রোজিনার বিরুদ্ধে মামলা, না অন্তহীন হয়রানি

0
122
১৭ মে রোজিনার বিরুদ্ধে আনা মামলার দুই বছর পূর্ণ হয়েছে।

মামলার নামে বিশেষ প্রতিনিধি রোজিনা ইসলামের ওপর হয়রানি ও মানসিক পীড়ন অব্যাহত থাকাটা কেবল অস্বাভাবিক নয়, মুক্ত সাংবাদিকতারও পরিপন্থী।

২০২১ সালের ১৭ মে পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে রোজিনা ইসলাম হেনস্তা ও নির্যাতনের শিকার হন। একই দিন রাত সাড়ে আটটার দিকে তাঁকে শাহবাগ থানার পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়। রাত পৌনে ১২টার দিকে তাঁর বিরুদ্ধে থানায় মামলা করা হয়। ১৭ মে রোজিনার বিরুদ্ধে আনা মামলার দুই বছর পূর্ণ হয়েছে।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব শিব্বির আহমেদ ওসমানী এজাহারে যেসব অভিযোগ এনেছেন, তা পুরোপুরি ভিত্তিহীন, যেটা পুলিশের তদন্তে প্রমাণিত। রোজিনার বিরুদ্ধে ঔপনিবেশিক আমলের ১৯২৩ সালের অফিশিয়াল সিক্রেটস আইনের অধীনে মামলা করা হয়েছে। আইনটির একটি ইতিহাস আছে।

ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক সরকার এ দেশের মানুষকে সন্দেহ করত যে তাঁরা সরকারের তথ্য-উপাত্ত শত্রুদেশের কাছে পাচার করে দিচ্ছেন। এটি যাতে না করতে পারেন, সে জন্য অফিশিয়াল সিক্রেসি আইন করে। স্বাধীন বাংলাদেশে সেই আইন চলতে পারে না। বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত দ্বিতীয় কোনো সাংবাদিকের বিরুদ্ধে এই আইনে মামলার নজির নেই।

ব্রিটিশ শাসকেরা ছিলেন বিদেশি। তাঁরা এ দেশের মানুষকে শত্রু মনে করতেন। কিন্তু সেই ঔপনিবেশিক আমলের আইন বাংলাদেশের নাগরিক, তথা সাংবাদিকের বিরুদ্ধে ব্যবহার করার যৌক্তিকতা কী

মামলাটি তদন্তের দায়িত্ব ছিল ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা সংস্থার (ডিবি)। গত জুলাই মাসে তারা চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়েছে। চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়ার অর্থ হলো, রোজিনা ইসলামের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের সপক্ষে কোনো উপাদান পাওয়া যায়নি। এর প্রায় ছয় মাস পর বাদী স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব আদালতে হাজির হয়ে বলেন, তিনি নারাজি দেবেন।

রোজিনা ইসলামের বিরুদ্ধে করা মামলায় পুলিশের চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়ায় সাধুবাদ জানিয়েছিল বার্লিনভিত্তিক টিআই ও যুক্তরাজ্যভিত্তিক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন আর্টিকেল নাইনটিনসহ অনেক আন্তর্জাতিক সংগঠন। গত জানুয়ারিতে ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালতের অ্যাডিশনাল চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (এসিএমএম) মামলাটি অধিকতর তদন্তের জন্য পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনকে (পিবিআই) নির্দেশ দেন। সেই নির্দেশের পরও কয়েক মাস চলে গেছে।

মামলা করলেন সরকারের লোক, তদন্ত করল সরকারি সংস্থা। এরপরও সেই তদন্ত নিয়ে প্রশ্ন করা কিংবা নারাজি দেওয়ার অর্থ, অভিযুক্ত সাংবাদিককে হয়রানি করা, পেশাগত দায়িত্ব পালনে তাঁকে বাধাগ্রস্ত করা। উল্লেখ্য, আদালতের নির্দেশে রোজিনার পাসপোর্ট জব্দ করা হলেও তিনি এর আগে (আদালত) অনুমতি নিয়ে তিনবার বিদেশে গিয়েছেন এবং ফিরে এসে পাসপোর্টও যথারীতি জমা দিয়েছেন। তাঁর অ্যাক্রেডিটেশন কার্ডের মেয়াদ শেষ হওয়ায় নতুন করে আবেদন করলেও এখন পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে সাড়া পাওয়া যায়নি। অ্যাক্রেডিটেশন কার্ড ছাড়া একজন অনুসন্ধানী সাংবাদিক কীভাবে পেশাগত দায়িত্ব পালন করবেন?

