‘বোমা বানাতে’ গিয়ে বিস্ফোরণে মৃত্যু, পুলিশের ‘গাফিলতিতে’ আলামত নষ্ট

0
113
সিরাজগঞ্জের বেলকুচিতে বিস্ফোরণে নিহত ফজলু শেখ, ছবি: সংগৃহীত

সিরাজগঞ্জের বেলকুচি উপজেলার সুবর্ণসারা গ্রামের মোতালেব হোসেন সরকারের বাড়িতে বোমা বিস্ফোরণে দগ্ধ হন কুষ্টিয়ার ফজলু শেখ (৪৫)। তিন দিন চিকিৎসাধীন থাকার পর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মারা যান তিনি। শাহবাগ থানা-পুলিশের করা লাশের সুরতহাল প্রতিবেদনে এসব তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। ফজলু শেখ বোমা বিস্ফোরণে দগ্ধ হয়ে মারা গেছেন বলে তাঁর মৃত্যু সনদে উল্লেখ করেছেন চিকিৎসক।

বিস্ফোরণের ঘটনাটি ঘটে গত মঙ্গলবার দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে। ফজলু মারা যান শুক্রবার। ময়নাতদন্ত শেষে আজ দুপুরে তাঁর লাশ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। স্বজনেরা জানান, ফজলুর গ্রামের বাড়ি কুষ্টিয়া সদরের ঝিলপাড়া গ্রামে। তাঁর দুই মেয়ে এক ছেলে রয়েছে। ফজলু একাই সাভারের আশুলিয়ার নবীনগর এলাকায় থেকে ঝালমুড়ি বিক্রি করতেন। তিনি কীভাবে সিরাজগঞ্জে মোতালেবের বাড়িতে গেলেন, সে বিষয়ে তাঁদের কোনো ধারণা নেই।

এই বারান্দায় ঘটেছিল বিস্ফোরণ, সেখানে এরইমধ্যে নতুন টাইলস লাগানো হয়েছে

যাঁর বাড়িতে এই বিস্ফোরণ ঘটেছে, সেই মোতালেব স্থানীয় শ্রমিক লীগের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত। তিনি সিরাজগঞ্জ-৫ আসনের (বেলকুচি-চৌহালী) সংসদ সদস্য ও দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এই আসনে নৌকার প্রার্থী আবদুল মমিন মণ্ডলের অনুসারী। নির্বাচন ঘিরে মোতালেবের বাড়িতে বোমা বানাতে গিয়ে বিস্ফোরণে ফজলুর মৃত্যু হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন বেলকুচি পৌরসভার মেয়র সাজ্জাদুল হক।

বিস্ফোরণের ঘটনাস্থলটি বেলকুচি থানা থেকে ৬০০ মিটারের মধ্যে। অথচ বিস্ফোরণের ঘটনায় একজন গুরুতর আহত হয়ে মারা যাওয়ার তথ্য এখনো নিশ্চিত হতে পারেননি বেলকুচি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আনিছুর রহমান। বিষয়টি এখনো অনুসন্ধান পর্যায়ে রয়েছে বলে জানিয়েছেন তিনি।

ঘটনাটি তদন্তে থানা-পুলিশ গড়িমসি করলেও আজ ঘটনাস্থলে গিয়েছিল পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) একটি দল। জানতে চাইলে সিআইডির পরিদর্শক মোহাইমিনুল হোসাইন বলেন, থানা-পুলিশ বা জেলা পুলিশ বিস্ফোরণের বিষয়টি তাঁদের জানায়নি। গণমাধ্যমে বোমা বিস্ফোরণের খবর পেয়ে তাঁরা আজ ঘটনাস্থলে গিয়ে আলামত সংগ্রহের চেষ্টা করেন।

সব আলামত নষ্ট করে ফেলা হয়েছে

সিরাজগঞ্জের বেলকুচিতে বিস্ফোরণে নিহত ফজলু শেখ, ছবি: সংগৃহীত

সরেজমিনে আজ বেলা সাড়ে ১১টার দিকে মোতালেবের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, বাড়ির পেছনে একটি খালের ওপর নির্মিত দোতলা ভবনের দুটি তলাতেই একটি করে কক্ষ রয়েছে। ভবনের নিচতলার কক্ষটি ফাঁকা। দ্বিতীয় তলার কক্ষটি বেশ পরিপাটি। সেখানে একটি খাটসহ কয়েকটি দামি আসবাব রয়েছে। এই কক্ষের পাশেই ছোট্ট একটি বারান্দা। পুরো কক্ষ এবং বারান্দায় টাইলস লাগানো। এই বারান্দাতেই বিস্ফোরণের ঘটনাটি ঘটে বলে বাড়ির সদস্যরা জানান। তবে ক্ষতিগ্রস্ত টাইলস তুলে সেখানে নতুন টাইলস লাগানো হয়েছে।

