বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও আমলাদের বিচারিক ক্ষমতা

0
224

রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গ হলো নির্বাহী বিভাগ (এক্সিকিউটিভ), আইন বিভাগ (লেজিসলেটিভ) ও বিচার বিভাগ (জুডিশিয়ারি)। ক্ষমতার স্বতন্ত্রীকরণেও রাষ্ট্রের এই তিনটি অঙ্গ কখনোই পুরোপুরি আলাদাভাবে কাজ করতে পারে না; দরকার হয় পারস্পরিক সমন্বয় ও ভারসাম্যের। এই ভারসাম্যের নীতি দ্বারাই আধুনিক রাষ্ট্র পরিচালিত হয়। ভারসাম্যের নীতির প্রধান শর্তই হলো, এক বিভাগ আরেক বিভাগের কাজে হস্তক্ষেপ করবে না। কিন্তু আমাদের বাস্তবতা ভিন্ন। এর একটি বড় উদাহরণ হলো, কিছু কিছু ক্ষেত্রে নির্বাহী বিভাগের অন্তর্ভুক্ত প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তা বা আমলাদের বিচারিক ক্ষমতার প্রয়োগ।

স্বাধীন বিচার বিভাগ একটি গণতান্ত্রিক দেশের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য। বিচারপ্রক্রিয়া সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করা এবং নিরপেক্ষতা বজায় রাখা বিচারকদের দায়িত্ব। সংবিধানের ১১৬ক অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘এই সংবিধানের বিধানাবলি সাপেক্ষে বিচার-কর্ম বিভাগে নিযুক্ত ব্যক্তিগণ এবং ম্যাজিস্ট্রেটগণ বিচারকার্য পরিচালনার ক্ষেত্রে স্বাধীন থাকবেন।’ আইনের ওপর বিশেষায়িত জ্ঞান ছাড়া ভালোভাবে বিচার করা যায় না। এ ছাড়া বিচার করা জটিল ও বুদ্ধিবৃত্তিক একটি কাজও বটে। বিচারের মতো একটি সংবেদনশীল কাজ তাই বিচারকদের দিয়েই পরিচালিত হওয়া উচিত।

অপর দিকে একটি গণতান্ত্রিক দেশে আমলাদের প্রধান কাজ হলো নির্বাচিত সরকারের বিভিন্ন সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা। তাঁরা অনেকটাই সরকারের আদেশ-নির্দেশের ওপর নির্ভরশীল। বাস্তব কারণেই আমলাদের পক্ষে স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ কম। আমলাদের দ্বারা বিচারকার্য না করানোর যুক্তির ক্ষেত্রে এটাই যথেষ্ট।

১৯৭২ সালে প্রণীত সংবিধানের ২২ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘রাষ্ট্রের নির্বাহী অঙ্গসমূহ হইতে বিচার বিভাগের পৃথকীকরণ রাষ্ট্র নিশ্চিত করিবেন।’ ১৯৭২ সালের সংবিধানে নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগের পৃথক্‌করণ নিয়ে এ রকম প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলেও তা বাস্তবায়নের জন্য ২০০৭ সাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছিল। বহুল আলোচিত মাসদার হোসেন মামলার রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে বিচার বিভাগ আলাদা হয়। পরিহাসের বিষয় হলো, বাংলাদেশে কোনো নির্বাচিত বা ‘গণতান্ত্রিক’ সরকার নয়, একটি সেনাসমর্থিত ‘তত্ত্বাবধায়ক’ সরকার এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করে।

মাসদার হোসেন মামলায় দেওয়া আদালতের সব নির্দেশনা এখনো বাস্তবায়ন হয়নি, বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে উল্টোটা হয়েছে। এর একটি কারণ হলো, আমলাতন্ত্র বা প্রশাসন ক্যাডারের একটি বড় অংশ বিচার বিভাগ পৃথক্‌করণের বিষয়টি সহজভাবে মেনে নিতে পারেনি। ২০০৭ সালে বিচার বিভাগ পৃথক্‌করণের সিদ্ধান্তের পর এ বিভাগের অনেকেই ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিলেন। বিচার বিভাগ আলাদা হলেও আমলাদের ‘সন্তুষ্ট’ করতে তাই সরকার ২০০৯ সালে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৯০ ধারায় ৪ উপধারা হিসেবে একটি নতুন বিধান যুক্ত করে। এখানে বলা আছে, সরকার চাইলেই যেকোনো নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটকে অপরাধ আমলে নেওয়ার ক্ষমতা অর্পণ করতে পারবে। এটা স্পষ্টতই বিচার বিভাগের স্বাধীনতার পরিপন্থী।

মোবাইল কোর্ট বিতর্ক

আমাদের এখানে মোবাইল কোর্টের ধারণাটি এসেছে প্রতিবেশী দেশ ভারত থেকে। ২০০৭ সালে ভারতে পঞ্চায়েত আদালতে এ কার্যক্রম শুরু হয়েছিল। লক্ষণীয় হলো, সেখানে শুধু বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তারা, অর্থাৎ বিচারকেরা মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করেন এবং প্রচলিত বিচারপদ্ধতিগুলো মেনে চলেন। এ কারণে এ উদ্যোগকে বিচারকদের মাধ্যমে প্রান্তিক মানুষদের কাছে বিচার পৌঁছে দেওয়ার একটি নজির হিসেবে দেখা হয়।

