২৯ খাল, মাত্র ১টিতে খনন

0
86
পানির ধারণক্ষমতা বাড়াতে কল্যাণপুর জলাধারের জায়গা খনন করছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন। গত ২৭ এপ্রিল রাজধানীর গাবতলী বেড়িবাঁধ সড়কসংলগ্ন কল্যাণপুর পাম্পহাউস থেকে তোলা

বর্ষা মৌসুমে ভারী বৃষ্টি হলে এবারও জলাবদ্ধতার আশঙ্কা। খালের সীমানা চিহ্নিত করে খুঁটি বসানোর কাজ চলছে

বৃষ্টির পানি ধারণের ক্ষমতা বাড়াতে রাজধানীর কল্যাণপুর জলাধার খননের কাজ চলছে ঠিকই, কিন্তু যেসব খাল দিয়ে বৃষ্টির পানি এই জলাধারে যাবে, সেই খালগুলো খনন করা হয়নি। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) আওতাধীন ২৯টি খালের মধ্যে গত প্রায় এক বছরে খনন হয়েছে মাত্র ১টি। অন্যদিকে রাস্তার পাশের নালা-নর্দমা পরিষ্কারের কাজও চলছে ধীরগতিতে। এসবের ফল হচ্ছে, ভারী বৃষ্টি হলে এবারও ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) বেশ কিছু এলাকায় জলাবদ্ধতা হতে পারে।

ঢাকা উত্তর সিটির আওতাধীন এলাকায় তিনটি জলাধার আছে। এর মধ্যে কল্যাণপুর জলাধারের দেখভালের দায়িত্ব সিটি করপোরেশনের। বাকি দুটি জলাধারের একটি হাতিরঝিল, অন্যটি মিরপুর বেড়িবাঁধ সড়কের গোড়ান-চটবাড়ি জলাধার। হাতিরঝিলের দায়িত্ব রাজউকের। আর গোড়ান-চটবাড়ি জলাধারের দায়িত্ব পানি উন্নয়ন বোর্ডের। কল্যাণপুর জলাধার আগে ঢাকা ওয়াসার অধীন ছিল। ২০২০ সালের ডিসেম্বরে রাজধানীর খালগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ ও তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব ঢাকা ওয়াসার কাছ থেকে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটির কাছে হস্তান্তর করা হয়।

ঢাকা ওয়াসা কাগজে-কলমে সিটি করপোরেশনকে যে হিসাব দিয়েছিল, তাতে কল্যাণপুর জলাধারের জায়গার পরিমাণ ৫৩ একর। তবে বাস্তবে সিটি করপোরেশন জলাধারের জায়গা বুঝে পেয়েছিল মাত্র তিন একর। বাকি জায়গা ছিল বেদখলে। জায়গা উদ্ধারে সিটি করপোরেশন খাল ও জলাধারের সীমানা চিহ্নিত করতে একটি প্রকল্প নেয়। সর্বশেষ গত মার্চে জলাধারের বেদখল হওয়া প্রায় এক একর জায়গা উদ্ধার করা গেছে। বাকি জায়গায় বস্তিসহ নানা ধরনের অবৈধ স্থাপনা রয়েছে। সিটি করপোরেশন বলছে, সীমানা চিহ্নিত করে খুঁটি বসানোর কাজ শেষ হলে বেদখল হওয়া জায়গা উদ্ধারে বিশেষ অভিযান চালানো হবে।

সিটি করপোরেশনের ড্রেনেজ সার্কেলের প্রকৌশলীরা জানান, ঢাকা উত্তর সিটির মিরপুর, ফার্মগেট ও রায়েরবাজারের একাংশসহ মোহাম্মদপুর, আগারগাঁও, আদাবর, শ্যামলী এবং মনসুরাবাদ এলাকায় বৃষ্টির পানি বিভিন্ন খালের মাধ্যমে কল্যাণপুর জলাধারে যায়। সেখান থেকে সেচযন্ত্রের মাধ্যমে পানি নদীতে ফেলা হয়।

ঢাকা উত্তর সিটির মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেন, ‘গত বছর সিত্রাংয়ের সময় মোহাম্মদপুর ডুবেছিল, এর একমাত্র কারণ কল্যাণপুর জলাধারের গভীরতা কম থাকা। তাই জলাধারের গভীরতা বৃদ্ধিতে জোর দিয়ে কাজটি করা হচ্ছে।’ খাল খননের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘অনেক খাল ভরাট ও ছোট করা হয়েছে। এতে জলাবদ্ধতা সমস্যা হচ্ছে। খাল উদ্ধারে প্রয়োজনে আমি আইনের শরণাপন্ন হব।’

