মাদক কারবার, নিয়োগ বাণিজ্যে কোটিপতি আ’লীগ নেতা মর্তুজা

0
88

ছিলেন বাসের সুপারভাইজার। পাশাপাশি করতেন মাদক ব্যবসা। পরে হয়ে যান আওয়ামী লীগ নেতা। এ পরিচয়েই পাল্টে যায় ভাগ্য। নিয়োগ বাণিজ্যসহ নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে হয়েছেন কোটি কোটি টাকার মালিক। শহরে বানিয়েছেন তিনতলা বাড়ি। তবে শেষ রক্ষা হয়নি। ফেনসিডিল পাচার মামলায় দণ্ডিত হয়ে এখন কারাগারে বন্দি তিনি। তাঁর এ পরিণতিতে এলাকায় স্বস্তি ফিরে এসেছে।

তাঁর নাম গোলাম মর্তুজা। তিনি ধুনট উপজেলার মথুরাপুর ইউনিয়নের পীরহাটি গ্রামের বাসিন্দা। টানা প্রায় ১৫ বছর ছিলেন ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক।

এলাকার মানুষ জানান, গরিবের ঘরের সন্তান মর্তুজা ১৫ বছর আগে স্ত্রী-সন্তানের মুখে দু’বেলা খাবার তুলে দিতে হিমশিম খেতেন। ২০০৮ সালে জয়পুরহাট-ঢাকা রুটের একটি যাত্রীবাহী বাসের সুপারভাইজার পদে চাকরি নেন। এ সময় জয়পুরহাট জেলার পাঁচবিবি উপজেলার (ভারতীয় সীমান্তবর্তী) হিলি থেকে নিজ গাড়িতে অভিনব কায়দায় ফেনসিডিল পাচারে জড়িয়ে পড়েন। ২০০৮ সালের ১২ জুলাই ৮০ বোতল ভারতীয় ফেনসিডিলসহ তাঁকে র‍্যাব সদস্যরা গ্রেপ্তার করেন। এ-সংক্রান্ত মামলায় সুপারভাইজার মর্তুজা ও হেলপার মুনজুরুল হককে আসামি করা হয়। গাড়ির ভেতর একটি বিশেষ বাক্স বানিয়ে তারা এ মাদক পরিবহন করতেন।

সে সময় গ্রেপ্তার হয়ে কিছুদিন হাজতবাসের পর ওই মামলায় মর্তুজা জামিনে ছাড়া পান। এর পর নিজ গ্রামে ফিরে এসে আওয়ামী লীগের রাজনীতি শুরু করেন। হয়ে ওঠেন সরকারদলীয় স্থানীয় সংসদ সদস্য হাবিবর রহমানের আস্থাভাজন। শুরুতেই বাগিয়ে নেন ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের পদ। এর পর আর পিছু ফিরে তাকাতে হয়নি তাঁকে। দলীয় পদ ব্যবহার করে নিয়োগ বাণিজ্য, চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন অপকর্মের মাধ্যমে হয়েছেন কোটি টাকার মালিক।

অবিশ্বাস্য নিয়োগ বাণিজ্য

দলীয় পদ পাওয়ার পর থেকেই মর্তুজা হয়ে ওঠেন এলাকার ত্রাস। দলীয় নেতাকর্মীসহ এলাকার মানুষ জিম্মি হয়ে পড়ে তাঁর কাছে। মথুরাপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি ও ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হাসান আহমেদ জেমস বলেন, মর্তুজা স্থানীয় সংসদ সদস্যের আস্থাভাজন ছিলেন। তিনি এমপির ব্যক্তিগত সহকারী কোরবান আলী মিলনের সঙ্গে যোগসাজশে গত ১৫ বছরে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি টিআর-কাবিখা, বয়স্ক ভাতা, বিধবা-প্রতিবন্ধী ভাতা, গর্ভবতী ভাতাসহ সরকারি বিভিন্ন অনুদানের টাকা থেকে লাখ লাখ টাকা কমিশন নিয়েছেন।

বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিয়োগ বাণিজ্য করে প্রায় কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন। চাকরি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে অনেক পরিবারকে সর্বস্বান্ত করেছেন। এ রকম ১৫ ভুক্তভোগী তাঁর কাছে অভিযোগ দিয়েছেন। তিনি কোনো সমাধান দিতে না পেরে ভুক্তভোগীদের আইনের আশ্রয় নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। পীরহাটি গ্রামের আবদুল হাকিমের ছেলে রকিবুল ইসলাম স্থানীয় অলোয়া আমেনা ময়েন ফাজিল মাদ্রাসার অফিস সহকারী পদে চাকরির জন্য তিন বছর আগে মর্তুজাকে ১২ লাখ টাকা দিয়েছিলেন। তিনি চাকরিও পাননি, টাকাও ফেরত পাননি। রকিবুল বলেন, টাকা ফেরত চাইলে মিথ্যা মামলায় ফাঁসানোসহ প্রাণনাশের হুমকি দিতেন মর্তুজা। স্থানীয় একাধিক ব্যক্তি জানান, মর্তুজা প্রভাব খাটিয়ে ২০১৩ সাল থেকে খাদুলী উচ্চ বিদ্যালয়ের সভাপতির পদ দখল করে আছেন। সেখানে ৯ জন শিক্ষক, চারজন কর্মচারী নিয়োগ দিয়ে ৯৪ লাখ টাকা হাতিয়ে নেন। স্থানীয়দের অভিযোগ, মর্তুজা সভাপতি হওয়ার পর থেকে প্রতিষ্ঠানটির লেখাপড়ার পরিবেশ একেবারে ভেঙে পড়েছে। বিদ্যালয়ের খেলার মাঠের দক্ষিণ পাশ থেকে প্রায়  তিন লাখ টাকার গাছ কেটে বিক্রি করেছেন। খেলার মাঠের পাশে একটি জায়গা থেকে ৮ লাখ টাকার মাটিও বিক্রি করেছেন।

