সারাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে ডেঙ্গু

0
124
রক্ত পরীক্ষা শেষে মেয়ে সায়মাকে নিয়ে বেডে যাচ্ছেন মোহাম্মদ আলী। বৃহস্পতিবার মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে তোলা

জেলা থেকে উপজেলা, এমনকি ইউনিয়ন পর্যায়েও ছড়িয়ে পড়েছে ডেঙ্গু। রোগটির জীবাণুবাহী এডিস মশার বিস্তার এখন দেশজুড়ে। খোদ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাবেই ৫৭ জেলায় ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়ার কথা বলা হচ্ছে। তবে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, আদতে কোনো জেলা আর ডেঙ্গুমুক্ত নয়। তারা বলছেন, তৃণমূলের ডেঙ্গু আক্রান্তের তথ্য স্বাস্থ্য দপ্তরে পৌঁছাচ্ছে না। তাই সরকারি খাতায় আক্রান্তের সংখ্যা বাস্তবের চেয়ে অনেক কম। ডেঙ্গু পরিস্থিতির আরও অবনিত হতে পারে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর রাজধানীর ৫৩টি সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালের ডেঙ্গু রোগীর তথ্য সংগ্রহ করে প্রকাশ করে। এ ছাড়া সংগ্রহ করে জেলা পর্যায়ের সরকারি হাসপাতালের তথ্য। এভাবে মোট আক্রান্তের সংখ্যা তালিকা করে অধিদপ্তর। ফলে মফস্বল এলাকার সব হাসপাতাল-ক্লিনিকের তথ্য বাইরে থেকে যায়।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তরফ থেকে গতকাল বৃহস্পতিবার গণমাধ্যমে পাঠানো তথ্যে দেখা যায়, সাত জেলায় ডেঙ্গু রোগী পাওয়া যায়নি। এগুলো হলো– চুয়াডাঙ্গা, নাটোর, জয়পুরহাট, ঝালকাঠি, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ ও গোপালগঞ্জ।

এ ব্যাপারে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম শাখার পরিচালক অধ্যাপক ডা. মো. শাহাদাত হোসেন  বলেন, সরকারি ৯৮ শতাংশ হাসপাতালের ডেঙ্গু রোগীর তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি রোগীর তথ্যগুলোও জানার কাজ চলছে। আশা করা যায়, দ্রুত সময়ের মধ্যে সব হাসপাতালের তথ্যই চলে আসবে। করোনার সময় জরুরি উদ্যোগের কারণে সব হাসপাতালের তথ্য একসঙ্গে পাওয়া গেছে। সেটারও চেষ্টা চলছে।

জানা গেছে, ঢাকাসহ দেশের বড় সিটি করপোরেশনগুলো নিয়মিত মশার ওষুধ ছিটানোর কাজ করে। তাদের কিছু মশককর্মী রয়েছেন, তবে তা পর্যাপ্ত নয়।

অন্য সিটি করপোরেশনের মশক নিধন ব্যবস্থাপনা আরও নাজুক। জেলা পর্যায়ে মশার ওষুধ ছিটাতে খুব একটা দেখা যায় না। উপজেলা পর্যায়ে দু-একজন মশককর্মী আছেন। আর ইউনিয়ন পর্যায়ে জনবল-যন্ত্রপাতির কিছুই নেই। এ পটভূমিতে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ কীভাবে সম্ভব, তা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।

এ ব্যাপারে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ও মশক বিশেষজ্ঞ ড. কবিরুল বাশার বলেন, ‘এ বছর ডেঙ্গু সারাদেশেই ছড়িয়ে পড়বে– এই শঙ্কা আমি আগেই করেছিলাম। হয়তো ইতোমধ্যে ছড়িয়েও গেছে, যা সরকারি হিসাবে নেই। কারণ আমাদের শুধু ঢাকার দিকেই নজর থাকে। অথচ জেলা-উপজেলা পর্যায়ে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে কোনো কাজ করা হয় না। জনবল-যন্ত্রপাতির কিছুই নেই। যা দু-একজন আছে, তাদের অভিজ্ঞতা নেই। ওষুধ নেই। তাহলে তারা কীভাবে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ করবে। এ জন্য স্থানীয় সরকার বিভাগের মাধ্যমে জনবল-যন্ত্রপাতি-প্রশিক্ষণ-ওষুধের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। তা না হলে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে।’

তিনি বলেন, কভিড টেস্টের সময় যেভাবে সরকারের কাছে মেসেজ চলে যেত, ডেঙ্গুর রিপোর্টিংটাও সেভাবে করতে হবে। তা না হলে সঠিক ডাটা পাওয়া যাবে না। সঠিক তথ্য না পেলে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণও করা যাবে না।

জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান ও মশক বিশেষজ্ঞ ড. মনজুর আহমেদ চৌধুরী বলেন, ২০১৯ সালে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তত্ত্বাবধানে একটি বিশেষজ্ঞ দল ডেঙ্গুর সংক্রমণ নিয়ে গবেষণা করে। ওই গবেষণায় দেখা যায়, সরকারি হিসাবে আক্রান্তের যে সংখ্যা পাওয়া যায়, প্রকৃত আক্রান্তের সংখ্যা এর ২০ গুণ।

ড. মনজুর আরও বলেন, হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীটিই স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যে আসে। যে রোগী পরীক্ষা করল, হাসপাতালে ভর্তি হলো না, তার তথ্য আসে না। করোনার হিসাব যতটা ভালোভাবে করা হয়েছিল, ডেঙ্গুর হিসাবটা সেভাবে করা হয় না। আমাদের মন্ত্রী-মেয়ররা বলেন, অন্যান্য দেশের চেয়ে বাংলাদেশে ডেঙ্গু রোগী কম। কথা হলো, সিঙ্গাপুরে ১০০ জন আক্রান্ত মানে সেখানে প্রকৃত রোগীর সংখ্যা ১০০ জনই। আর বাংলাদেশে ১০০ জন আক্রান্তের খবর যখন স্বাস্থ্য বিভাগ দেয়, তখন বুঝতে হবে বাস্তবে আক্রান্ত দুই হাজার। স্বাস্থ্য বিভাগের তথ্য সংগ্রহের পদ্ধতিটি সম্পূর্ণ ত্রুটিপূর্ণ। এই পদ্ধতিতে ডেঙ্গুর সঠিক তথ্য পাওয়া সম্ভব নয়। যে কারণে এখন সারাদেশেই ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়েছে। যে সাত জেলায় এখনও ডেঙ্গু রোগী পাওয়া যায়নি দাবি করা হচ্ছে, সেখানেও অনেকে জ্বরে আক্রান্ত হয়েছে। তাদের সবার পরীক্ষাও করা হয়নি। তাদের রিপোর্টও অধিদপ্তরের কাছে নেই।

ডেঙ্গুতে চলতি বছর এ পর্যন্ত আক্রান্ত হয়েছেন ১১ হাজার ১১৬ জন, মারা গেছেন ৬৪ জন।

অমিতোষ পাল

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.