যারা বৃষ্টিতে ভিজেছিল, আমরা সে দলে নেই

0
198
গাড়ির কাচের এপাশ থেকে বৃষ্টিস্নাত শহর

ছুটির দিনে আকাশ খানিকটা ফুটো হলো, বহু প্রত্যাশিত বৃষ্টি হলো আজ। তবে ঢাকা মহানগরের খোপবন্দী মানুষ কি পেয়েছে সেই বৃষ্টির ছোঁয়া? নগরে বেড়ে ওঠা মানুষের বর্ষাযাপনের গল্প…

ছেলেবেলার ‘ঝরো ঝরো বাদরদিনগুলি’ আমার জন্য মুখর হয়ে আসেনি কোনো দিন। এসেছিল মৌন ব্যথা নিয়ে। না, না, বৃষ্টি দেখে বিরহিণী কান্তা সাজার রোমান্টিক ব্যথা সে নয়। আদতে সেই বয়সই হয়নি তখনো। এ ব্যথা ছিল বঞ্চনার। কারণ, বৃষ্টির জলে ভিজতে ভিজতে বর্ষাযাপন ছিল দূরবর্তী স্বপ্নগুলোর একটি।

বর্ষামঙ্গলের বদলে অমঙ্গলের শঙ্কায় অতি সাবধানী, অতি বেরসিক মা আমাদের আটকে ফেলতেন শোবার ঘরে। ভীষণ ঠান্ডার ধাত কি না, জানালা গলে বৃষ্টির জলে হাত ভেজানোও বারণ ছিল খুব!

অতএব চোখের জলই সই! সে জলে গাল-গলা-মন ভিজত, যখন দোতলা থেকে কপাটবন্ধ জানালার কাচে মাথা ঠেকিয়ে ঠিক নাক বরাবর নিচের উঠানে শান্তাকে ঘুরে ঘুরে, বৃষ্টির দাদরা তালে নাচতে দেখতাম।

অতএব চোখের জলই সই! সে জলে গাল-গলা-মন ভিজত, যখন দোতলা থেকে কপাটবন্ধ জানালার কাচে মাথা ঠেকিয়ে ঠিক নাক বরাবর নিচের উঠানে শান্তাকে ঘুরে ঘুরে, বৃষ্টির দাদরা তালে নাচতে দেখতাম। আমার চেয়ে বছর কয়েকের বড় প্রতিবেশী খেলার সাথি শান্তার বৃষ্টিতে ভিজতে কোনো বাধা ছিল না। আর এ বিষয়ে আমার অক্ষমতা টের পেয়ে, ও যেন আমাকে দেখাবার আর জ্বালাবার জন্যই আরও বেশি দেখনদারি করত। জানালার ওপাশে আমাকে দেখামাত্রই ওর হাত-পাগুলো যেন বেশি চঞ্চল—ছুটে যাচ্ছে এধার থেকে ওধার। আমার বুকের ভেতরটা ছিঁড়েফুড়ে দিয়ে।

আকাশে কালো হলে কি আমাদের নাগরিক-মনেও মেঘ জমে
আকাশে কালো হলে কি আমাদের নাগরিক-মনেও মেঘ জমে

নীরব চোখের জল, এবার ক্ষোভে সরব। ‘শান্তার আম্মু কত্ত ভালো। ওকে সব সময় বৃষ্টিতে ভিজতে দেয়’—জানালার কাচে চোখ দুটো সেঁটে রেখেই বিড়বিড় করতাম। কিন্তু যার শুনবার, তিনি শুনে নিতেন ঠিক। ‘তোমাদের এই পচা আম্মু নিয়েই থাকতে হবে। কিচ্ছু করার নেই।’ আমার ছোটবেলা বর্ষাগুলো এমনই নিস্তরঙ্গ, ফ্ল্যাট লাইন।

বেশির ভাগ সময় নগরের মানুষেরা বৃষ্টি দেখেন জানালা দিয়ে
বেশির ভাগ সময় নগরের মানুষেরা বৃষ্টি দেখেন জানালা দিয়ে

তারপর পদ্মা-মেঘনা-যমুনার জল অনেক দূর গড়িয়েছে, শুকিয়েছে, চর পড়েছে। নারিন্দার বাড়ি ছেড়ে নতুন ঠিকানায় থিতু হয়েছি আমরা। প্রতিবেশীদের চেহারা বদলেছে। বদলেছে তাঁদের সঙ্গে সখ্যের ধরন। তবে বৃষ্টির সঙ্গে সেই ছোঁয়াছুঁয়ি সখ্য আর হয়নি আমার।

দিনবদলের পালায় মায়ের বারণের লিস্ট ছোট হয়েছে বটে, তবু বৃষ্টির সঙ্গে দূরত্ব ঘোচে না আমার। এখনো কাচের এপার থেকেই বৃষ্টি দেখি। অফিসে জানালা বা গাড়ির পিচ্ছিল কাচে ততোধিক পিচ্ছিলমতি জলের ফোঁটা গড়িয়ে যায়। আর একই আবেগ নিয়ে তাকিয়ে থাকি আমি—ছোটবেলার সেই বর্ষা-বঞ্চনার আবেগ।

তবু তো ভেজার আনন্দে বৃষ্টিতে ভেজে কেউ
তবু তো ভেজার আনন্দে বৃষ্টিতে ভেজে কেউ

না, বকার ভয় আর নেই। কিন্তু কোনো একটা ভয় যেন রয়ে গেছে কোথাও গোপনে নাকি সংকোচ? মেঘ-জলের সঙ্গে অল্প বয়সের দূরত্বের লজ্জা তাই আর ঘোচাতে পারছি না।

নাকি স্রেফ অলসতা? গায়ে কাঁটা দেওয়া ঠান্ডা জলের ফোঁটার চেয়ে হাতের তালুতে ধরা কালো কফির মগের ওম অনেক আরামের। নাকি অসময়ে ভিজে অসুখে পড়লে কেজো জীবনে গোনাগুনতি ছুটির হিসাব মেলাতে না পারার শঙ্কা?

কাচের ওপার দিয়ে চলে যায় রাতভর বৃষ্টি
কাচের ওপার দিয়ে চলে যায় রাতভর বৃষ্টি

নাকি সেই গানের কথাই সত্যি হলো এবার, ‘বাঁশি আর আগের মতো বাজে না!’
বৃষ্টির ছাঁট থেকে বাঁচতে খুব সামলে চলছি ঠিকই। কিন্তু স্মৃতির ছাঁটে কাকভেজা হয়েই কাটছে বর্ষাদিন আর বৃষ্টি-নেশাভরা সন্ধ্যাবেলাগুলো বলরামের চ্যালা হয়ে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.