওয়া যায় ৯ লাখ টাকা। তারা জানান আরও দুজন ডাকাতের কথা। তাঁদের বাড়ি ছিল রংপুরে। ডাকাতির পর ওরা গ্রামে চলে যায়। সেখানে গিয়ে ওই দুই ডাকাতকেও ধরা হয়। সেখানে পাওয়া যায় আড়াই লাখ। বাকি টাকা দিয়ে দুই ডাকাত মোটরসাইকেল কিনেছিল। সেই মোটরসাইকেল দুটিও উদ্ধার করা হয়। এরপরেই টাকা উদ্ধারের কথা জানিয়ে প্রেস ব্রিফিং করা হয়।

শফিক উল্লাহ বইতে উল্লেখ করেন যে সব অর্থ উদ্ধার করে তবেই প্রেস ব্রিফিং করা হয়, তার আগে কাউকেই জানতে দেওয়া হয়নি। যদিও আংশিক অর্থ উদ্ধারের তথ্য ধরে একটি সংবাদ দৈনিক ইত্তেফাক–এ ছাপা হয়েছিল ১০ মার্চ, ডাকাতির ৫ দিন পরে। সেই সংবাদের শিরোনাম ছিল, ‘গ্রিন্ডলেজ ব্যাংকের সোয়া ১২ লাখ টাকা উদ্ধার।। আটক ৩ ’। প্রকাশিত সেই সংবাদে বলা হয়, ‘হিরুরেজা ওরফে হিরু ফুলবাড়িয়া বাসস্ট্যান্ডের একজন পরিবহন শ্রমিকনেতা। তাহাকে ক্যান্টনমেন্ট থানায় নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের একপর্যায়ে সে গ্রিন্ডলেজ ব্যাংকের ছিনতাইয়ের সহিত জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে।

হিরু জানায়, ছিনতাইয়ের সহিত ১২ জন জড়িত ছিল। ব্যাংকের টাকা ছিনতাইয়ের ব্যাপারে এই সংঘবদ্ধ ছিনতাই দলটি মাসাধিককাল ধরিয়া পরিকল্পনা করিয়া আসিতেছিল। ঘটনার দিন দলটি মোহাম্মদপুর এলাকা হইতে একটি ট্যাক্সি ছিনতাই করে। টাকা ছিনতাইয়ের পর তাহারা উক্ত ট্যাক্সিযোগে পালাইয়া যায়। হিরু জানায়, ছিনতাইকৃত টাকা নিরাপদ স্থানে নেওয়ার জন্য পূর্ব হইতেই শান্তিনগরে একটি টেম্পো প্রস্তুত রাখা হইয়াছিল। এই টেম্পোযোগে দুর্বৃত্তরা আজিমপুর কবরস্থানের নিকট একটি বস্তিতে গিয়া টাকা ভাগাভাগি করে। প্রত্যেক ছিনতাইকারীকে ৩ হইতে ৫ লক্ষ হইবে টাকা দেওয়া হয়।

পুলিশ জানায়, ছিনতাই কাজে ব্যবহৃত অস্ত্র সরবরাহকারীকে ৫ লক্ষ টাকা, হিরু ও তার খালাতো ভাইকে নয় লক্ষ টাকা ও গ্রেপ্তারকৃত অপর আসামি কথিত ডাকতি রইচ খানকে 8 লক্ষ টাকা দেওয়া হয়। পুলিশ রইছ খানের শ্যালিকা রিজিয়ার মোহাম্মদপুর ইকবাল রোডের বাসা হইতে ৩ লক্ষ ৯০ হাজার টাকা উদ্ধার করে। জানা যায়, কথিত রইচ খান ৮৬ সালে গুলিস্তানের গিনি এক্সচেঞ্জে দুর্ধর্ষ ডাকাতি মামলার অন্যতম আসামি। সে গোয়েন্দা পুলিশের এ সি ফজলুল করিমের নিকট গ্রিন্ডলেজ ব্যাংকের টাকা ছিনতাইয়ের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের খুঁজিয়া বাহির করিয়া দেওয়ার কথা বলিয়া আর্থিক সুবিধাও আদায় করে।

পুলিশের সূত্রটির মতে, এই ছিনতাই ঘটনার সহিত ব্যাংকের কিছু অসৎ কর্মচারীর জড়িত থাকার তথ্য-প্রমাণ তাহাদের হাতে ৱহিয়াছে। এই সব কর্মচারীদের ৫ লক্ষ টাকা দেওয়ার জন্য তুলিয়া রাখা হইয়াছিল। পুলিশ গতকাল রাত্র পর্যন্ত ৭টি বাড়িতে তল্লাশি চালাইয়াছে। পুলিশ অবশ্য এই ছিনতাই ঘটনার মূল পরিকল্পনাকারীকে গ্রেফতার করিতে পারে নাই।’

ঘটনাটি ৩৩ বছর আগের। তখন পুলিশ ঘটনা উদ্‌ঘাটন করেছিল ৩৬ ঘণ্টার মধ্যেই। আর বৃহস্পতিবারের ডাকাতি বা ছিনতাই ঘটনা অনেক কিছুই জানা গেল ১২ ঘণ্টার মধ্যে। তবে পার্থক্য হচ্ছে সেবার রাস্তা আটকিয়ে ব্যাংকের অর্থ ছিনতাই করতে অস্ত্র ব্যবহার করতে হয়েছিল, এবার বিনা অস্ত্রেই ডাকাতি সম্পন্ন।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.