আর দেড় মাস পর বর্ষাকাল শুরু হচ্ছে। গত বর্ষায় ঢাকা উত্তর সিটিতে অন্তত দুবার ব্যাপক আকারে জলাবদ্ধতা হয়। গত বছর বর্ষার মধ্যে ১৭ জুন রাজধানী ঢাকায় ২১ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছিল। ওই দিন ঢাকা উত্তর সিটির দক্ষিণখানের আশকোনা হজ ক্যাম্প, উত্তরখানের মাস্টারপাড়া বালুর মাঠ, তুরাগের ভাবনারটেক, মিরপুরের কালশী সড়ক, পশ্চিম মানিকদী, ফার্মগেটের পশ্চিম রাজাবাজার, ধানমন্ডির রায়েরবাজার, বাড্ডার নুরের চালা এবং মহাখালীসহ ১১টি এলাকায় জলাবদ্ধতা হয়েছিল।

এমনকি গত বছরের ২৫ অক্টোবর ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের প্রভাবে হওয়া বৃষ্টিতে ঢাকা উত্তর সিটির মোহাম্মদিয়া হাউজিং লিমিটেড, নবোদয় হাউজিং, শ্যামলী হাউজিং, মনসুরাবাদ হাউজিং, গাবতলী সিটি কলোনি, মিরপুরের কাজীপাড়া, শেওড়াপাড়া, টোলারবাগ, দক্ষিণখানের মেডিকেল সড়ক এবং উত্তরখানসহ অন্তত ১২টি এলাকায় ভয়াবহ জলাবদ্ধতা ছিল।

খালে খনন বন্ধ

গত বছর বর্ষা মৌসুম শেষ হওয়ার পর থেকে চলতি বছরের এপ্রিল পর্যন্ত মাত্র একটি খাল খননের কাজ করেছে ঢাকা উত্তর সিটি। বাকি খালগুলো থেকে শুধু ভাসমান ময়লা-আবর্জনা পরিষ্কার করা হয়েছে। সিটি করপোরেশন সূত্র বলছে, গত নভেম্বর থেকে চলতি এপ্রিল পর্যন্ত শুধু বর্ধিত পল্লবী খাল খনন করা হয়েছে। গত এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে মিরপুর-১২ নম্বর সেকশনের ভোলার বস্তি এলাকায় ওই খালের ১০০ মিটার খনন করা হয়। খালটি থেকে প্রায় ৪০০ টন বর্জ্যও (ভাসমান ময়লা-আবর্জনা, বালু, মাটি প্রভৃতি) অপসারণ করা হয়।

সিটি করপোরেশনের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের দুজন কর্মকর্তা জানান, বর্ধিত পল্লবী খালের অনেক জায়গা বেদখল হয়ে আছে। যেটুকু খনন করা হয়েছে, তাতে খুব একটা লাভ হবে না। তাঁরা বলছেন, সব কটি খালের সীমানা চিহ্নিত করার কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা কিংবা খননের কাজ করা যাচ্ছে না।

ঢাকা উত্তর সিটির আওতাধীন খালগুলো হচ্ছে—কাটাসুর খাল, রামচন্দ্রপুর খাল, কল্যাণপুর মূল খাল, কল্যাণপুর ক, খ, ঘ, ঙ ও চ খাল, রূপনগর মূল খাল (এর একটি অংশ বর্ধিত পল্লবী খাল নামে পরিচিত), আরামবাগ খাল, রূপনগর দুয়ারিপাড়া খাল, রূপনগর চিড়িয়াখানা খাল, মিরপুর দিয়াবাড়ি খাল, ইব্রাহিমপুর খাল, বাউনিয়া খাল, আবদুল্লাহপুর খাল, দ্বিগুণ খাল, বাইশটেকী খাল, সাংবাদিক কলোনি খাল, বেগুনবাড়ি খাল, শাহজাদপুর খাল, সুতি ভোলা খাল, কসাইবাড়ি খাল, মহাখালী খাল, উত্তরা দিয়াবাড়ি খাল, ডুমনি খাল, বোয়ালিয়া খাল, গোবিন্দপুর খাল এবং নরাই খাল।

