রাশিয়া–ভারত–চীন ত্রিভুজে প্রাণশক্তি জোগাচ্ছে রাশিয়া

0
84
এসসিও সামিটে তিন দেশের প্রধান

বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় দুটি দেশের মধ্যকার কূটনৈতিক সম্পর্ক নানা চড়াই–উতরাইয়ের মধ্য দিয়ে যায়। সময় যত গড়ায়, ততই দেখা যায় একে অপরের ওপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করে কিংবা নিজ স্বার্থে অপরকে নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। কিন্তু চলমান বৈশ্বিক সংকটেও রাশিয়ানদের সঙ্গে ভারতীয়দের সম্পর্ক দেখে একটা বিষয় স্পষ্ট যে দুই দেশের মধ্যকার সমতার সম্পর্ক সেই ফাঁদে পড়েনি

গত সপ্তাহে দিল্লিতে অনুষ্ঠিত রাশিয়া–ভারত বিজনেস ফোরামের বৈঠকে বক্তব্য দেওয়ার সময় ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জয়শঙ্কর দুই দেশের সম্পর্কের সাবলীল এই বৈশিষ্ট্যটি তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ভারত–রাশিয়া সম্পর্ক বিশ্বের সবচেয়ে স্থিতিশীল সম্পর্ক। সম্পর্ক পরিবর্তনের কারণে নয়, বরং সম্পর্ক পরিবর্তন হয়নি বলেই দুই দেশের অংশীদারত্ব বিশ্বে এত বেশি মনোযোগ পাচ্ছে।

ভারতীয় গণমাধ্যম, থিঙ্কট্যাংক ও বুদ্ধিজীবীদের ‘উদারপন্থী আন্তর্জাতিকতাবাদী’ অংশ ইউক্রেন সংকট নিয়ে ভারতের অবস্থান নিয়ে সমালোচনামুখর হয়েছে। দেরিতে হলেও তাঁরা বুঝতে পারছেন যে পশ্চিম ও রাশিয়ার মধ্যে বড় সংঘাত সৃষ্টি হতে পারে, এ ধরনের একটি ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থান থেকেই ভারত এ অবস্থান নিয়েছে।

ওয়াশিংটনের দিক থেকেও এখন সব লক্ষণ দেখা যাচ্ছে যে পশ্চিমাদের প্রতি মোদি সরকারের দ্ব্যর্থহীন যে বার্তা, সেটি তারা মেনে নিচ্ছে। সেই বার্তা হলো, ভারত রাশিয়ার সঙ্গে তার নিজের স্বার্থেই সম্পর্ক বজায় রাখবে এবং যে পথেই সেই স্বার্থ নিহিত থাকবে, সেই পথেই দিল্লি হাঁটবে।

রাশিয়া–ভারত বাণিজ্য প্রতিনিধিদলের সম্মেলন নিয়ে ভয়েস অব আমেরিকা যে ভাষ্যটি দিয়েছে, সেটা উল্লেখযোগ্য। গণমাধ্যমটি বলেছে, ‘ভারত ও রাশিয়া মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির বিষয়েও কথা বলেছে…মস্কো এখন ভারতের সবচেয়ে বড় অপরিশোধিত তেল সরবরাহকারী দেশে পরিণত হয়েছে…। যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে মস্কোর ওপর আরোপ করা পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞায় শামিল হয়নি ভারত, ইউক্রেনে আগ্রাসনের জন্য রাশিয়াকে সরাসরি দোষারোপও করেনি দেশটি। কিন্তু দিল্লি এ সংকটের একটি মীমাংসিত সমাধানের আহ্বান জানিয়েছে। পশ্চিমারা ভারতকে রাশিয়া থেকে পর্যায়ক্রমে দূরত্ব সৃষ্টির আহ্বান জানানো সত্ত্বেও মস্কোর সঙ্গে দিল্লি অর্থনৈতিক সম্পর্ক গভীর করেছে।

এমনকি গত দুই দশকে যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিমা অন্য দেশগুলোর সঙ্গে ভারত কৌশলগত অংশীদারত্ব গড়ে তুললেও মস্কোর সঙ্গে দিল্লি ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রেখে চলেছে।

ইউক্রেন যুদ্ধকে কেন্দ্র করে পশ্চিমা দেশগুলো চাইছে রাশিয়া থেকে ভারতের আমদানিনির্ভরতা কমাতে, যাতে মস্কোকে একঘরে করে ফেলা যায়। কিন্তু রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখার ক্ষেত্রে নয়াদিল্লি এখনো দৃঢ় অবস্থান বজায় রেখে চলেছে।

এই উদ্ধৃতি যে বিষয়টি স্বীকার করে নিচ্ছে, তা হচ্ছে ভারত এই সংকেতও দিতে চাইছে যে এই দৃষ্টান্তকে জিরো–সাম গেম হিসেবে বিবেচনা করার প্রয়োজনীয়তা নেই এবং ওয়াশিংটন এই বিষয়টি গ্রহণ করছে যে ভয় দেখিয়ে ভারতকে তারা অধীন করে রাখতে পারবে না।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন আগামী জুন মাসে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে হোয়াইট হাউসে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। এরপর সেপ্টেম্বর মাসে নয়াদিল্লিতে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া জি–২০ সম্মেলনে অংশ নেবেন বাইডেন। এই দুটি ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্রের জন্য একটি পরীক্ষা। রাশিয়ার সঙ্গে ভারতের যে বলিষ্ঠ কূটনৈতিক সম্পর্ক, সেখান থেকে কোন সৃষ্টিশীল পদক্ষেপ দিয়ে দিল্লিকে বের করে আনা যায়, সেটাই বাইডেন প্রশাসনের জন্য চ্যালেঞ্জ।

