স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে নতুন মন্ত্রিসভার যাত্রা

0
76
রাষ্ট্রপতি মোঃ সাহাবুদ্দিন নতুন সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রীদের শপথবাক্য পাঠ করান

অর্থনৈতিক সব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ে যাত্রা শুরু করল নতুন মন্ত্রিসভা। এবার মন্ত্রিসভা গঠন করা হয়েছে অভিজ্ঞ, দক্ষ, কর্মঠ ও তারুণ্যের সমন্বয়ে। পঞ্চমবারের মতো প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন শেখ হাসিনা। আর টানা চতুর্থবারের মতো সরকার গঠন করল আওয়ামী লীগ।

গতকাল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৭টায় বঙ্গভবনের দরবার হলে রাষ্ট্রপতি মোঃ সাহাবুদ্দিন নতুন সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রীদের শপথবাক্য পাঠ করান। এবার শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মন্ত্রিসভার সদস্য ৩৭ জন। এটা বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে ছোট মন্ত্রিসভা। এর মধ্যে মন্ত্রী ২৫ জন এবং ১১ জন প্রতিমন্ত্রী। তবে মন্ত্রিসভায় আরও দু’একজন নতুন করে

যুক্ত হতে পারেন বলে আলোচনা আছে। এদিন প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা হিসেবে মন্ত্রীর পদমর্যাদায় ছয়জনকে নিয়োগ করা হয়েছে। এর মধ্যে একজন নতুন। অন্যরা আগেও উপদেষ্টা ছিলেন।

নতুন মন্ত্রিসভা গঠনের পর মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীদের দপ্তর বণ্টন করা হয়। এতে সবচেয়ে বেশি আলোচনায় ডা. দীপু মনির দপ্তর বদলের বিষয়টি। তাঁকে শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে সরিয়ে নতুন সরকারে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ে দেওয়া হয়েছে। এটিকে এক ধরনের ‘পদাবনতি’ হিসেবেই দেখছেন দলের নেতাকর্মী। তবে তথ্য মন্ত্রণালয় থেকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে যোগ দিতে যাওয়া ড. হাছান মাহমুদের দপ্তর বদলকে এক ধরনের ‘পদোন্নতি’ বলেই মনে করছেন অনেকে। এ দু’জন বাদে মন্ত্রী বাকি সবারই আগের মন্ত্রণালয়ে রাখা হয়েছে। মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল মন্ত্রী হিসেবে পদোন্নতি পেয়ে আগের মন্ত্রণালয়েরই দায়িত্ব পেয়েছেন।

প্রতিমন্ত্রী অনেকেই প্রথমবার এসে গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় পেয়েছেন। মোহাম্মদ আলী আরাফাত তথ্য এবং আহসানুল ইসলাম টিটু বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পেয়েছেন। এই দুই মন্ত্রণালয়ে এখনও কোনো পূর্ণ মন্ত্রী দেওয়া হয়নি। পুরোনো চার প্রতিমন্ত্রীকে তাদের আগের মন্ত্রণালয়েই রাখা হয়েছে। তবে জুনাইদ আহমেদ পলক তাঁর আগের আইসিটির সঙ্গে এবার ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বও বাড়তি পেয়েছেন। এ ছাড়া শ্রম ও কর্মসংস্থান এবং সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব এখনও কাউকে দেওয়া হয়নি।

এবারের মন্ত্রিসভায় বড় চমক এনেছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। আগের মন্ত্রিসভা থেকে বাদ পড়েছেন ১৫ প্রভাবশালী মন্ত্রী। নতুন তালিকায় স্থান পেয়েছেন উদ্যমী ও স্বচ্ছ ভাবমূর্তির ১৪ নতুন মুখ।

পাশাপাশি এবারের মন্ত্রিসভায় ১৪ দলীয় শরিকের কারও ঠাঁই হয়নি। শুধু আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্যদের মধ্য থেকেই মন্ত্রিসভার সদস্য করা হয়েছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, মন্ত্রিসভা গঠনে এবার শেখ হাসিনা বিচক্ষণতা ও দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছেন। উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখার পাশাপাশি স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে মেধাবী, উদ্যমী, স্বচ্ছ ভাবমূর্তি এবং পরিশ্রমী নবীন-প্রবীণের মিশেলে স্মার্ট একটি মন্ত্রিসভা করা হয়েছে।

