শিক্ষার্থী ভর্তিতে অনিয়ম, পোষ্য কোটায় ভাইবোন

ইমরান হুসাইন, জবি

0
117

ইনকিয়াদ হক কবির মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকে জিপিএ৫ পেয়ে স্বপ্ন দেখেন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার। নিজেকে তৈরিও করেন সেভাবে। গুচ্ছভুক্ত ২২ বিশ্ববিদ্যালয়ে বিজ্ঞান বিভাগ থেকে পরীক্ষা দিয়ে পান ৪৭ দশমিক ৫ নম্বর। প্রাপ্ত নম্বর কম হওয়ায় আবেদন করেন দশটি বিশ্ববিদ্যালয়ে। এর মধ্যে কোনোটাতেই ভর্তির সুযোগ পাননি তিনি। বাধ্য হয়ে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়েই স্নাতকে ভর্তি হয়েছেন। তবে এই শিক্ষার্থীর অভিযোগ, তাঁর থেকে অনেক কম নম্বর পেয়েও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পেয়েছেন অন্যরা। তেমনি একটি ঘটনা ময়মনসিংহের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, কবিরের থেকে সাড়ে ৬ নম্বর কম অর্থাৎ ৪১ নম্বর পেয়েও এই বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর পরিকল্পনা বিভাগে ভর্তির সুযোগ পেয়েছেন ইসরাত জাহান তরফদার নামের এক শিক্ষার্থী। অন্যদিকে গুচ্ছের নির্দেশনা অনুযায়ী সব প্রক্রিয়া মেনেও ভর্তির সুযোগ পাননি কবির। তাঁর মতো একই ঘটনার শিকার আবু রায়হান। তিনি জিপিএ৫ না পেলেও মোট নম্বর পেয়েছেন ৫০ দশমিক ৭৫। নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পাওয়া ইশরাতের থেকে বেশি নম্বর পেয়েও অধরা রয়ে গেছে তাঁর স্বপ্ন। কম নম্বর পেয়ে ভর্তির সুযোগ পাওয়া ও বেশি নম্বর পেয়েও বঞ্চিত হওয়ার পেছনের আসল কারণ জানতে চান অনেকে।

ভর্তিবঞ্চিত শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, একই নিয়মে তুলনামূলক কম নম্বর পেয়েও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পাচ্ছেন অন্যরা। এ ছাড়া ভর্তির নির্দেশিকা, মাইগ্রেশন লিস্ট, গণবিজ্ঞপ্তিতে সুযোগ পাওয়া শিক্ষার্থীদের তালিকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে প্রকাশ না করেই পছন্দের শিক্ষার্থীদের খুদেবার্তার মাধ্যমে চূড়ান্ত করা হয়েছে। ফলে ভর্তি প্রক্রিয়াটি ঘরোয়াভাবে সম্পন্ন হয়েছে বলে দাবি করেন বঞ্চিতরা। তাঁদের দাবি, এসব ভর্তিতে শুধু অনিয়মই নয়, অর্থ লেনদেনও হয়েছে।

ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী ইনকিয়াদ হক কবির অভিযোগ করে বলেন, নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ে নীতিবহির্ভূত কাজ করেছে। কম নম্বর পেয়েও ভর্তি হয়েছে অনেকে। গণবিজ্ঞপ্তি পেয়ে উপস্থিত ছিলাম, কিন্তু আমাকে ভর্তি করা হয়নি। বেশি নম্বরপ্রাপ্ত আরও অনেকে বঞ্চিত হয়েছেন। গণবিজ্ঞপ্তি থেকে যাদের ভর্তি করা হয়েছে তাঁদের তালিকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়নি।

এ বিষয়ে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার ড. হুমায়ুন কবীর বলেন, শুধু স্কোর বেশি হলেই হয় না। প্রত্যেকটা বিভাগের নিজস্ব কিছু শর্ত থাকে। যাদের শর্ত পূর্ণ হয় তাদের কাছে অনলাইনে মেসেজ চলে যায়। সেই অনুযায়ী ভর্তি করা হয়।

এ সময় ভর্তির মাইগ্রেশনসহ সব বিজ্ঞপ্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে প্রকাশ ও গণবিজ্ঞপ্তির মেধাতালিকা প্রকাশ করা হয় কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটা তো প্রকাশ করার কথা। তবে বিশ্ববিদ্যালয়টির নগর পরিকল্পনা বিভাগে ভর্তির ক্ষেত্রে বিশেষ কোনো শর্ত ছিল না বলে জানান বিভাগীয় প্রধান রাকিবুল ইসলাম। তিনি বলেন, নগর পরিকল্পনা বিভাগে ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষে কোনো শর্ত ছিল না।

গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষা কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. ইমদাদুল হক বলেন, বেশি নম্বরধারীদের রেখে কম নম্বর পাওয়া শিক্ষার্থীদের ভর্তির কোনো সুযোগ নেই। এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ না করে শুধু খুদেবার্তার মাধ্যমে জানানো অবৈধ।

