‘মাইক্রোবাসে তুলেই নতুন গামছা দিয়ে আমার চোখ-মুখ বেঁধে ফেলে’

0
119
নাটোর সদর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন মাদ্রাসাশিক্ষক সাইদুল ইসলাম। আজ শনিবার সকালে

‘সন্ধ্যা পৌনে সাতটার দিকে মাদ্রাসার অফিসে বসে পবিত্র কোরআন তিলাওয়াত করছিলাম। ছয় থেকে সাতজন অপরিচিত লোক এসে আমার পরিচয় জানতে চায়। আমি পরিচয় দেওয়ামাত্র তারা ঘাড়ে ধাক্কা দিয়ে আমাকে জোর করে তাদের নিয়ে আসা সাদা রঙের মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে যায়। মাইক্রোবাসে ওঠার পরপরই একটা নতুন গামছা দিয়ে আমার চোখ-মুখ বেঁধে ফেলে।’

নাটোর সদর হাসপাতালের ১ নম্বর সার্জারি ওয়ার্ডে বসে এই বর্ণনা দিচ্ছিলেন মাদ্রাসাশিক্ষক হাফেজ মাওলানা সাইদুল ইসলাম (৩৮)। গতকাল শুক্রবার সন্ধ্যায় তাঁকে হাতুড়িপেটা করে পাঁচ থেকে ছয় কিলোমিটার দূরে সড়কের পাশে ফেলে যায় মুখোশধারী দুর্বৃত্তরা। এ নিয়ে গত এক মাসে নাটোরের চার উপজেলায় ১০ জনকে তুলে নিয়ে পিটিয়ে, কুপিয়ে, হাত-পায়ের রগ কেটে ও গুলি করে গুরুতর জখম করা হয়েছে।

সাইদুল ইসলাম নাটোর সদর উপজেলার মাঝদিঘা নুরানি হাফেজিয়া মাদ্রাসার সুপারিনটেনডেন্ট। তিনি নাটোর সদর উপজেলার মাঝদিঘা পূর্বপাড়ার বাসিন্দা। আজ শনিবার সকালে হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, বেডে শুয়ে স্বজন ও সহকর্মীদের সঙ্গে আলাপ করছেন সাইদুল ইসলাম। তাঁর শরীরের কাপড়চোপড়ে এখনো রক্তের ছোপ ছোপ দাগ। একে একে হাসপাতালে আসতে শুরু করেছেন মাদ্রাসার শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। দায়িত্বরত নার্স বারবার বলেও ভিড় কমাতে পারছেন না।

কাছে যাওয়ার পর সাইদুল ইসলামকে কথাবার্তা বন্ধ করতে দেখা যায়। পাশে দাঁড়ানো তাঁর ভাই মাওলানা আবদুল মাজেদ জানান, মাদ্রাসা থেকে তুলে নিয়ে পেটানোর পর থেকে অপরিচিত কারও সঙ্গে কথা বলতে সাহস পাচ্ছেন না সাইদুল। পরে পরিচয় পেয়ে ঘটনার বিস্তারিত জানান তিনি।

মাওলানা সাইদুল ইসলাম বলেন, মাদ্রাসা থেকে মাইক্রোবাসে তোলার পর তাঁকে পেছনের সিটে বসিয়ে দুজন হাত ধরে রাখেন। তাঁরা পরস্পরের মধ্যে নলডাঙ্গার স্থানীয় ভাষায় কথা বলছিলেন। তবে কেউ ফোনে কথা বলছিলেন না। তাঁর ফোনটি বেজে উঠলে তাঁরা সেটি কেড়ে নেন। পাঁচ থেকে ছয় কিলোমিটার দূরে চিকুর মোড়ে নিয়ে তাঁকে মাইক্রোবাস থেকে নামিয়ে পার্শ্বরাস্তায় দাঁড় করান। সাইদুল ইসলাম বলেন, ‘তখনই তারা লোহার রড, চাবুক ও হাতুড়ি দিয়ে আমার হাত-পায়ে এলোপাতাড়ি মারতে থাকে। আমি চিৎকার করলেও কেউ এগিয়ে আসে না। পরে আমি শুয়ে পড়ি এবং অচেতন হয়ে যাই। কিছুক্ষণ পর জ্ঞান ফিরলে দেখি তারা নাই। তখন আমি পথচারীদের সাহায্য চাই।’

খবর পেয়ে মাদ্রাসা পরিচালনা কমিটির সভাপতি ও ছাতনী ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান তোফাজ্জল হোসেনসহ তাঁর সহকর্মীরা ঘটনাস্থলে আসেন এবং থানা-পুলিশকে খবর দেন। ইউপি চেয়ারম্যান বলেন, সন্ধ্যার পরে এলাকায় একটি সভা করার সময় তিনি সাইদুল ইসলামকে তুলে নিয়ে যাওয়ার খবর পান। পরে খোঁজখবর নিয়ে চিকুর মোড় থেকে তাঁকে উদ্ধার করে সদর হাসপাতালে ভর্তি করেন। তাঁর হাত-পায়ে হাতুড়ি দিয়ে বেধড়ক পেটানো হয়েছে। তিনি গুরুতর আহত।

এই হামলার কারণের বিষয়ে জানতে চাইলে সাইদুল ইসলাম বলেন, মাদ্রাসার জালসার পোস্টারে নাম দেওয়া নিয়ে দুই বছর ধরে স্থানীয় ইউপি সদস্যের সঙ্গে তাঁর বিরোধ চলছিল। সম্প্রতি তাঁকে শাসিয়েছেনও। এ ছাড়া অন্য কারও সঙ্গে গোলমাল নেই। তাই কারা কেন তাঁকে এভাবে নির্যাতন করল, তা বলতে পারছেন না। তিনি বলেন, অপহরণকারীদের দেখতে ভদ্রলোক বলে মনে হচ্ছিল। সবার পায়ে কেডস ও পরনে শার্ট-প্যান্ট ছিল।

ভুক্তভোগীর ভাই আবদুল মাজেদ বলেন, তাঁরা মাদ্রাসার কর্তৃপক্ষ ও পরিবারের লোকজনের সঙ্গে আলাপ করে থানায় যাবেন অভিযোগ দেওয়ার জন্য। তাঁরা চান, পুলিশ অন্য ৯টি ঘটনার মতো তাঁদের অভিযোগও ফেলে রাখবে না। দ্রুত তদন্ত করে দায়ী ব্যক্তিদের বিচারের মুখোমুখি করবে।

সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নাছিম আহমেদ বলেন, ভুক্তভোগীর পরিবারের পক্ষ থেকে মামলা করলে পুলিশ মামলা নেবে। এ ঘটনায় তদন্ত করে দায়ী ব্যক্তিদের শনাক্ত করে বিচারের আওতায় আনা হবে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.