রাশিয়া–ভারত সম্পর্কে বাস্তবে কোনো বিতর্ক নেই। যদিও ভারতের কিছু বিশ্লেষক যুক্তরাষ্ট্রের প্রোপাগান্ডায় তোতা পাখির মতো কণ্ঠ মিলিয়ে বলছে, রাশিয়া এখন চীনের ‘কনিষ্ঠ সহযোগীতে’ পরিণত হয়েছে। এ ধরনের প্রোপাগান্ডা রাশিয়া–ভারত পারস্পরিক আস্থা ক্ষতিগ্রস্ত করে।

বাইডেন প্রশাসনের জন্য বাস্তব চ্যালেঞ্জ আরও বড়। ভারতের প্রেক্ষাপট থেকে দেখলে সেটাকে বলা যায়, নরেন্দ্র মোদি আগামী ২৫ বছরের মধ্যে ভারতকে উন্নত বিশ্বে পরিণত করার রূপরেখা ঘোষণা করছেন। ১ মে কেরালার কোচিতে বক্তৃতাকালে তিনি এ ঘোষণা দেন।

এটি নিশ্চিত যে উন্নয়ন প্রশ্নে ভারতের প্রত্যাশার পারদ চড়ছেই। আর দিল্লি যুক্তরাষ্ট্রের বৈশ্বিক কৌশলনীতির নিছক প্রান্তিক দেশ হয়ে থাকতে রাজি নয়। যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা ইন্দো–প্যাসিফিক অঞ্চলে ভারতকে ভারসাম্য রক্ষাকারী দেশ বলে বিবেচনা করে, কিন্তু নয়াদিল্লির আরও বড় পরিকল্পনা রয়েছে।

রাশিয়া–ভারত বিজনেস ফোরামের বৈঠকে জয়শঙ্কর তাঁর বক্তৃতায় রাশিয়াতে ভারতের রপ্তানি বাড়ানোর ওপর জোর দেন। অন্যদিকে রাশিয়ার প্রতিনিধিদলের প্রধান উপপ্রধানমন্ত্রী ডেনিস ম্যানটুরেভ ভারতের সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির জন্য আলোচনা জোরদার এবং বিনিয়োগ সুরক্ষা চুক্তি করার ওপর জোর দেন।

ভারত–রাশিয়া দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ৪৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ছাড়িয়ে গেছে। পশ্চিমা বিশ্ব থেকে বাণিজ্য সরিয়ে এশিয়ার দিকে রাশিয়া যদি না ঘুরত, তাহলে এটা একটা অকল্পনীয় ব্যাপার হয়ে থাকত। কোভিড–পরবর্তী অর্থনীতি পুনরুদ্ধার এবং মূল্যস্ফীতির কারণে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের অর্থনীতি মন্দার দিকে হেলে পড়ার পরিস্থিতিতে ভারত সরকার খুব দ্রুত সুযোগটা গ্রহণ করে। ভারতের সামনে এখন একটি সুবর্ণ সুযোগ এসেছে সার্বিয়া ও রাশিয়ার দূরবর্তী পূর্বাঞ্চলের বিশাল প্রাকৃতিক সম্পদের সুবিধা গ্রহণের। ভারত তার উন্নয়নের যে গতিপথ ঠিক করেছে, তা বাস্তবায়নে রাশিয়ার সম্পদের ওপর ভিত্তি করে দেশে শিল্পায়ন গড়ে তোলার বড় সুযোগ এসেছে।

রাশিয়া–ভারত সম্পর্কে বাস্তবে কোনো বিতর্ক নেই। যদিও ভারতের কিছু বিশ্লেষক যুক্তরাষ্ট্রের প্রোপাগান্ডায় তোতা পাখির মতো কণ্ঠ মিলিয়ে বলছে, রাশিয়া এখন চীনের ‘কনিষ্ঠ সহযোগীতে’ পরিণত হয়েছে। এ ধরনের প্রোপাগান্ডা রাশিয়া–ভারত পারস্পরিক আস্থা ক্ষতিগ্রস্ত করে।

এই ধরনের চিন্তার ত্রুটিপূর্ণ। তাঁরা এই বাস্তবতাকে এড়িয়ে যাচ্ছেন যে রাশিয়া ও চীন সভ্যতা জন্ম দেওয়া রাষ্ট্র। দুর্দশার ইতিহাস সঙ্গে নিয়ে তারা প্রতিবেশী রাষ্ট্র। এটি আনুষ্ঠানিক জোটে সদস্য রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে হায়ারর্কিক্যাল বা উচ্চক্রম থেকে নিম্নক্রমের সম্পর্ক থাকে সে ধরনের সম্পর্ক চীন ও রাশিয়ার মধ্যে হওয়ার কোনো সুযোগ নেই।

রাশিয়া–ভারত–চীন এই ত্রিভুজে প্রাণশক্তি সঞ্চারিত করার ক্ষেত্রে রাশিয়া চীন ও ভারত– দুই দেশের সঙ্গেই দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক বাড়াচ্ছে ও গভীর করছে। আর ভারতে মোদি সরকার এমন একটি ‘বি–আদর্শায়িত’ পররাষ্ট্র নীতি অনুসরণ করেছে যাতে জাতীয় স্বার্থ জোরদার করা যায়।

এম কে ভদ্রকুমার ভারতের সাবেক কূটনীতিক

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.