মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারে দুর্ঘটনা এত বেশি যে কারণে

0
135
  • উড়ালসড়কটির জোড়ায় ফাঁকা রয়েছে। তাই সরু চাকার মোটরসাইকেল চালানো ঝুঁকিপূর্ণ।
  • যানবাহনে অতিরিক্ত গতি থাকে।
  • উড়ালসড়কে যানবাহন থামিয়ে যাত্রী ওঠানো–নামানো হয়।

    মোটরসাইকেলে রাজধানীর মেয়র হানিফ উড়ালসড়ক দিয়ে স্ত্রীকে নিয়ে যাচ্ছিলেন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা মতিউর রহমান। তাঁর মোটরসাইকেলটিকে পেছন থেকে একটি সিএনজিচালিত অটোরিকশা ধাক্কা দেয়। হাসপাতালে নেওয়ার পর মতিউর মারা যান।

    ঘটনাটি গত শুক্রবারের। মেয়র হানিফ উড়ালসড়কে প্রায়ই এমন মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দুর্ঘটনার শিকার হন মোটরসাইকেলচালক ও আরোহী। ঢাকার অন্য উড়ালসড়কগুলোতে এত বেশি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার খবর পাওয়া যায় না।

    বিশেষজ্ঞ, পুলিশ কর্মকর্তা ও চালকেরা বলছেন, মেয়র হানিফ উড়ালসড়কে তিনটি কারণে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা বেশি হয়—১. উড়ালসড়কটির জোড়া বা এক্সপানশন জয়েন্টের ফাঁকা, যেখানে সরু চাকার মোটরসাইকেল চালানো ঝুঁকিপূর্ণ; ২. অতিরিক্ত গতি; ৩. উড়ালসড়কে যানবাহন থামিয়ে যাত্রী ওঠানো–নামানো ও সাধারণ মানুষের অসতর্ক চলাফেরা।

    বাইকবিডি ডটকমের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শুভ্র সেন বলেন, মেয়র হানিফ উড়ালসড়কের জোড়ার ফাঁকা জায়গার কারণে মোটরসাইকেলচালকদের অনেকেই দুর্ঘটনার শিকার হন। বিশেষ করে বৃষ্টির সময় এমন ফাঁকা জায়গা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় থাকে। তিনি বলেন, এই ফাঁকা জায়গায় ইস্পাতের পাত রয়েছে, যা বৃষ্টিতে পিচ্ছিল হয়ে যায়। সরু চাকার মোটরসাইকেলের চাকা ওই ফাঁকায় পড়লে দুর্ঘটনার আশঙ্কা তৈরি হয়।

    শুভ্র সেন আরও বলেন, তাঁর পরিচিত দুজন এভাবে মোটরসাইকেল থেকে ছিটকে পড়ে গিয়েছিলেন। দুজনই মারা গেছেন। উল্লেখ্য, সাধারত ৮০ থেকে ১২৫ সিসির (ইঞ্জিনক্ষমতা) মোটরসাইকেলের চাকা সরু হয়।

    মেয়র হানিফ উড়ালসড়ক ঘুরে দেখা গেছে, সেটি দিয়ে চলাচলকারী বাসের বেশির ভাগই উড়ালসড়কের ওপর থামে। সেখানে যাত্রীরা ওঠানামা করেন। এই চিত্র ঢাকার অন্য কোনো উড়ালসড়কে দেখা যায় না।

    মেয়র হানিফ উড়ালসড়কটি তৈরি হয়েছে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্বে। এটি ২০১৩ সালের অক্টোবরে চালু হয়। ১১ দশমিক ৭ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এই উড়ালসড়কের মোট ১৩টি র‍্যাম্প (ওঠানামার পথ) রয়েছে। এর মধ্যে ছয়টি দিয়ে উড়ালসড়কে ওঠা যায়। সাতটি দিয়ে নামা যায়। চার লেনের এই উড়ালসড়ক দিয়ে গুলিস্তান হয়ে সায়েদাবাদ, শনির আখড়া ও পোস্তগোলায় যাতায়াত করা যায়।

    মেয়র হানিফ উড়ালসড়কে এখন পর্যন্ত কয়টি দুর্ঘটনা ঘটেছে, তার সাম্প্রতিক তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, উড়ালসড়কের দুর্ঘটনায় ২০১৯ সালে ৩৩ জন, ২০২০ সালে ৫৭ জন ও ২০২১ সালে ৪৭ জন নিহত হয়েছেন।