বঙ্গভবনের আলো-ঝলমলে দরবার হলের শপথ অনুষ্ঠানে জাতীয় সংসদের স্পিকার, প্রধান বিচারপতি, প্রধান নির্বাচন কমিশনার, সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি, সংসদ সদস্য, রাজনৈতিক নেতা, তিন বাহিনীর প্রধানগণ, কূটনৈতিক কোরের সদস্য, সাংবাদিক এবং উচ্চপদস্থ বেসামরিক ও সামরিক কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রপতির পত্নী ড. রেবেকা সুলতানা, প্রধানমন্ত্রীর ছোট বোন শেখ রেহানাসহ পরিবারের অন্য সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন। সেখানে ঢাকায় বিদেশি কূটনৈতিক মিশন, জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা ও আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিনিধিদেরও আমন্ত্রণ জানানো হয়। এতে প্রায় এক হাজার ৪০০ অতিথিসহ বিশিষ্ট ব্যক্তিরা উপস্থিত ছিলেন।
অফ-হোয়াইট শাড়ি পরা শেখ হাসিনা সন্ধ্যা ৬টা ৫৫ মিনিটে দরবার হলে প্রবেশ করলে তাঁকে দাঁড়িয়ে অভিবাদন জানান সবাই। এ সময় প্রধানমন্ত্রীকে আত্মবিশ্বাসী ও প্রাণবন্ত দেখাচ্ছিল। কয়েক মিনিট পর রাষ্ট্রপতি মোঃ সাহাবুদ্দিন দরবার হলে প্রবেশ করেন। প্রধানমন্ত্রী সন্ধ্যা ৭টা ৬ মিনিটে শপথ নেন। এর পর পর্যায়ক্রমে শপথ নেন মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রীরা। মন্ত্রিপরিষদ সচিব মো. মাহবুব হোসেন শপথ অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন।

নতুন প্রধানমন্ত্রী বঙ্গভবন থেকে ফেরার পথে রাজউক অ্যাভিনিউ ও বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ মোড়ে হাজারো মানুষের ঢল নামে। নতুন মন্ত্রীদের শপথ ঘিরে গতকাল সন্ধ্যায় বঙ্গভবনের সামনে ভিড় জমেছিল উৎসুক জনতার।

বঙ্গভবনে শপথের পর নবনিযুক্ত মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও আগত অতিথিদের বৈচিত্র্যময় খাবার দিয়ে আপ্যায়ন করা হয়। এতে মাংস ও সবজিজাতীয় খাবারে প্রাধান্য দেওয়া হয়। ছিল মাটন শিক কাবাব, চিকেন সাসলিক, ভেটকি মাছের ফিশ ফিঙ্গার। এ ছাড়া বয়েল্ড ভেজিটেবলসের সঙ্গে দেওয়া হয় মাশরুম, পনির সমুচা ও পাই। পরিবেশন করা হয় পাটিসাপটা পিঠা; সঙ্গে মিষ্টি-বাকলাভা। এ ছাড়া ছিল কমলা, আপেল, আঙুর দিয়ে সাজানো ফলের ঝুড়ি। বঙ্গভবনের সবুজ লনে সাজানো শামিয়ানার নিচে চা আর কফিতে অতিথিদের আড্ডা জমে উঠেছিল। এর আগে গতকাল দুপুরে নতুন মন্ত্রিসভা গঠন বিষয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ।

মন্ত্রীরা কে কোন দপ্তরে
আ ক ম মোজাম্মেল হক (মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়), ওবায়দুল কাদের (সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়), নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূন (শিল্প মন্ত্রণালয়), আসাদুজ্জামান খান কামাল (স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়), ডা. দীপু মনি (সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়), মো. তাজুল ইসলাম (স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়), মুহাম্মদ ফারুক খান (বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়), আবুল হাসান মাহমুদ আলী (অর্থ মন্ত্রণালয়), আনিসুল হক (আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়), ড. হাছান মাহমুদ (পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়), মো. আব্দুস সালাম (পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়), সাধন চন্দ্র মজুমদার (খাদ্য মন্ত্রণালয়), র আ ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী (গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়), নারায়ণ চন্দ্র চন্দ (ভূমি মন্ত্রণালয়), মো. আব্দুর রহমান (মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়), উপাধ্যক্ষ আব্দুস শহীদ (কৃষি মন্ত্রণালয়), মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল (শিক্ষা মন্ত্রণালয়), ফরহাদ হোসেন (জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়), মো. ফরিদুল হক খান দুলাল (ধর্মবিষয়ক মন্ত্রণালয়), মো. জিল্লুল হাকিম (রেলপথ মন্ত্রণালয়), সাবের হোসেন চৌধুরী (পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়), জাহাঙ্গীর কবির নানক (বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়), নাজমুল হাসান পাপন (যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়), টেকনোক্র্যাট কোটায় স্থপতি ইয়াফেস ওসমান (বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়) এবং ডা. সামন্ত লাল সেন  স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়।

