মণিপুর রাজ্যের পরিস্থিতি নিয়ে সংসদে আলোচনায় সরকারের অনাগ্রহের কারণেই বিরোধী জোট ‘ইন্ডিয়া’ অনাস্থা প্রস্তাব এনেছে। বিরোধীদের এই কৌশল স্পষ্ট। বিরোধী নেতারাই তা সরাসরি জানিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু সেই সঙ্গে সম্ভবত এটাও স্পষ্ট, সরকার মণিপুর নিয়ে সদস্যদের কোনো লিখিত প্রশ্নের উত্তরও দিতে রাজি নয়। অধিবেশনের এক সপ্তাহ কেটে গেলেও রাজ্যসভায় মণিপুর-সংক্রান্ত একটি প্রশ্নও লিখিত আকারে উঠে আসেনি।
কংগ্রেস নেতা ও সাবেক কেন্দ্রীয় মন্ত্রী পি চিদাম্বরম গতকাল বুধবার রাজ্যসভায় এ নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, ২০ জুলাই সংসদের বর্ষাকালীন অধিবেশন শুরু হয়েছে। অথচ আজ পর্যন্ত একবারও মণিপুর-সংক্রান্ত একটি প্রশ্নও জবাব দেওয়ার জন্য প্রশ্নপত্রের লিখিত তালিকায় স্থান পায়নি। ওই রাজ্যের পরিস্থিতির বিচারে এটি নিতান্তই বিস্ময়কর!
লোকসভা ও রাজ্যসভায় প্রতিদিন প্রশ্নকাল নির্দিষ্ট থাকে। দুই কক্ষেই এক ঘণ্টা সময় থাকে সদস্যদের প্রশ্ন ও মন্ত্রীদের জবাবের জন্য। সদস্যরা যেসব প্রশ্ন দুই কক্ষের সচিবালয়ে জমা দেন, সেগুলো লটারি করা হয়। প্রতিদিন ২০টি করে প্রশ্ন দুই কক্ষে লিখিত তালিকায় স্থান পায়। প্রশ্নোত্তর পর্বে সেই প্রশ্নগুলোই বিবেচিত হয়। এসব প্রশ্নের উত্তরের পিঠে সদস্যরা সম্পূরক প্রশ্নও করতে পারেন। লটারিতে স্থান না পাওয়া অন্য প্রশ্নগুলোর লিখিত উত্তর প্রতিদিন সভায় পেশ করা হয়। চিদাম্বরম বিস্ময় প্রকাশ করেন এই কারণে যে এই এক সপ্তাহে মণিপুর নিয়ে একটি প্রশ্নও তালিকাভুক্ত হয়নি!
গতকাল প্রশ্নোত্তর পর্ব চলাকালে রাজ্যসভায় চিদাম্বরম বিষয়টির অবতারণা করেন। তিনি জানান, সদস্যদের সহায়তা করার জন্য গঠিত সংসদের রিসার্চ অ্যান্ড ইনফরমেশন সাপোর্ট সংস্থার (প্রিজম) কাছে তিনি জানতে চেয়েছিলেন, মণিপুর নিয়ে কয়টি প্রশ্ন বাছাই ও উত্তর দেওয়া হয়েছে? চিদাম্বরমকে জানানো হয়, একটিও নয়। মণিপুর নিয়ে একটিও প্রশ্ন গৃহীত হয়নি, ফলে উত্তরও দেওয়া হয়নি। অথচ বহু সদস্য বলেছেন, তাঁরা ওই বিষয়ে প্রশ্ন জমা দিয়েছেন!
চিদাম্বরমের মন্তব্যের মধ্য দিয়ে এমন মনে করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে, সরকার ইচ্ছাকৃতভাবেই মণিপুর-সংক্রান্ত প্রশ্ন সংসদে তুলতে দিচ্ছে না। প্রবীণ কংগ্রেস নেতা স্পষ্টভাবে ওই সন্দেহের কথা না জানালেও বিস্ময় প্রকাশ ও মন্তব্যের মধ্য দিয়ে তা পরিষ্কার। রাজ্যসভার নেতা পীযুষ গোয়েল তাই চেয়ারম্যানের উদ্দেশে বলেন, দুর্ভাগ্যের বিষয়, বিরোধী সদস্য সভাধ্যক্ষের আচরণকে প্রশ্নবিদ্ধ করছেন। তাঁর নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন। এ জন্য চিদাম্বরমের ক্ষমা চাওয়া উচিত।
মণিপুর নিয়ে সংসদে সরকারকে জবাবদিহিতে বাধ্য করতে বিরোধী জোট ‘ইন্ডিয়া’র অনাস্থা প্রস্তাব লোকসভার স্পিকার ওম বিড়লা গ্রহণ করেছেন। সেই প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা কবে কতক্ষণ ধরে হবে, তা তিনি ঠিক করবেন। সরকারের বিরুদ্ধে আনা এই অনাস্থা প্রস্তাব আলোচনার পর ভোটাভুটিতে হেরে যাবেই। কিন্তু তা জেনেশুনেও এই প্রস্তাব পেশের উদ্দেশ্য একটাই, সংসদ থেকে ‘পালিয়ে বেড়ানো’ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে মণিপুর নিয়ে আলোচনায় বাধ্য করা। যেসব বিষয়ে বিরোধীরা সরকারের সমালোচনা করবেন, সেগুলোর জবাব দিতে বাধ্য করা।
সংসদের রেকর্ডে দেখাচ্ছে, ২০১৯ সালে দ্বিতীয়বার নির্বাচিত হওয়ার পর প্রধানমন্ত্রী মোদি এযাবত মোট সাতবার বিতর্কে অংশ নিয়েছেন। এর মধ্যে প্রথামাফিক পাঁচবার রাষ্ট্রপতির ভাষণের ওপর ধন্যবাদ জ্ঞাপন প্রস্তাবে অংশ নিয়ে বক্তব্য দিয়েছেন। অন্য দুটির একটি রাম জন্মভূমি তীর্থক্ষেত্র ট্রাস্ট গঠনের ঘোষণা-সংক্রান্ত। ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে।
অন্যটি ২০১৯ সালে যখন ওম বিড়লা লোকসভার স্পিকার নির্বাচিত হন। তাঁকে স্বাগত জানিয়ে তিনি ভাষণ দিয়েছিলেন।
এর বাইরে মোদি একবারের জন্যও সদস্যদের কোনো প্রশ্নের জবাব দেননি। লোকসভা ও রাজ্যসভায় সপ্তাহে একটি করে দিন নির্দিষ্ট থাকে প্রধানমন্ত্রীর জন্য। তিনি যেসব মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত, এ সময় সে-সম্পর্কিত প্রশ্নের জবাব দেন তিনি। গত ৯ বছরে একবারের জন্যও মোদি কোনো প্রশ্নের উত্তর দেননি। উত্তরের দায়িত্ব পালন করেছেন মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রতিমন্ত্রীরা।