    মেয়র হানিফ উড়ালসড়ক মতিঝিল, ওয়ারী ও যাত্রাবাড়ী থানার আওতাধীন। যাত্রাবাড়ী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মফিজুল আলম বলেন, উড়ালসড়কটিতে অতিরিক্ত গতিতে যানবাহন চালানোর কারণেই মূলত দুর্ঘটনা ঘটে। তবে তাঁর ভাষ্য, এই উড়ালসড়কে অহরহ দুর্ঘটনা ঘটছে, এমনটি বলার মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়নি। সেখান থেকে নামার পর বা ওঠার মুখে দুর্ঘটনা ঘটলেও বলা হয়, উড়ালসড়কে দুর্ঘটনা ঘটেছে।

    উড়ালসড়কটির ক্ষেত্রে আরও কিছু সমস্যা চিহ্নিত করেছে এআরআই। তাঁদের মতে, যানজট পেরিয়ে উড়ালসড়কে উঠেই চালকেরা যানবাহনের গতি বাড়িয়ে দেন। গতি নিয়ন্ত্রণে কোনো নজরদারি নেই। উড়ালসড়কের ওপরে একটি যানবাহন অন্যটিকে পেছনে ফেলে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টায় থাকে, যাকে বলা হয় ওভারটেক।

    মেয়র হানিফ উড়ালসড়ক ঘুরে দেখা গেছে, সেটি দিয়ে চলাচলকারী বাসের বেশির ভাগই উড়ালসড়কের ওপর থামে। সেখানে যাত্রীরা ওঠানামা করেন। এই চিত্র ঢাকার অন্য কোনো উড়ালসড়কে দেখা যায় না। উড়ালসড়ক ধরে যাত্রীরা হাঁটাহাঁটিও করেন। হাঁটতে গিয়েও অনেকে দুর্ঘটনার শিকার হন। ২০২২ সালের ৮ জানুয়ারি উড়ালসড়ক দিয়ে হাঁটার সময় বাসচাপায় দুজন মারা যান।

    দুর্ঘটনার জন্য তিনটি কারণকে দায়ী করলেন বিশেষজ্ঞ, পুলিশ কর্মকর্তা ও চালকেরা। নিরাপত্তা নিরীক্ষার পরামর্শ।

    সড়কে দুর্ঘটনার কারণসহ নানা বিষয় নিয়ে গবেষণা করে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) দুর্ঘটনা গবেষণা কেন্দ্র (এআরআই)। তাদের তথ্য অনুযায়ী, উড়ালসড়কটিতে দুর্ঘটনার বেশির ভাগই হয় মোটরসাইকেলকেন্দ্রিক, অর্থাৎ মোটরসাইকেলের জন্য উড়ালসড়কটি বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। এই ঝুঁকির কারণ হিসেবে উড়ালসড়কটির জোড়ার (এক্সপানশন জয়েন্ট) বড় ফাঁকাকে দায়ী করা হয়।

    উড়ালসড়কটির ক্ষেত্রে আরও কিছু সমস্যা চিহ্নিত করেছে এআরআই। তাঁদের মতে, যানজট পেরিয়ে উড়ালসড়কে উঠেই চালকেরা যানবাহনের গতি বাড়িয়ে দেন। গতি নিয়ন্ত্রণে কোনো নজরদারি নেই। উড়ালসড়কের ওপরে একটি যানবাহন অন্যটিকে পেছনে ফেলে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টায় থাকে, যাকে বলা হয় ওভারটেক।

    উড়ালসড়কটির গুলিস্তান র‍্যাম্প দিয়ে ওঠা ও সায়েদাবাদ দিয়ে নামার সুযোগের কারণে একটি অংশে বাঁ দিকের চালকেরা ডান লেনে, ডান দিকের চালকের বাঁ লেনে যেতে চান। এই লেন পরিবর্তনও ঝুঁকি তৈরি করে।

    এআরআইয়ের পরিচালক অধ্যাপক হাদিউজ্জামান বলেন, উড়ালসড়কটির একটি নিরাপত্তা নিরীক্ষা (সেফটি অডিট) হওয়া প্রয়োজন। যার মাধ্যমে সুনির্দিষ্টভাবে জানা যাবে, কোন অংশে কেন দুর্ঘটনা হয়। এরপর দুর্ঘটনা রোধে ব্যবস্থা নিতে হবে। তিনি বলেন, প্রাথমিকভাবে উড়ালসড়কটিতে গতি মাপার যন্ত্র বসানো, জোড়ায় রবার লাগিয়ে সুরক্ষিত করা এবং উড়ালসড়কে যাত্রী ওঠানো–নামানো বন্ধ করতে হবে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.