সেন্ট্রাল হাসপাতালে নবজাতক ও মায়ের মৃত্যুতে ৩ পক্ষকে দায়ী করল কমিটি

0
102
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর

স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয় গঠিত তদন্ত কমিটি বলছে, কুমিল্লার মাহাবুবা রহমান আঁখির চিকিৎসায় ত্রুটি ছিল। ত্রুটির জন্য একাধিক চিকিৎসক ও রাজধানীর সেন্ট্রাল হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ দায়ী। কমিটি বলছে, দায়ী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান বেআইনি ও অনৈতিক কাজ করেছে। দায় আছে মারা যাওয়া মাহাবুবার স্বামীরও।

তদন্ত প্রতিবেদনে তিনজন চিকিৎসকের বিরুদ্ধে ১০টি ও সেন্ট্রাল হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে ৪টি—মোট ১৪টি ত্রুটি এবং বেআইনি ও অনৈতিক কাজের উল্লেখ করা হয়েছে। আর মাহাবুবার স্বামীর বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ ৪টি।

১১ জুন সেন্ট্রাল হাসপাতালে প্রথমে নবজাতক ও পরে ১৮ জুন মায়ের মৃত্যু হয়। স্বামীর অভিযোগের ভিত্তিতে ধানমন্ডি থানা-পুলিশ ওই হাসপাতালের দুই নারী চিকিৎসককে গ্রেপ্তার করে। মা ও নবজাতকের মৃত্যুর ঘটনা সাধারণ মানুষের মধ্যে বড় ধরনের আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। অন্যদিকে দুজন চিকিৎসককে কারাগারে পাঠানোতে চিকিৎসকদের মধ্যে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। দুই চিকিৎসকের মুক্তির দাবিতে চিকিৎসকেরা মানববন্ধন ও কর্মবিরতির মতো কর্মসূচি হাতে নেন।

প্রতিবেদনে সত্যি কথাই বলা হয়েছে। (প্রতিবেদনে) যেভাবে আছে সেভাবেই পেপারে ছাপিয়ে দিতে পারেন।

এম এ কাশেম, পরিচালক (প্রশাসন), সেন্ট্রাল হাসপাতাল

ঘটনা তদন্তে কমিটি করে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গত মাসের শেষ সপ্তাহে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে ১৪ পৃষ্ঠার তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। কমিটির আহ্বায়ক ছিলেন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (আইন) হোসেন আলী খোন্দকার। কমিটির সদস্যসচিব ছিলেন বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের (বিএমডিসি) রেজিস্ট্রার (ভারপ্রাপ্ত) মো. লিয়াকত হোসেন।

সদস্য ছিলেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক এ বি এম মাকসুদুল আলম, স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ও মিটফোর্ড হাসপাতালের অধ্যাপক (গাইনি অ্যান্ড অবস) আফরোজা কুতুবী ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিকসমূহ) শেখ দাউদ আদনান।

তদন্ত প্রতিবেদন পড়ে এবং হাসপাতালের কর্মকর্তা ও সংশ্লিষ্ট একাধিক পক্ষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সেন্ট্রাল হাসপাতালের কনসালট্যান্ট সংযুক্তা সাহা স্বাভাবিক প্রসবের ব্যাপারে মানুষকে উৎসাহ দিতেন এবং স্বাভাবিক প্রসবের ব্যাপারে তিনি বিশেষজ্ঞ। সংযুক্তা সাহা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এ ব্যাপারে প্রচারণা চালাতেন। অন্যদিকে স্বাভাবিক প্রসবে আগ্রহী ছিলেন কুমিল্লার নাঙ্গলকোট উপজেলার কাশিপুর গ্রামের ইয়াকুব আলীর স্ত্রী মাহবুবা রহমান আঁখি।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ৯ জুন প্রসবব্যথা দেখা দিলে ইয়াকুব আলী স্ত্রীকে নিয়ে প্রথমে তিতাস উপজেলা হাসপাতালে যান। হাসপাতাল থেকে বলা হয়, মাহবুবার স্বাভাবিক প্রসব সম্ভব নয়, অস্ত্রোপচার করতে হবে। স্বামী ও স্ত্রী অস্ত্রোপচারে রাজি হননি। তাঁরা রওনা দেন রাজধানীর সেন্ট্রাল হাসপাতালের উদ্দেশ্যে।

