যত ময়লা তত টাকা

0
101

কাঁচাবাজারে পড়ে আছে তরকারির উচ্ছিষ্ট। আরেক পাশে দেখা যাচ্ছে জবাই করা গরুর নাড়িভুঁড়ি। দুর্গন্ধ ছড়ানোর আগেই পৌরসভার তিনজন সেবক দৌড়ে গিয়ে তুলে ফেললেন সব। ফুলের অবশিষ্টাংশ পড়ে আছে কাঁচাবাজারের পাশেই। দু’জন গিয়ে তুলে আনলেন তাও। হোটেল কিংবা বাসাবাড়ির খাবারের উচ্ছিষ্ট পড়ে আছে পৌরসভার প্রবেশমুখে। কমলা রঙের জ্যাকেট পরা চার সেবক তা তুলে আনলেন রাউজান উপজেলা কমপ্লেক্সের পাশ থেকে। সেই জ্যাকেটের পেছনে লেখা ‘সেবক’। সামনে লেখা ‘রাউজান পৌরসভা’।

ময়লা-আবর্জনা জমার আগেই তুলে ফেলার এমন দৃশ্য দেখা গেছে রাউজান পৌরসভাতে। চট্টগ্রাম শহর থেকে ৪০ কিলোমিটার দূরের এই পৌরসভায় বাস্তবায়ন হচ্ছে নতুন এক প্রকল্প। ‘যত ময়লা তত টাকা’ স্লোগানে এ প্রকল্পের নাম ‘ব্ল্যাক সোলজার ফ্লাই ফার্মিং’। এখানে ময়লা-আবর্জনা থেকে তৈরি করা হয় জৈব সার। আবার হাঁস-মুরগি ও মাছের জন্য তৈরি করা হয় প্যারট পোকা। স্থানীয়ভাবে এগুলো ‘লেদা’ নামে পরিচিত। এই লেদা দেখতে হলুদ রঙের। আকারে এক মিলিমিটারের মতো। উচ্ছিষ্ট দিয়ে চাষ করা এই লেদা প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ৪০ টাকা দরে। ময়লা-আবর্জনাকে এভাবে সম্পদে রূপান্তর করে পুরো শহরকে ঝকঝকে-তকতকে রেখেছেন রাউজান পৌরসভার মেয়র জমির উদ্দিন পারভেজ। তবে ইন্দোনেশিয়ার প্রযুক্তি ব্যবহার করে এ প্রকল্প বাস্তবায়নের বড় ভূমিকা রেখেছেন স্থানীয় সাংসদ এবিএম ফজলে করিম চৌধুরী। রাউজান পৌরসভার এ উদ্যোগকে সাধুবাদ জানিয়েছে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। রাউজানের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা মডেল সারাদেশে বাস্তবায়নের জন্য তারা প্রজ্ঞাপনও জারি করেছে।

৩০ লাখ টাকা বিনিয়োগে তৈরি এ প্রকল্প সাড়া ফেলেছে দারুণভাবে। শহরকে আবর্জনামুক্ত রাখার পাশাপাশি পোলটি ফিড উৎপাদনের সুযোগও তৈরি করেছে প্রকল্পটি। আবর্জনা থেকে পোকা উৎপাদনের এমন প্রকল্প চট্টগ্রামে এটিই প্রথম। সরেজমিন দেখা যায়, শহরের মূল অংশ বেশ ফিটফাট। কোথাও কোনো ময়লা-আবর্জনা নেই। দেখা মেলে একটি কারখানার। চা-বাজারের উচ্ছিষ্ট, কমিউনিটি সেন্টারের বর্জ্য, মাছ বাজারের আবর্জনা, মুরগির নাড়িভুঁড়ি, শাকসবজির আগাছা, পশুর মল, পোলট্রি বর্জ্য, রান্নাঘরের উচ্ছিষ্ট, ফলের দোকানের আবর্জনা ও ফুল মার্কেটের বর্জ্য সংগ্রহ করে তা প্রক্রিয়াজাত করা হয় এ কারখানাতে। সেখানে ব্যানারের নিচে লাল কালিতে লেখা ‘এবার হবে পরিষ্কার, পৌরসভায় আসছে ব্ল্যাক সোলজার’।