সিআইডি কর্মকর্তা মোহাইমিনুল হোসাইন বলেন, ঘটনাস্থলে বিস্ফোরণের কোনো আলামত অবশিষ্ট নেই। পাশের খালের পানি থেকে বিস্ফোরণে ক্ষতিগ্রস্ত টাইলসের কিছু টুকরা সংগ্রহ করা হয়েছে। এখন এগুলোই পরীক্ষা করে দেখতে হবে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, থানা-পুলিশের দায়সারা ভূমিকার কারণে তাৎক্ষণিকভাবে ঘটনাস্থল থেকে আলামত সংগ্রহ করা সম্ভব হয়নি। কারণ এমন স্পর্শকাতর ঘটনায় অবশ্যই পুলিশের বিশেষায়িত বিভাগকে জানায় থানা-পুলিশ। বিশেষায়িত ইউনিট বা বিভাগের কর্মকর্তারাই আলামত সংগ্রহ করে বিস্ফোরণের কারণ অনুসন্ধান করেন। এখানে থানা-পুলিশের প্রশ্নবিদ্ধ ভূমিকার কারণেই আলামত নষ্ট করে ফেলার সুযোগ তৈরি হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত স্থানে দ্রুত টাইলস বসানো হয়েছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বেলকুচি থানার ওসি আনিছুর রহমান বলেন, বিস্ফোরণের খবর পেয়ে তাঁরা ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখতে পান কয়েকটি টাইলস ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তখন ওই বাড়িতে থাকা নারীরা জানিয়েছিলেন, রান্না করার সময় প্রেশারকুকারে বিস্ফোরণ ঘটেছে। এতে বাসার টাইলস ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ ঘটনায় কেউ আহত হননি বলেও তাঁরা পুলিশকে জানিয়েছিলেন। কেউ আহত হয়েছে কি না, সেটি এখনো যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়ার মধ্যে আছে, অনুসন্ধান পর্যায়ে আছে। মারা যাওয়া ব্যক্তির সঙ্গে এই ঘটনার যোগসূত্রের বিষয়টিও অনুসন্ধান পর্যায়ে আছে।

ঘটনার দিন রাতে ওই এলাকায় গিয়ে চার-পাঁচজন প্রত্যক্ষদর্শীর সঙ্গে কথা হয়। তাঁরা বলেছিলেন, বিকট শব্দে বিস্ফোরণের পর আশপাশের লোকজন এগিয়ে গেলে কাউকে বাড়িতে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। কিছুক্ষণ পর একটি কালো রঙের মাইক্রোবাস এসে আবার চলে যায়। সে সময় মোতালেবকেও দেখা গিয়েছিল। তবে মাইক্রোবাসে কী বা কাকে নেওয়া হয়, তা তাঁরা বুঝতে পারেননি।

মোতালেব হোসেনের বাড়ির পেছনের এই খালের পানি থেকে বিস্ফোরণে ক্ষতিগ্রস্ত টাইলসের কিছু টুকরা সংগ্রহ করা হয়েছে
মোতালেব হোসেনের বাড়ির পেছনের এই খালের পানি থেকে বিস্ফোরণে ক্ষতিগ্রস্ত টাইলসের কিছু টুকরা সংগ্রহ করা হয়েছে

‘বোমা বিস্ফোরণেই মৃত্যু’

আজ ওই বাড়িতে গিয়ে মোতালেব হোসেনকে পাওয়া যায়নি। তাঁর স্ত্রী খালেদা বেগম ও পুত্রবধূ আশা খাতুন বাড়িতে ছিলেন। তাঁরা জানান, মোতালেব সাধারণত এই বাড়িতে থাকেন না। তিনি দ্বিতীয় স্ত্রীর সঙ্গে অন্য বাড়িতে থাকেন। মাঝে মাঝে এখানে এলেও আবার চলে যান। এই বাড়িতে মোতালেবের প্রথম স্ত্রী খালেদা বেগমই থাকেন।

বিষয়টি নিয়ে বক্তব্যের জন্য মোতালেবের মুঠোফোনে একাধিকার কল করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি। মোতালেবের ছোট ভাই আবু তালেব সরকার বলেন, এই এলাকায় রাজনৈতিক বিরোধের কারণে পরিকল্পিতভাবে একটি পক্ষ মোতালেবকে ফাঁসানোর চেষ্টা করছে। তাঁরাই বলছেন, বোমা বিস্ফোরণ হয়েছে।

তবে ঢাকার শাহবাগ থানার ওসি মোস্তাজিরুর রহমান বলেন, বেলকুচির স্থানীয় সূত্রে বোমা বিস্ফোরণের তথ্য নিশ্চিত হওয়া গেছে। সেখান থেকে দগ্ধ ব্যক্তিকে যে মাইক্রোবাসে করে আনা হয়েছে, ঢাকা মেডিকেলেও একই মাইক্রোবাস এসেছে। আর চিকিৎসক বলেছেন, ফজলু বোমা বিস্ফোরণে দগ্ধ হয়ে মারা গেছেন। অনুসন্ধানে পাওয়া এসব তথ্যই সুরতহাল প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.