কিন্তু বাংলাদেশে মোবাইল কোর্ট ভিন্ন চেহারা নিয়েছে। ২০০৯ সালে আইনটি পাস করে অনেকগুলো বিষয়ে বিচারের দায়িত্ব আমলাদের হাতে দেওয়া হয়। সুপ্রিম কোর্টের সঙ্গে পরামর্শ না করে এবং সংসদকে পাশ কাটিয়ে গত ১০ বছরে সরকার তফসিল সংশোধন করে শতাধিক আইনের আওতায় জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের (জেলা প্রশাসক) অধীন কর্মকর্তাদের অনধিক দুই বছরের কারাদণ্ড দেওয়ার মতো ক্ষমতা দিয়েছে। এ ছাড়া মোবাইল কোর্ট আইনের বিভিন্ন ধারা নিয়ে অনেক প্রশ্ন রয়েছে।

মোবাইল কোর্ট
মোবাইল কোর্ট

মোবাইল কোর্ট আইন, ২০০৯ একটি পদ্ধতিগত আইন। অপরাধ সংঘটনস্থলে তাৎক্ষণিকভাবে অপরাধ আমলে নেওয়া ও দণ্ড দেওয়ার সীমিত ক্ষমতা ভ্রাম্যমাণ আদালত কর্তৃক পরিচালিত হয় বলে এটি একটি প্রায়োগিক বিচারপ্রক্রিয়া। এ আইনের ৭ ধারামতে, অভিযুক্ত দোষ স্বীকার করলে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট তাঁকে অভিযুক্ত করতে পারবেন। ফৌজদারি আইনের ১৬১ ধারায় পুলিশের কাছে স্বীকারোক্তির আইনগত কোনো মূল্য নেই। কিন্তু মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে শুধু স্বীকারোক্তির মাধ্যমে শাস্তি প্রদান করাকে বৈধতা দেওয়া হয়েছে। অভিযুক্ত এখানে কোনো আইনজীবীর শরণাপন্ন হতে পারেন না। ফলে আত্মপক্ষ সমর্থনের যে স্বাভাবিক বিচারপদ্ধতি, সেটিও মোবাইল কোর্টে থাকে না। মোবাইল কোর্টের পুরা প্রক্রিয়াতেই বিচারের সর্বজনীন পদ্ধতিগুলোকে পাশ কাটিয়ে শাস্তি দেওয়া হয়। এটা বিচার প্রক্রিয়ার বড় ধরনের বিচ্যুতি। এ আইনের ১৪ ধারার বিধানমতে, মোবাইল কোর্ট পরিচালনাকারী নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের ‘সরল বিশ্বাসে’ নেওয়া সিদ্ধান্তের কারণে কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হলে সেটার দায় থেকে তাঁদের অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। এ ধারা দেখে এমনটাই প্রতীয়মান হয়, বিচারকাজে আমলাদের আগ্রহ থাকলেও তাতে কোনো ভুলভ্রান্তি হলে সেটার দায়দায়িত্ব তাঁরা নিবেন না।

‘জুডিশিয়াল মাইন্ড’ বা বিচারিক মননের অনুপস্থিতি ও আইন-সম্পর্কিত বিশেষায়িত জ্ঞানের অভাবে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের দ্বারা পরিচালিত মোবাইল কোর্টের কার্যক্রমে নানা রকম অভিযোগ উঠেছে। করোনা মহামারির সময় মাস্ক না পরার অপরাধে যশোরে দুই বয়স্ক ব্যক্তিকে কান ধরে ওঠবস করিয়ে সেটির চিত্রধারণ করা কিংবা বরিশালে টিসিবির পণ্য বিক্রয়ে অনিয়মের প্রতিবাদে করায় এক আইনজীবীকে সাত দিনের কারাদণ্ড দেওয়ার মতো ঘটনা বহুল আলোচিত হয়েছিল। ২০১৭ সালে মোবাইল কোর্টকে অবৈধ ঘোষণা করেছিল হাইকোর্ট। তবে লিভ টু আপিল করলে আদালত ২০১৮ সালের ৯ জানুয়ারি সরকারকে নিয়মিত আপিল করতে বলেন। আপিল নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত মোবাইল কোর্ট চলবে মর্মে আদেশ দেন। এ আদেশ বলেই এখন সারা দেশে মোবাইল কোর্ট সক্রিয় রয়েছে। অপর একটি মামলার রায়ে আদালত বলেছিল, আইনের ওই বিধানের মাধ্যমে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেটদের বিচারিক ক্ষমতা দেওয়া সংবিধানের লঙ্ঘন ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতায় আঘাত। একই সঙ্গে এটা ক্ষমতার পৃথক্‌করণের নীতির বিরোধী।

শেষ কথা

আমলাদের বিচারিক ক্ষমতা শুধু মোবাইল কোর্টের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। ফৌজদারি কার্যবিধির ১৪৫ ধারায় জমি বা পানি বা এগুলোর সীমানা সম্পর্কে কোনো বিরোধ থাকলে বা কেউ বেদখল হলে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের বরাবর আবেদন করতে হয়। অথচ কেউ দখলচ্যুত হলে ১৮৭৭ সালের সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইনের ৯ ধারা অনুযায়ী ছয় মাসের মধ্যে দেওয়ানি মামলা করার সুযোগ আছে। ইদানীং কোথাও কোথাও গণশুনানির নামে জেলা প্রশাসকেরা বিচারকার্যে সরাসরি অংশগ্রহণ করছেন—এমন অভিযোগও পাওয়া গেছে। এসব উদাহরণ দেখে এটাই প্রতীয়মান হয়, আমাদের দেশে জেলা পর্যায়ে আমলারা প্রশাসনিক ক্ষমতার পাশাপাশি যতটুকু বিচারিক ক্ষমতা প্রয়োগ করেন, কোনো গণতান্ত্রিক দেশে এমন নজির নেই।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.