চলতি অর্থবছরে (২০২২-২৩) জলাবদ্ধতা নিরসনে বিভিন্ন খাতে ডিএনসিসি বরাদ্দ রেখেছে ৪৭ কোটি ৭০ লাখ ৬৪ হাজার টাকা। এই টাকার বড় অংশই (সাড়ে ২৭ কোটি টাকা) ব্যয় হচ্ছে খালের সীমানা চিহ্নিতকরণ এবং খুঁটি স্থাপন প্রকল্পের কাজে। খাল, নালা ও কালভার্ট মেরামত এবং রক্ষণাবেক্ষণে ব্যয় করা হচ্ছে ১০ কোটি টাকা। খাল পরিষ্কারে ব্যয় ধরা হয়েছে ৫ কোটি টাকা। জলাধারের সেচযন্ত্র (পাম্পহাউস) পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণ বাবদ বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৫ কোটি টাকা।

খালে ময়লা–আবর্জনা জমে পানির প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। গত ২৭ এপ্রিল রাজধানীর রূপনগর খালে
খালে ময়লা–আবর্জনা জমে পানির প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। গত ২৭ এপ্রিল রাজধানীর রূপনগর খালেছবি: ড্রিঞ্জা চাম্বুগং

ওয়াসার কাছ থেকে দায়িত্ব বুঝে পাওয়ার পরে ২০২০-২১ অর্থবছরের শেষ ছয় মাসে এবং ২০২১-২২ অর্থবছরে খাল খনন ও পরিষ্কারের কাজে অর্থাৎ জলাবদ্ধতা নিরসনের লক্ষ্যে ঢাকা উত্তর সিটি ব্যয় করেছে মোট ৩৩ কোটি ৭২ লাখ টাকা। এর মধ্যে ২০২০-২১ অর্থবছরে শুধু খালের ময়লা-আবর্জনা পরিষ্কারে ব্যয় হয় ১১ কোটি টাকা। আর খাল, নালা ও কালভার্ট মেরামত এবং রক্ষণাবেক্ষণে ৮ কোটি এবং জলাধারের পাম্প (পানি সেচের জন্য) পরিচালনায় তিন কোটি টাকা ব্যয় করেছিল ডিএনসিসি। সর্বশেষ গত অর্থবছরে এসব খাতে আরও ১১ কোটি ৭২ লাখ টাকা ব্যয় করেছে।

কল্যাণপুর জলাধার খননের মাধ্যমে সেখানে পানির ধারণক্ষমতা প্রায় দ্বিগুণ করা হচ্ছে। ডিএনসিসির ড্রেনেজ সার্কেলের প্রকৌশলীরা জানান, খননের ফলে কল্যাণপুর জলাধারে প্রায় ৬০ হাজার ঘনমিটার (এক ঘনমিটার সমান ১০০০ হাজার লিটার) ধারণক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে।

করপোরেশনের ড্রেনেজ সার্কেলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আবুল হাসনাত মো. আশরাফুল আলম বলেন, কল্যাণপুর জলাধার খননের কাজ চলছে। খননের পর জলাধারের প্রায় ৩ একর এলাকার গভীরতা এখন ৯ মিটার। এই জলাধারের যেসব জায়গা দখলমুক্ত করা হয়েছে, সেটিও ৯ মিটার গভীরতায় খনন করা হচ্ছে।

গত নভেম্বরে এই জলাধার খননের কাজ শুরু হয়। এ জন্য ব্যয় হচ্ছে প্রায় ৯ কোটি টাকা। তিনটি খননযন্ত্রের সাহায্যে কাজটি চলছে। আগামী বর্ষায় এই জলাধার ১ লাখ ১২ হাজার ঘনমিটার পানি ধারণ করতে পারবে বলে জানিয়েছেন সিটি করপোরেশনের প্রকৌশলীরা।

২৯ খালের মধ্যে মাত্র ১টি খনন করার বিষয়ে নাগরিক আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত স্থপতি ইকবাল হাবিব বলেন, যদি বর্ষা মৌসুমে স্বাভাবিক বৃষ্টিও হয়, তাহলে সিটি করপোরেশন জলাবদ্ধতা নিরসনে ব্যর্থ হবে, নগরবাসী ভুগবে, রাস্তা হবে খাল, এতে কোনো সন্দেহ নেই। এর কারণ খাল ও জলাধার খনন কিংবা রক্ষায় যে কারিগরি দক্ষতা এবং অভিজ্ঞতা প্রয়োজন তা সিটি করপোরেশনের নেই। ফলে তারা সার্বিক পরিকল্পনা বিষয়টিই অনুধাবন করতে ব্যর্থ হচ্ছে। খালের টুকরো টুকরো অংশ উদ্ধারের মাধ্যমে জলাবদ্ধতা নিরসনের সুযোগ নেই। বিষয়টি ধর–মার–কাটের মতো নয়।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.