যে ইনিংসে ইনজামামকে চিনেছিল ক্রিকেট বিশ্ব

0
102
১৯৯২ বিশ্বকাপ সেমিফাইনালে সেই ইনিংস খেলার সময়

অস্থিরতা, উদ্বেগ, চাপ—এসব মানসিক অবস্থাও অনেক সময় শারীরিক উপসর্গ হয়ে প্রকাশিত হয়। ইনজামামের ‘অবস্থা খারাপ’–এর পেছনেও এসবের ভূমিকা আছে বলেই অনুমান করেছিলেন ইমরান। সেই অনুমান হয়তো সঠিকই ছিল। নইলে ইনজামাম পরদিন অমন একটা ইনিংস কীভাবে খেলেন? ৩৭ বলে ৬০ রানের যে ইনিংসে বিশ্ব ক্রিকেটে ইনজামামের সদর্প আবির্ভাবের ঘোষণা। পাকিস্তানের সর্বকালের সেরা ব্যাটসম্যান হিসেবে জাভেদ মিয়াঁদাদের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠার পথে যাত্রা শুরু।

সেই ইনিংসে যাওয়ার আগে একটা বড় প্রশ্নের উত্তর দিয়ে নেওয়া জরুরি বলে মনে হচ্ছে। বিশ্বকাপ সেমিফাইনালের মতো একটা ম্যাচ, যেটিতে খেলা সব ক্রিকেটারের স্বপ্ন, সেটি কেন খেলতে চাননি ইনজামাম? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাওয়া যাবে কিছু সংখ্যায়—২৭, ১৪, ০, ২, ৪৮, ১৬, ১১ ও ৫।

১৯৯২ বিশ্বকাপে নিজের জাত চিনিয়েছিলেন ইনজামাম

১৯৯২ বিশ্বকাপে নিজের জাত চিনিয়েছিলেন ইনজামাম

এসব কী? সেমিফাইনালের আগে ১৯৯২ বিশ্বকাপের আট ম্যাচে ইনজামামের স্কোর। যে ৪৮–টা দেখছেন, সেটি দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে। ৪৪ বলের ওই একটা ইনিংসেই যা একটু ইনজামাম–ঝলক। যদিও ইনজামামের ব্যাটিংয়ের চেয়ে সমাপ্তির কারণেই যা বেশি স্মরণীয় হয়ে আছে। পয়েন্টে বল ধরে দৌড় দেওয়ার পর শরীরটাকে মাটির সমান্তরালে ভাসিয়ে উড়ন্ত জন্টি রোডসের স্টাম্প ভেঙে দেওয়ার ওই দৃশ্যটা ক্রিকেটের অমর ছবিগুলোরই একটি। ইনজামাম মাত্রই নিজেকে চেনাতে শুরু করেছিলেন, উল্টো ওই রানআউটে নিজেকে চিনিয়ে রাতারাতি মহাতারকা জন্টি রোডস।

ওই ৪৮–এর আগের চার ইনিংসে ৪৩, পরের তিন ইনিংসে ৩২—ইনজামামের তখন এমন অবস্থা যে বিশ্বকাপটা শেষ হলে যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচেন। অধিনায়কের অগাধ আস্থা তাঁর ওপর। শুরুতেই বলে দিয়েছেন, ইনজি সব ম্যাচ খেলবে। সেই আস্থার প্রতিদান দিতে না পারার যন্ত্রণা আর নিতে পারছিলেন না ইনজামাম। যা থেকে মুক্তির পথও বের করে নিয়েছিলেন নিজেই। ইমরান যা মেনে নিলে পাকিস্তানের আর রূপকথা লেখা হয় না।

খাদের কিনারা থেকে ঘুরে দাঁড়িয়ে পাকিস্তানের ১৯৯২ বিশ্বকাপ জয় রূপকথাসম এক গল্প। অকল্যান্ডে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে সেমিফাইনালে জয়টাও কি তা–ই নয়! প্রথমে ব্যাটিং করে স্বাগতিক নিউজিল্যান্ড করেছিল ৭ উইকেটে ২৬২। টি–টোয়েন্টি অধ্যুষিত বর্তমান ক্রিকেটে এটা কোনো রানই নয়। কিন্তু তখন তা রীতিমতো ছোটখাটো এক রানপাহাড়। এর আগে বিশ্বকাপে এর চেয়ে বেশি রান তাড়া করে জয়ের ঘটনা ছিল মাত্র ৩টি। সেই তিনটির দুটি ৬০ ওভারের ম্যাচে, অন্যটি সে সময়কার সহযোগী সদস্যদেশ জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে। সঙ্গে এটাও মনে হয় উল্লেখ করা প্রয়োজন, এর কোনোটিই নকআউট ম্যাচের ‘মারো নয় মরো’ পরিস্থিতিতে নয়।

এটাতেও আসলে ইনজামামের সেই ইনিংসের মহিমা পুরোপুরি বোঝা যাচ্ছে না। পাঁচ বলের মধ্যে ইমরান খান ও সেলিম মালিক আউট হয়ে যাওয়ার পর যখন ব্যাটিং করতে নেমেছেন, নিউজিল্যান্ড তখন মনশ্চক্ষে মেলবোর্নের ফাইনাল দেখছে। ৯৫ বলে পাকিস্তানের দরকার ১২৩ রান। আস্কিং রেট ৮ ছুঁই ছুঁই। এটা লিখেই মনে হলো, ‘এই সময় আর সেই সময়’–এর পার্থক্যটা আবার মনে করিয়ে দেওয়া জরুরি।

