ভিসার হুমকিতে প্রার্থীর ইন্তেকাল না করা নির্বাচন

0
114

বাংলাদেশে নির্বাচনী প্রক্রিয়া যাতে গণতান্ত্রিক হয়, নির্বাচন সুষ্ঠু ও অবাধ হয়, সেই লক্ষ্য সামনে রেখে যুক্তরাষ্ট্র ভিসার হুমকি ঘোষণার পর দেশে তিনটি মহানগরে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। প্রথমটি হয়েছে ভিসা নীতি ঘোষণার মাত্র এক দিন পর, যে সময়টুকু যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নীতির সবকিছু বুঝে ওঠার জন্য যথেষ্ট ছিল না। তবে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো বিস্ময়করভাবে গলা মিলিয়ে ওই ভিসা নীতিকে স্বাগত জানিয়েছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও যে ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে, তাকে যুক্তরাষ্ট্র স্বাগত জানিয়েছে। পরে অবশ্য ধীরে ধীরে সরকারের সুর বদলাতে শুরু করেছে এবং কোনো ধরনের হুমকিকে পরোয়া না করার ঘোষণাও এসেছে। এরপর অনুষ্ঠিত হলো খুলনা ও বরিশালের সিটি নির্বাচন। রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন নির্বাচনগুলো কেমন হলো, তার নানা রকম মূল্যায়ন পাওয়া যাচ্ছে, যা কিছুটা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যতাড়িত।

নির্বাচন কমিশনের মূল্যায়নে ‘সার্বিক অর্থে সুন্দর ও সুচারুভাবে নির্বাচন হয়েছে। কমিশন সন্তুষ্ট।’ তবে এই সুন্দর নির্বাচন ও সন্তুষ্টির একটা মান নির্ধারণ করে দিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল। বরিশালে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী ক্ষমতাসীন দলের সমর্থকদের হামলায় আহত হলেও ‘ইন্তেকাল’ না করায় তাঁর কাছে আর কোনো সমস্যা ধরা পড়েনি। ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থী আহত হলে তিনি এমন দায়িত্বহীন ও নিন্দনীয় কথা বলতেন কি না, সন্দেহ আছে। অর্থপূর্ণ রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার অনুপস্থিতিতে এসব নির্বাচন যেমন হয়েছে, রাজনৈতিক ক্ষমতার আসল লড়াই হবে তার চেয়ে ঢের বেশি প্রতিযোগিতার। ফলে এতে সহিংসতার আশঙ্কা থাকে প্রবল। প্রধান নির্বাচন কমিশনারের ঠিক করা মাপকাঠি অনুযায়ী প্রতিদ্বন্দ্বী দলের কারও ইন্তেকাল না হওয়া পর্যন্ত সহিংসতা গ্রহণযোগ্য বলে ক্ষমতাসীন দল ও প্রশাসন যদি মনে করে, তাহলে ভবিষ্যতের নির্বাচনগুলো কেমন হবে, তার একটা ধারণা এখন পাওয়া যাচ্ছে।

গাজীপুরে ভোটের দিন কোনো ঝামেলা না হলেও ভোটের আগে নির্বাচন মোটেও হাঙ্গামামুক্ত ছিল না। ক্ষমতাসীন দলের মনোনীত ও মনোনয়নবঞ্চিত দুই রাজনীতিকের গোষ্ঠীগত লড়াইয়ে একপক্ষ প্রশাসনের পৃষ্ঠপোষকতা ও সুরক্ষা পেলেও অন্য পক্ষের প্রার্থিতা বাতিল থেকে শুরু করে তাঁর বিকল্প প্রার্থীর প্রচারে বারবার হামলার ঘটনা ঘটেছে। পুত্রের পরিচয়ের সূত্র ধরে প্রার্থী হওয়া নারী তাই সম্ভবত যথেষ্ট পরিমাণে সহানুভূতির ভোট লাভ করেছেন।

রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন সিটি নির্বাচনে যে কটিতে সবার আগ্রহ লক্ষ করা গেছে, সেগুলোতে দুটো বিষয় লক্ষণীয়—প্রথমত, ক্ষমতাসীন দলের অভ্যন্তরীণ গোষ্ঠীগত লড়াই যেখানে প্রবল, আর দ্বিতীয়ত, ক্ষমতাসীন দল যেখানে প্রার্থী বদল করেছে অথবা বাইরে থেকে কাউকে আমদানি করেছে, সেখানে। বরিশাল ও গাজীপুর দুই মহানগরে আগের মেয়রদের পুনর্নির্বাচনের সুযোগ না দেওয়ার প্রধান কারণ তাঁদের বিরুদ্ধে নানা রকম অন্যায়-অনিয়মের অভিযোগ। এ ক্ষেত্রে বরিশাল ও সিলেটে যথাক্রমে ঢাকা ও লন্ডন থেকে নতুন মুখ পাঠানো হয়েছে, স্থানীয় রাজনীতিতে যুক্ত না থাকায় তাঁরা দলের অন্যায় ও অপকর্মের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের থেকে নিজেদের আলাদা হিসেবে তুলে ধরতে পারছেন। আবার যেখানে উপদলীয় সংঘাত প্রকট নয়, সেখানে আগের নেতারাই পুনর্নির্বাচনের সুযোগ পেয়েছেন। তাঁদের নির্বাচন একেবারেই নিরুত্তাপ।