হাসপাতাল থেকে আশ্বাস দেওয়া হয়, হাসপাতালে সংযুক্তা সাহা আছেন। গভীর রাতে ওই দম্পতি হাসপাতালে পৌঁছানোর পরও বলা হয় সংযুক্তা সাহা হাসপাতালে আছেন। বাস্তবে তিনি হাসপাতালে ছিলেন না। তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এবং সংযুক্তাসহ একাধিক চিকিৎসক সংযুক্তা সাহার অনুপস্থিতির বিষয়টি ইয়াকুব আলীর কাছে গোপন রাখেন।

ঘটনা তদন্তে কমিটি করে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গত মাসের শেষ সপ্তাহে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে ১৪ পৃষ্ঠার তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছে।

হাসপাতালের বিরুদ্ধে অভিযোগ

তদন্ত প্রতিবেদনে সেন্ট্রাল হাসপাতালের বিরুদ্ধে চারটি অভিযোগের উল্লেখ আছে। সংযুক্তা সাহা ও মুনা সাহার নিবন্ধন নবায়ন না থাকার পরও পেশা চর্চার সুযোগ দেওয়া; হাসপাতালে সংযুক্তা সাহার অনুপস্থিতির বিষয়টি গোপন করা; সংযুক্তা সাহার অনুপস্থিতিতে তাঁর নামে রোগী ভর্তি করানো ও অন্য চিকিৎসকের মাধ্যমে চিকিৎসা করা এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অবৈধ ও বেআইনি প্রচারণার ব্যাপারে কোনো পদক্ষেপ না নেওয়া।

এসব অভিযোগের ব্যাপারে জানতে চাইলে সেন্ট্রাল হাসপাতালের পরিচালক (প্রশাসন) এম এ কাশেম বলেন, ‘প্রতিবেদনে সত্যি কথাই বলা হয়েছে। (প্রতিবেদনে) যেভাবে আছে সেভাবেই পেপারে ছাপিয়ে দিতে পারেন।’ পরে তিনি সংযুক্তা সাহা সম্পর্কে বেশ কিছু অভিযোগ তুলে বলেন, তাঁকে এই হাসপাতালে আর কাজ করতে দেওয়া হয় না।

সংযুক্তা রোগীকে ঠকিয়েছেন

৯ জুন রাতে কাজ করার পর সংযুক্তা সাহা বিদেশ যাবেন—এটা আগেই ঠিক ছিল। বিদেশ যাওয়ার আগে রোগীর স্বামী ইয়াকুব আলীর সঙ্গে তাঁর মুঠোফোনে কথা হয়, তিনি তাঁদের হাসপাতালে আসতে বলেছিলেন। বিদেশ যাওয়ার কথা তিনি রোগীর স্বামীকে জানাননি, এমনকি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকেও জানাননি।

এ ছাড়া তদন্ত প্রতিবেদনে তাঁর বিরুদ্ধে আরও তিনটি অভিযোগ আছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে স্বাভাবিক প্রসব নিয়ে তাঁর প্রচারিত ভিডিওতে অতিরঞ্জন আছে, সংযুক্তার অনুপস্থিতিতে তাঁর নামে রোগী ভর্তি করা ও তাঁর নামে চিকিৎসা দেওয়া এবং বিদেশ যাওয়ার আগে চিকিৎসার জন্য চিকিৎসক শাহাজাদী মুস্তার্শিদাকে নির্দেশ দিয়ে যাওয়া। তদন্ত প্রতিবেদনে আছে, শাহজাদী মুস্তার্শিদার ‘কোনো গাইনোকলজি ডিগ্রি নেই’।