আধুনিক ক্রিকেটে শেষ ১৫–১৬ ওভারে এই আস্কিং রেট ব্যাটসম্যানদের কপালে কোনো ভাঁজই ফেলে না। কিন্তু সেই সময়ে এটা ছিল প্রায় অসম্ভবের নামান্তর। কালেভদ্রেই তা হতো।

ফাইনালে ইংল্যান্ডকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়নও হয় পাকিস্তান

ফাইনালে ইংল্যান্ডকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়নও হয় পাকিস্তান

হ্যালির ধূমকেতুর মতো এত দীর্ঘ বিরতি না পড়লেও ১৬২.১৬ স্ট্রাইক রেটের ইনিংসও তখন একটু বিরলদৃষ্টই ছিল। এমন ঝোড়ো ইনিংস, কিন্তু তা শুধুই ধুমধাড়াক্কা মারের প্রদর্শনী ছিল না। ইনজামামের ব্যাটিংয়ের সবচেয়ে বড় অলংকার যে অলস সৌন্দর্য, এই ইনিংসটাও তার প্রতিচ্ছবি। দারুণ টাইমিং আর গ্যাপ খুঁজে নেওয়ার প্রায় অতীন্দ্রিয় ক্ষমতার সাক্ষীও। স্ট্রোকের ছটায় নিউজিল্যান্ডকে হতবিহ্বল করে দিয়ে যখন ওই বিশ্বকাপে চতুর্থবারের মতো রানআউট হয়ে গেলেন, জয় অনেকটাই পাকিস্তানের দৃষ্টিসীমায়। ৩২ বলে চাই ৩৬ রান—ইনজামামে উজ্জীবিত মঈন খানের ১১ বলে ২০ রানের ক্যামিওতে ১ ওভার বাকি থাকতেই যা হয়ে যায়।

বিশ্বকাপ সেমিফাইনালে অমন একটা ইনিংস—ইনজামামের সাড়ম্বর আবির্ভাব হিসেবে সবাই তাই এই ইনিংসটার কথাই বলে। মাস দুয়েক আগে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে পরপর দুই ওয়ানডেতে যে সেঞ্চুরি করে রেখেছেন, এটা অনেকের মনেই থাকে না। ওই দুই সেঞ্চুরির আগের তিনটি ওয়ানডে ইনিংসও তো বলার মতোই। যার দুটিই অকল্যান্ড সেমিফাইনালের মতো ৬০, অন্যটি ৪৮। তারপরও ঘটনা তো এটাই যে, ইনজামামের ইনজামাম হওয়ার সূচনা ৩৭ বলে ৬০ রানের ওই ইনিংস দিয়েই।

যে ইনিংসের আগে–পরের দুটি ঘটনা দিয়ে লেখাটা শেষ করি। ইনজামামের মুখেই যা শোনা। ইনিংস শেষে ড্রেসিংরুমে ফিরেছেন। ম্যাসাজ টেবিল থেকে উঠে দাঁড়ালেন ইমরান খান। ইনজামাম ভাবলেন, ম্যাচ শেষ করে না আসায় নিশ্চয়ই বকাঝকা করবেন। উল্টো ইমরান জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘ভেরি ওয়েল প্লেড’। অভিভূত ইনজামাম চোখের জল সামলাতে গিয়ে অধিনায়ককে ধন্যবাদ দিতেও ভুলে যান।

এবার ম্যাচের দুদিন আগে ফিরে যাই। এখানেও কেন্দ্রীয় চরিত্র যথারীতি ইমরান খান। সেমিফাইনাল খেলতে ক্রাইস্টচার্চ থেকে অকল্যান্ডে আসছে পাকিস্তান দল।

১৯৯২ বিশ্বকাপ সেমিফাইনালে যে ব্যাট দিয়ে খেলেছিলেন ইনজামাম

১৯৯২ বিশ্বকাপ সেমিফাইনালে যে ব্যাট দিয়ে খেলেছিলেন ইনজামাম

এয়ারপোর্টে এসে ইনজামাম জানলেন, ইমরান খান পাশের আসনটা রেখে দিয়েছেন তাঁর জন্য। ইনজামাম প্রমাদ গুনলেন, অধিনায়ক তাঁকে পাশে বসাচ্ছেন কেন? যে বাজে খেলছেন, নিশ্চয়ই কড়া কড়া কিছু কথা শোনাতেই। বিমানে ঠিকঠাকমতো বসার পর ইমরান বললেন, ‘গত ম্যাচে তুমি যে বাউন্ডারিটা মেরেছ, তা ছিল ম্যাচের সেরা শট। আমার মনে হয়, তুমি ফর্মে ফিরে এসেছ।’

‘গত ম্যাচ’ মানে ক্রাইস্টচার্চে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে শেষ গ্রুপ ম্যাচ। যে ম্যাচে নিউজিল্যান্ডকে ওই বিশ্বকাপে প্রথম পরাজয়ের স্বাদ দিয়েছে পাকিস্তান। সেই ম্যাচে ইনজামাম বাউন্ডারি একটা মেরেছিলেন বটে, তবে রান কত করেছিলেন, জানেন? মাত্র ৫!

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.