ভিসা নীতি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের একটি দায়িত্বশীল কূটনৈতিক সূত্র অনানুষ্ঠানিক আলোচনায় বলেছে, তাদের তথ্য বলছে, পদস্থ রাজনীতিক ও প্রশাসনিক কর্তাদের প্রায় ৮০ শতাংশের পরিবারের কেউ না কেউ লেখাপড়া, ব্যবসা অথবা অভিবাসন সূত্রে যুক্তরাষ্ট্রে বাস করছে। উগান্ডা বা নাইজেরিয়ার মতো দেশের থেকে বাংলাদেশের বেলায় পার্থক্য স্পষ্ট করে ওই সূত্র জানায় যে সাত মাস আগে এই নীতি ঘোষণার উদ্দেশ্য হচ্ছে, নির্বাচনের আগেই যাতে ব্যবস্থা নেওয়া যায়।

নির্বাচন কমিশনের মতোই ক্ষমতাসীন দলও সিটি নির্বাচনের ফলাফলে বেশ সন্তুষ্ট বলেই মনে হয়। মন্ত্রীদের কেউ কেউ বলেছেন, এসব নির্বাচনে ভোটারদের অংশগ্রহণ প্রমাণ করেছে, বিএনপির নির্বাচন বর্জনে কিছুই আসে-যায় না। তাঁরা আরও বলছেন, বিএনপিকে এখন রাজনীতিতে টিকতে হলে নির্বাচনে আসতেই হবে। গাজীপুর, বরিশাল ও খুলনায় ভোট পড়েছে ৫০ শতাংশের আশপাশে, যা স্বাভাবিক প্রত্যাশার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়, সেটা তাঁরা হয় ইচ্ছে করেই আড়াল করছেন, নয়তো ভুলে গেছেন। স্থানীয় সরকার নির্বাচনে সব সময়েই ভোটের হার বেশি হয়।

বিএনপিসহ প্রধান প্রধান দলের অংশগ্রহণে সিটি করপোরেশনের প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচন সর্বশেষ হয়েছিল ২০১২ ও ২০১৩ সালে। ওই সব নির্বাচনে গড়ে ভোটের হার ছিল ন্যূনতম ৬৫ থেকে ৭৫। এমনকি ২০১৭ ও ২০১৮ সালে কুমিল্লা ও সিলেটে বিএনপি শেষ পর্যন্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতায় থাকায় ওই দুই মহানগরে ভোটের হার বেশি ছিল। কিন্তু খুলনা, বরিশাল ও রাজশাহীতে বিএনপির প্রার্থীরা দিনের প্রথম ভাগে ভোট বর্জন করায় সে হার অনেক কমে যায়। সুতরাং প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী দুটি রাজনৈতিক দলের একটির অনুপস্থিতি যে নির্বাচনকে যথেষ্ট প্রতিনিধিত্বশীল করে না, সে কথা অস্বীকার করা যায় না।

ফয়জুলের ‘ইন্তেকাল’ না হওয়া ও সিইসির ‘আপেক্ষিকতা তত্ত্ব’

এবারের সিটি নির্বাচনে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত দল সম্ভবত জাতীয় পার্টি, যারা সংসদে সরকার মনোনীত বিরোধী দল হিসেবে প্রায় এক দশক পূর্ণ করতে চলেছে। গাজীপুরে তাদের প্রার্থী জামানত খুইয়ে চতুর্থ হয়েছেন, আর বরিশাল ও খুলনায়ও তাদের অবস্থান চতুর্থ। দলটির অধোগতির সুফল অবশ্য তুলে নিয়েছেন চরমোনাই পীরের অনুসারীরা। তাঁদের ইসলামী আন্দোলন মহানগরগুলোর ভোটের হিসাবে এখন জাতীয় পার্টির চেয়ে বড় দল। জাতীয় পার্টির জন্য আশঙ্কার বিষয় হচ্ছে, ভোটের ব্যবধানে কিন্তু তাদের পিছিয়ে পড়ার ব্যবধান ক্রমশই বাড়ছে।