শূন্য আসন প্রকাশ ও ভর্তি করতে রিট

২০২১-২০২২ শিক্ষাবর্ষে গুচ্ছভুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শূন্য আসন পূরণ করে ২৮ ফেব্রুয়ারির মধ্যে সব বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি কার্যক্রম সম্পন্ন করতে নির্দেশ দেয় কেন্দ্রীয় কমিটি। এই সিদ্ধান্তে নিজেদের ভর্তি কার্যক্রম সম্পন্ন করতে সময় বাড়িয়ে নেয় বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়। তাদের সময় বাড়িয়ে করা হয় ১৫ মার্চ। গত ১৭ ফেব্রুয়ারি গুচ্ছভুক্ত ২২ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের সভায় এ সিদ্ধান্ত নেয় কমিটি। তবে এই সিদ্ধান্তও মানা হয়নি। শূন্য আসন খালি থাকা সাপেক্ষে গত ২০ মার্চ শিক্ষার্থীদের ভর্তি করে নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। এ ক্ষেত্রে অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শূন্য আসন প্রকাশ ও ভর্তি করতে উচ্চ আদালতের স্মরণাপন্ন হন শিক্ষার্থীরা। আদালত এক মাসের মধ্যে শূন্য আসন প্রকাশ করে ভর্তির নির্দেশ দিলেও তা আমলে নেয়নি গুচ্ছ কমিটি। গত ৬ মে এই আদেশের এক মাস পূর্ণ হয়। তবে গুচ্ছ কমিটির দাবি– আসন ফাঁকা নেই। আইনি প্রক্রিয়ায় এই জবাব দেওয়া হবে। কর্তৃপক্ষ বলছে, ভর্তি কার্যক্রম শেষে কেউ যদি অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে যায় তবে নতুন করে আর ভর্তি নেওয়া হবে না। এ ক্ষেত্রে আদালতের আদেশ অমান্য হয়েছে বলে দাবি করেন শিক্ষার্থীসহ আইনজ্ঞরা।
এ বিষয়ে গুচ্ছ ভর্তি কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক বলেন, আইনি প্রক্রিয়ায় এর জবাব দেওয়া হয়েছে।

পোষ্য কোটার বিকৃতি ও অকৃতকার্যদের ভর্তি

পোষ্য কোটায় সন্তান সুযোগ পাওয়ার কথা থাকলেও এ কোটার নামে ভাইবোনকে ভর্তি করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। গত ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষের ভর্তি পরীক্ষায় গোপালগঞ্জের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে এই ঘটনা ঘটেছে। এই কোটায় কমপক্ষে ১৫ জনকে ভর্তি করা হয়েছে। এরা সবাই কম নম্বরধারী ও অকৃতকার্য।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২৯.৫ নম্বর পেয়ে ফেল করা জাকারিয়া হোসেন ভর্তি হয়েছেন ইতিহাস বিভাগে। ভর্তির তথ্য মতে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক অনুষদভুক্ত অর্থনীতি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক জুবাইদুর রহমানের ভাই। বিষয়টি স্বীকার করেছেন ওই শিক্ষক ও ছাত্র। জাকারিয়া হোসেন বলেন, আমি সরাসরি ভাইভা দিয়ে ভর্তি হয়েছিলাম। আর কিছু জানি না।

এ বিষয়ে শিক্ষক জুবাইদুর রহমান বলেন, জাকারিয়া আমার ছোট ভাই। পাস মার্ক কত, কীভাবে ভর্তি করল বিশ্ববিদ্যালয় এটা ভর্তি কমিটি জানে। এ সময় পোষ্য কোটায় ভাইবোন অন্তর্ভুক্ত হয় কিনা জানতে চাইলে তিনি কমিটির ওপর দায় চাপিয়ে বলেন, এখানে আমার কোনো হাত নেই। পোষ্য কোটায় আবেদন করেছিলাম তারপর ভর্তি হয়েছে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি কমিটির সদস্য ও কলা অনুষদের ডিন ভূইয়ান আশিক বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে পোষ্য কোটার নিয়ম হলো নিজ সন্তান ও স্বামী-স্ত্রী। এর বাইরে আর কারও সুযোগ নেই। তবে এবার আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইবোন কোটা আলোচনায় এসেছে। নিয়মের বাইরে কিছুই হবে না বলে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন তিনি।

ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষের ভর্তি ফলাফল কমিটির সভাপতি শাহাজাহান বলেন, আমরা পোষ্য কোটায় মোট ১৫ জনকে ভর্তি নিয়েছি। পোষ্য কোটায় অকৃতকার্য ও ভাইবোনদের ভর্তির বিষয়ে তিনি বলেন, একজন ২৯.৭৫ পেয়েছিল। তাকে ভর্তি করা হয়েছে। ভর্তি কমিটির অনুমোদনেই এসব সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

এসব অনিয়মের বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার মো. দলিলুর রহমানকে একাধিকবার ফোন দেওয়া হলেও তিনি কথা বলতে রাজি হননি। সব বিষয়েই তিনি উপাচার্যকে দেখিয়ে দেন।

তবে পোষ্য কোটায় অনিয়ম ও অকৃতকার্যকে ভর্তির বিষয়টি সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট সবাই মুখ খুললেও এসব সম্পূর্ণ মিথ্যা বলে দাবি করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. একিউএম মাহবুব। তিনি বলেন, কোনো অনিয়ম হয়নি। অকৃতকার্যদেরও ভর্তি করা হয়নি।

এ বিষয়ে গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষা কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক অধ্যাপক ড. ইমদাদুল হক বলেন, গুচ্ছে পাস নম্বর ৩০ নির্ধারণ করা হয়। অকৃতকার্যদের ভর্তির সুযোগ নেই। পোষ্য কোটায় ভাইবোনদের কোনো স্থান নেই।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.