এলাকার অভিভাবকরা তাদের ছেলেমেয়েদের পার্শ্ববর্তী মথুরাপুর ও পীরহাটি স্কুলে ভর্তি করাচ্ছেন। একসময়ে খাদুলী স্কুলটিতে ৪০০-৫০০ ছেলেমেয়ে লেখাপাড়া করত। এখন সেখানে আছে মাত্র ৭০ থেকে ৮০ শিক্ষার্থী। ওই বিদ্যালয়ের ক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা মর্তুজাকে গত ১০ মে বিদ্যালয়ের অফিস কক্ষে তালাবদ্ধ করে রেখেছিল। কিন্তু স্থানীয় সংসদ সদস্যের কাছের লোক হওয়ায় তাঁর বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

তিনি পীরহাটি তালতলা প্রতিবন্ধী স্কুল নামে একটি প্রতিষ্ঠানের সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে ২৫ লাখ টাকার নিয়োগ বাণিজ্য করেছেন। অথচ এই স্কুলের এখনও নিবন্ধনই হয়নি। তিনি হাটের সরকারি জায়গা দখল করে ছয়টি আধাপাকা দোকান নির্মাণ করে ১০ লাখ টাকার বাণিজ্য করেন। শ্যামগাতি গ্রামের গোলাম আজম বলেন, সাত বছর আগে স্থানীয় শ্যামগাতি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পিয়ন কাম নৈশপ্রহরী পদে চাকরির জন্য মর্তুজাকে ভিটেমাটি বিক্রি করে চার লাখ টাকা দিয়েছিলেন। চাকরি দিতে ব্যর্থ হওয়ার পরও টাকা ফেরত দেননি তিনি। গোলাম আজমের বাবা কামরুজ্জামান টাকা ফেরত চাইতে গেলে হুমকি দেন মর্তুজা। পরে তাঁর বাবা হার্ট অ্যাটাকে মারা যান।

হিজুলী সাগাটিয়া স্কুলের সহকারী প্রধান শিক্ষক আবদুস সামাদ জানান, প্রধান শিক্ষক পদে পদোন্নতির কথা বলে মর্তুজা ৯০ হাজার টাকা নিয়েছিলেন। কিন্তু কথা রাখেননি। স্থানীয়রা জানান, এসব অবৈধ টাকায় মর্তুজা বগুড়ার শেরপুর পৌর এলাকার দারকিপাড়ায় তিনতলা বাড়ি নির্মাণ করেছেন। নামে-বেনামে ব্যাংক তহবিলসহ অনেক জায়গাজমির মালিক হয়েছেন।

গত ১৯ জুন জয়পুরহাট জেলার স্পেশাল ট্রাইব্যুনালের বিচারক মর্তুজাকে ফেনসিডিল পাচার মামলায় দুই বছর সশ্রম কারাদণ্ড ও চার হাজার টাকা অর্থদণ্ড দেন। রায়ের পর তাঁকে বন্দি করা হয়। মর্তুজার কারাদণ্ডের খবরে স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীসহ সাধারণ মানুষের মধ্যে স্বস্তি ফিরে এসেছে। তারা মর্তুজার বিরুদ্ধে মুখ খুলতে শুরু করেন। গত ৪ জুলাই ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভায় মর্তুজাকে দল থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।

মর্তুজা কারাগারে থাকায় তাঁর বক্তব্য নেওয়া যায়নি। তবে বগুড়া-৫ আসনের সংসদ সদস্য হাবিবর রহমানের ব্যক্তিগত সহকারী মিলন জানান, মর্তুজার বিরুদ্ধে অভিযোগগুলোর সঙ্গে তাঁর কিংবা এমপির কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের নেতা হিসেবে মর্তুজা সব সময় তাদের অফিসে আসতেন। পরে তাঁর বিরুদ্ধে মাদক বিক্রির সংশ্লিষ্টতার বিষয়টি জানতে পারার পর থেকে তাঁকে এড়িয়ে চলতেন তারা। নিয়োগ বাণিজ্য প্রসঙ্গে মিলন বলেন, বড় নিয়োগের সুযোগ নেই। ছোটখাটো দু-একটি বাণিজ্যের সঙ্গে মর্তুজা জড়িত থাকতে পারেন।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.