২০২১ সালে যখন রোজিনা ইসলামের বিরুদ্ধে মামলাটি করা হয়, তখন দেশের সাংবাদিকেরা জোরালো প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। সাংবাদিক সংগঠনগুলো আন্দোলন করেছিল। এগিয়ে এসেছিল বিদেশের অনেক সাংবাদিক সংগঠন ও মানবাধিকার সংস্থাও। রোজিনার বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলা প্রত্যাহারে সরকারের প্রতি অনুরোধ জানিয়েছেন জাতিসংঘের চার বিশেষজ্ঞসহ ইন্টারন্যাশনাল প্রেস ইনস্টিটিউট। কাজের স্বীকৃতি হিসেবে ‘সেরা অদম্য সাহসী হিসেবে ২০২১ সালে তিনি পেয়েছেন ফ্রি প্রেস অ্যাওয়ার্ড ও ২০২২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অ্যান্টিকরাপশনস চ্যাম্পিয়নস অ্যাওয়ার্ড। গত জানুয়ারিতে মামলাটি অধিকতর তদন্তের নির্দেশ দেওয়া হলে সিপিজে, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালসহ অনেক সংগঠন উদ্বেগ ও হতাশা প্রকাশ করেছিল। এই উদ্বেগ বাংলাদেশের সাংবাদিক সমাজেরও।

ব্রিটিশ শাসকেরা ছিলেন বিদেশি। তাঁরা এ দেশের মানুষকে শত্রু মনে করতেন। কিন্তু সেই ঔপনিবেশিক আমলের আইন বাংলাদেশের নাগরিক, তথা সাংবাদিকের বিরুদ্ধে ব্যবহার করার যৌক্তিকতা কী। এখানে ভারতের উদাহরণটি টানা নিশ্চয়ই অপ্রাসঙ্গিক হবে না। একই আইনে সাংবাদিক শান্তনু সাইকার বিরুদ্ধে আনা সিবিআইয়ের (সেন্ট্রাল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন) করা মামলাটি খারিজ করে দেন দিল্লির অতিরিক্ত সেশন জজ ইন্দ্রজিৎ সিং।

এতে মন্ত্রিসভার বৈঠকের জন্য ডিসইনভেস্টমেন্ট-সংক্রান্ত যে নোট বা কার্যবিবরণী তৈরি করা হয়েছিল, বৈঠকের আগেই তিনি প্রকাশ করেছিলেন। আদালত মন্তব্য করেন, গোপনীয় তথ্য হওয়া সত্ত্বেও মন্ত্রিসভার বৈঠকের খবর গণমাধ্যমে আসা বিরল নয়। সরকারি কোড বা পাসওয়ার্ড—যা অত্যন্ত গোপনীয়, প্রকাশিত হলে এই আইনে মামলা হতে পারে। আদালতের রায়ে আরও বলা হয়, মন্ত্রিসভার বিবরণী প্রকাশ এ ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। ডিসইনভেস্টমেন্ট-সংক্রান্ত দলিল প্রকাশ করলে ভারতের সার্বভৌমত্ব ও অখণ্ডতার, কিংবা রাষ্ট্র ও বিদেশের সঙ্গে বন্ধুত্বে কোনো প্রভাব পড়বে না। (সূত্র: টাইমস অব ইন্ডিয়া)

ভারতের সাংবাদিক মন্ত্রিসভার নোট আগাম ছেপে দিয়েছিলেন, এর বিরুদ্ধে করা মামলাও আদালতে টেকেনি। রোজিনা ইসলাম তো কোনো তথ্য প্রকাশ করেননি। শুধু তথ্য সংগ্রহের জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে গিয়েছিলেন। এরপরও দুই বছরের বেশি সময় ধরে তিনি হয়রানি ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন।

সম্প্রতি অপরাধ রিপোর্টিং বিভাগের প্রধান রোজিনা ইসলাম একটি প্রতিবেদন করেছেন বিএনপির নেতা সালাহউদ্দিন আহমদের ট্রাভেল পাস নিয়ে; যিনি ২০১৫ সাল থেকে ভারতে আছেন কথিত অনুপ্রবেশের দায়ে। সম্প্রতি সালাহউদ্দিন আইনি লড়াইয়ে জয়ী হওয়ার পর ভারত ত্যাগের ক্ষেত্রে কোনো বাধা থাকল না।

কিন্তু তাঁর কাছে বাংলাদেশের বৈধ কাগজপত্র (পাসপোর্ট, ভিসা) না থাকায় বাংলাদেশে আসতে পারছিলেন না। এসব ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট দেশে দায়িত্বরত বাংলাদেশ হাইকমিশনই সিদ্ধান্ত দিতে পারে।

কিন্তু দিল্লিতে অবস্থিত আমাদের হাইকমিশন বোধগম্য কারণেই নিজ থেকে সিদ্ধান্ত না দিয়ে সরকারের মতামত চায়। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় মতামতের জন্য পাঠায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। এই প্রেক্ষাপটে সালাহউদ্দিন আহমদ ভ্রমণ অনুমোদন বা ট্রাভেল পাসও পেয়ে গেছেন। ফলে তাঁর দেশে ফেরার কোনো বাধাই থাকল না।

বিএনপির নেতার ট্রাভেল পাসের খবরটি অবশ্যই আনন্দের। কিন্তু যেই অনুসন্ধানী সাংবাদিক খবরটি দেশবাসীর কাছে পৌঁছে দিয়েছেন, তাঁর ‘ট্রাভেল পাস’ অর্থাৎ পাসপোর্ট আটকা পড়ে আছে। দেশের বাইরে যাওয়ার অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন তিনি।

  • সোহরাব হাসান যুগ্ম সম্পাদক ও কবি

    sohrabhassan55@gmail.com

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.