প্রতিমন্ত্রীরা কে কোন দপ্তরে
সিমিন হোসেন রিমি (মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়), নসরুল হামিদ (বিদ্যুৎ বিভাগ), জুনাইদ আহমেদ পলক (ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়), মোহাম্মদ আলী আরাফাত (তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়), মো. মহিববুর রহমান (দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়), খালিদ মাহমুদ চৌধুরী (নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়), জাহিদ ফারুক শামীম (পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়), কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা (পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়), শফিকুর রহমান চৌধুরী (প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়), রুমানা আলী টুসি (প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়) এবং আহসানুল ইসলাম টিটু (বাণিজ্য মন্ত্রণালয়)।

নতুন মন্ত্রীদের প্রতিক্রিয়া
শপথ নেওয়ার আগে ও পরে নতুন মন্ত্রীরা গণমাধ্যমের কাছে তাদের অনুভূতি ব্যক্ত করেছেন। সড়ক পরিবহন সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, দ্রব্যমূল্য আমাদের অগ্রাধিকারে থাকবে। সামনে রমজান, এর পর আছে কোরবানি। দ্রব্যমূল্য সহনীয় রাখার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে আমরা কাজ করব। এটাই আমাদের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।

পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনমন্ত্রী সাবের হোসেন চৌধুরী বলেন, নানা বৈশ্বিক অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত সমস্যার পরও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশের জনগণকে বাসযোগ্য পরিবেশ ও উন্নত জীবন দিতে কাজ করব।

মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী আব্দুর রহমান বলেন– আত্মবিশ্বাস ছিল, বঙ্গবন্ধুকন্যা হয়তো মন্ত্রিসভায় রাখতেও পারেন। তিনি রেখেছেন। তাঁর প্রতি আমি কৃতজ্ঞ।
যুব ও ক্রীড়ামন্ত্রী নাজমুল হাসান পাপন বলেন, যুব ও ক্রীড়ার উন্নয়নে সর্বোচ্চ আন্তরিকতা নিয়ে কাজ করব। এখন কি তিনি বিসিবি সভাপতির দায়িত্বে থাকবেন? এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, আইসিসির এখন কতগুলো নিয়ম আছে; ইচ্ছা করলেই ছেড়ে দেওয়া যায় না। কারণ আইসিসির যে কমিটিগুলোতে আমি আছি, আমি আবার চেয়ারম্যানও আছি। ওই দায়িত্বগুলো ওদের টার্ম শেষ হওয়ার আগে করা যায় না।

ছয় উপদেষ্টা নিয়োগ
প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা হিসেবে মন্ত্রীর পদমর্যাদায় ছয়জনকে নিয়োগপূর্বক দায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছে। তারা হলেন– ড. মসিউর রহমান, ড. গওহর রিজভী, ড. তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী, সালমান ফজলুর রহমান, ড. কামাল আব্দুল নাসের চৌধুরী ও মেজর জেনারেল (অব.) তারিক আহমেদ সিদ্দিক।

তবে তারা কে কোন বিষয়ক উপদেষ্টা, তা প্রজ্ঞাপনে বলা হয়নি। তাদের মধ্যে এই পদে ড. কামাল আব্দুল নাসের চৌধুরী নতুন। বাকিরা গত মেয়াদেও প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা পদে নিয়োজিত ছিলেন। প্রজ্ঞাপনে উল্লেখ করা হয়েছে, উপদেষ্টা পদে অধিষ্ঠিত থাকাকালে তাঁরা মন্ত্রীর পদমর্যাদা, বেতন-ভাতাদি ও আনুষঙ্গিক সুযোগ-সুবিধা পাবেন।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.