তদন্ত প্রতিবেদনের ব্যাপারে সংযুক্তা সাহার বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি। গতকাল মঙ্গলবার তাঁর ব্যক্তিগত মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে বাসা থেকে বলা হয় তিনি বিদেশে আছেন। তবে তদন্ত কমিটিকে সংযুক্তা সাহা বলেছেন, সেন্ট্রাল হাসপাতালে কোনো নিয়মকানুন নেই এবং মা ও নবজাতকের মৃত্যুর জন্য সেন্ট্রাল হাসপাতাল দায়ী। তাঁর অবর্তমানে তাঁকে না জানিয়ে মাহবুবা রহমানকে ভর্তি করা হয়েছিল।

অন্যদিকে এম এ কাশেম তদন্ত দলকে বলেছেন, বিএমডিসির নিবন্ধন নবায়ন না থাকার পরও সংযুক্তা সাহাকে অস্ত্রোপচার কক্ষ ও হাসপাতাল ব্যবহার করতে দেওয়া ভুল ছিল।

তাঁরা সত্য গোপন করেছেন

তদন্ত প্রতিবেদনে চিকিৎসায় ত্রুটির ব্যাপারে কিছু অভিযোগ আছে শাহাজাদী মুস্তার্শিদার বিরুদ্ধে। প্রথমত সংযুক্তা সাহার অনুপস্থিতির কথা তিনি গোপন করেন। পাশাপাশি শাহাজাদী মুস্তার্শিদা কথাবার্তা ও আচার–আচরণে এমন পরিবেশ সৃষ্টি করেন, যাতে রোগীপক্ষের মনে হয় যে সংযুক্তা সাহা ওই সময় হাসপাতালে উপস্থিত ছিলেন।

তদন্ত কমিটি বলছে, প্রয়োজনের সময়ে একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক উপস্থিত করানোর জন্য শাহাজাদী মুস্তার্শিদা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করেননি। তিনি রোগীর বাস্তব ও প্রকৃত অবস্থা অনুধাবন করতে পারেননি। না পারার কারণে তিনি বিভিন্ন পদ্ধতিতে প্রসব করানোর চেষ্টা করেছিলেন।

তদন্ত প্রতিবেদনে চিকিৎসক মুনা সাহার বিরুদ্ধে অভিযোগ দুটি। প্রথমত সংযুক্তা সাহার অনুপস্থিতির কথা তিনি জানতেন, তবে গোপন করেছিলেন। হাসপাতালে রোগী আসার পর তিনি এমন একটি পরিবেশ সৃষ্টি করেন তাতে রোগীপক্ষের মনে হয়নি যে সংযুক্তা সাহা হাসপাতালে উপস্থিত নেই।

দোষ ছিল স্বামীরও

তদন্ত প্রতিবেদনে মাহবুবা রহমানের স্বামীর বিরুদ্ধে চারটি অভিযোগ তুলে ধরা হয়েছে। তিনি স্ত্রীকে নিয়মিত বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক দিয়ে পরীক্ষা করাতেন না, স্ত্রীর দীর্ঘদিন তীব্র রক্তশূন্যতা জেনেও চিকিৎসা করাননি, স্বাভাবিক প্রসবের ব্যাপারে দৃঢ় অবস্থানে থাকা এবং ঝুঁকিপূর্ণ জেনেও একটি সাধারণ গাড়িতে করে স্ত্রীকে কুমিল্লা থেকে ঢাকায় আনা।

এসব অভিযোগের ব্যাপারে চেষ্টা করেও ইয়াকুব আলীর বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের উপসচিব (অতিরিক্ত দায়িত্ব) উম্মে হাবিবা একটি চিঠিসহ ওই তদন্ত প্রতিবেদন ছয়টি দপ্তরে পাঠিয়েছেন। এই প্রতিবেদন পাওয়ার পর মন্ত্রণালয় কী পদক্ষেপ নিচ্ছে, তা জানার জন্য গতকাল স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের সচিবের মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করা হয়। খুদে বার্তাও পাঠানো নয়। কিন্তু কোনো সাড়া মেলেনি।

শিশির মোড়ল

ঢাকা

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.