কারখানার একেবারে শেষাংশে গিয়ে দেখা মিলেছে ব্ল্যাক সোলজারের। তার আগে আনুমানিক ১০০ ফুট বাই ১৫০ ফুটের একটি ঘরে দেখা গেছে প্লাস্টিকের সারি সারি লাল গামলা। ঢুকতেই হাতের ডান পাশে রাখতে দেখা গেছে ১৬টি লাল গামলা। তাতে রাখা আছে কাঁঠালের ঠোসা, পচা পটোল, আলু, বেগুন, ফুলের পচা পাপড়ি, ডাঁটা, মাছের নাড়িভুঁড়ি, মুরগির উচ্ছিষ্টাংশ। এর পাশে আছে মিক্সার মেশিন। গামলাভর্তি উপকরণ এই মিক্সার মেশিনে দিয়ে পোকা উৎপাদনের কাঁচামাল তৈরি করা হয়। চারপাশে মশারি নেট দিয়ে ঘেরা এ ঘরগুলোতে উড়তে দেখা গেছে কালো রঙের পোকাকে। এগুলোকেই ব্ল্যাক সোলজার হিসেবে চেনে রাউজানবাসী। প্যারোট পোকা উৎপন্ন করতে দরকার মশারি, কয়েকটি পাতিল ও কয়েকটি কাঠের টুকরো। একজন খামারি বড় পরিসরে এই পোকা চাষ করলে প্রতিদিন ১০০ থেকে ৫০০ কেজি পর্যন্ত পোকা উৎপন্ন করে লাভবান হতে পারবেন। ব্ল্যাক সোলজার ফ্লাই থেকে প্যারোট পোকা উৎপাদন করার পর বর্জ্যের যে অংশ অবশিষ্ট থাকে তা দিয়ে তৈরি হচ্ছে উৎকৃষ্টমানের জৈব সার। এই সার শাকসবজি ও ফসলের মাঠে ব্যবহার করা হচ্ছে। পোকা বা লেদা হাঁস-মুরগি ও মাছের জন্য পুষ্টিকর খাবার বলে বিবেচনা করা হয়। তাই প্রতিদিন ১০০ কেজির ওপরে লেদা উৎপাদন করা হয় এই প্রকল্পে। প্রতি কেজি ৪০ টাকা দরে এটি কিনে নেন খামারিরা।

যে আবর্জনা পরিবেশ দূষিত করত পৌরসভার, তা এখন আয়ের খাতে পরিণত হয়েছে রাউজানে। লেদা উৎপাদন ক্ষমতা আরও চার গুণ বাড়ানোর পরিকল্পনা রয়েছে তাদের। প্রতিদিন এক টন লেদা উৎপাদনের টার্গেট রয়েছে প্রকল্প-সংশ্লিষ্টদের। ব্যতিক্রমী এই উদ্যোগ প্রসঙ্গে রাউজানের এমপি ফজলে করিম চৌধুরী বলেন, ‘ময়লা-আবর্জনাকে কাজে লাগানোর নতুন উপায় খুঁজেছি আমরা। শহরটা সুন্দর থাকবে, আবর্জনামুক্ত থাকবে– এমন চিন্তা থেকেই ব্ল্যাক সোলজার ফ্লাই প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। এর মাধ্যমে কিছু লোকের কর্মসংস্থান হচ্ছে। আবার এখানকার উৎপাদিত পোকা কিনে কিছু খামারিও উপকৃত হচ্ছেন। হাঁস-মুরগি ও মাছের জন্য পুষ্টিকর পোকা সংগ্রহ করতে পারছেন তারা। চট্টগ্রামের মধ্যে এ প্রকল্প এটিই প্রথম বলে মনে হচ্ছে।’

রাউজান পৌরসভার মেয়র জমির উদ্দিন পারভেজ বলেন, এ প্রকল্প এখন সারাদেশের রোল মডেল। প্রকল্পের ইনচার্জ মো. সালাউদ্দিন জানান, ৯টি ওয়ার্ড থেকে প্রতিদিন বর্জ্য সংগ্রহ করেন তারা। কোন ওয়ার্ডে কে যাবে তা নির্ধারণ করা হয় আগে থেকে। আবর্জনা থেকে দুর্গন্ধ বের হওয়ার আগেই তা সংগ্রহ করে প্রকল্প এলাকায় নিয়ে আসেন সেবকরা। পৌরসভার সেবক রূপম বৌদ্ধ পাল বলেন, ১৮ জন সেবক ৯টি ওয়ার্ডে এ কাজ করছেন প্রতিদিন। প্রতি মাসে ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা বেতন পাচ্ছেন তারা। বর্জ্য দেখলেই তারা তা নিয়ে আসেন।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.