প্রশ্ন হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা হুমকির পটভূমিতে এসব নির্বাচন থেকে কার কতটা লাভ হলো অথবা ঝুঁকি বাড়ল? নির্বাচন কমিশন তিনটি সিটির ভোট বিনা বাধায় সম্পন্ন করতে পারায় যতই সন্তুষ্টির কথা বলুন না কেন, নির্বাচনী প্রচারে সহিংসতা বন্ধ করতে না পারায় গণতান্ত্রিক নির্বাচনী প্রক্রিয়ার পরীক্ষায় উতরানোর সামর্থ্য ও যোগ্যতার প্রমাণ এখনো মেলেনি। উপরন্তু বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের হয়রানিমূলক মামলায় গ্রেপ্তার না করতে সরকারকে অনুরোধ জানাতে কমিশন সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে সংসদে আইনমন্ত্রীর ঘোষণায় প্রশ্ন ওঠে, নির্বাচন পরিচালনায় কী ধরনের ব্যবস্থা প্রয়োজন, সেই সিদ্ধান্ত কে নিচ্ছে—নির্বাচন কমিশন না সরকার? তাহলে কমিশনের স্বাধীনতা আদৌ আর থাকে কি?

নির্বাচন কমিশন কি নিজের পায়ে কুড়াল মারল

রাজনৈতিক দলগুলোর আচরণ প্রশ্নে এখন পর্যন্ত যা দেখা যাচ্ছে, তাতে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের মাঠপর্যায়ের নেতা-কর্মীদের সংযত হওয়ার কোনো লক্ষণই দেখা যাচ্ছে না। বিরোধীদের রাজনৈতিক কর্মসূচিতে বাধা, নির্বাচনী প্রচারে হামলা, প্রার্থীকে আক্রমণ—কিছুই বন্ধ হয়নি। তবে নেতাদের অনেকের মধ্যেই উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার ছাপ স্পষ্ট। প্রশাসনেও পরিবর্তন লক্ষণীয়। তা না হলে প্রার্থীদের সঙ্গে নির্বাচন কমিশনের মতবিনিময় সভায় এক পদস্থ আমলার কণ্ঠে ‘এখানে গণতন্ত্রের গ-ও নেই’ মন্তব্য শোনা যেত না।

ভিসা নীতি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের একটি দায়িত্বশীল কূটনৈতিক সূত্র অনানুষ্ঠানিক আলোচনায় বলেছে, তাদের তথ্য বলছে, পদস্থ রাজনীতিক ও প্রশাসনিক কর্তাদের প্রায় ৮০ শতাংশের পরিবারের কেউ না কেউ লেখাপড়া, ব্যবসা অথবা অভিবাসন সূত্রে যুক্তরাষ্ট্রে বাস করছে। উগান্ডা বা নাইজেরিয়ার মতো দেশের থেকে বাংলাদেশের বেলায় পার্থক্য স্পষ্ট করে ওই সূত্র জানায় যে সাত মাস আগে এই নীতি ঘোষণার উদ্দেশ্য হচ্ছে, নির্বাচনের আগেই যাতে ব্যবস্থা নেওয়া যায়। পরিচয় নির্দিষ্ট না করেও ব্যবস্থা নেওয়ার সিদ্ধান্ত ঘোষণার সুযোগ রয়েছে বলেও সূত্র উল্লেখ করেছে।

কোনো দল নির্বাচন বর্জন করলে তাদের ওপর নির্বাচনে অংশগ্রহণের চাপ হিসেবে এ নীতি কাজ করবে কি না, এমন প্রশ্নের জবাব স্পষ্ট করতে গিয়ে ওই সূত্র বলেছে, কোনো দল যদি মনে করে গণতান্ত্রিক নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি না হওয়ায় তারা নির্বাচনে অংশ নেবে না, সে অধিকার তাদের রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র সে কারণেই নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হতে হবে—এমন কোনো কথা বলছে না। তবে নির্বাচন হতে দেওয়া হবে না ঘোষণা দিয়ে সহিংস বাধা দিলে বিরোধী দলও ওই নীতির আওতায় পড়বে। সরকারের ধারাবাহিকতার পক্ষে থাকা আঞ্চলিক শক্তিগুলোর সম্ভাব্য উদ্বেগ ও আপত্তির বিষয়ে ওই কূটনৈতিক সূত্র বলেছে, বর্তমান স্থিতিশীলতায় তারা সাময়িক স্বস্তিবোধ করলেও যুক্তরাষ্ট্র মনে করে কার্যকর গণতন্ত্র ছাড়া দীর্ঘমেয়াদি অস্থিরতার ঝুঁকি সবার জন্যই বিপদ বাড়াবে।

সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের জন্য আদতে যে রাজনৈতিক সমঝোতা ও গণতান্ত্রিক পরিবেশ প্রয়োজন, তা যদি নিজেরাই নিজস্ব তাগিদে তৈরি করা সম্ভব হয়, তাহলে এসব শর্তের আলোচনা একেবারেই অপ্রয়োজনীয়। আমাদের সেই বোধোদয় আদৌ হবে কি?

কামাল আহমেদ সাংবাদিক

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.